বুধবার , নভেম্বর ২৭ ২০২৪

কৃষককে সমৃদ্ধশালী করতে হবে -ড. এফএইচ আনসারী

মো. খোরশেদ আলম জুয়েল :
“মানুষের কাজ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। তবে যে কাজই করিনা কেন সবার আগে ভাবতে হবে সমাজ ও দেশের কল্যাণের কথা। নিজের উন্নতির পাশাপাশি ভাবতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি। তবেই সফলতা আপনার কাছে অধরা থাকবেনা। আমার জীবনে একটা সফলতা আরেকটা সফলতাকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমি যে কাজই করি, সবার আগে সোসাইটি বা সমাজের লাভের বিষয়টি মাথায় থাকে। এতে করে আমার নিজের যেমন লাভ হয়েছে, সমাজেরও হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি ব্যবসা জগতে ‘এসিআই লিমিটেড’ এর আজকের যে অবস্থান এবং সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, তা এসব চিন্তাভাবনারই ফসল।

আমি বরাবরই বলেছি, কৃষককে সমৃদ্ধশালী করতে হবে। কারণ, আমার বিশ্বাসের মধ্যে কখনোই ছিলনা- শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এদেশের কৃষি করতে হবে এবং করাটা যৌক্তিক হবে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ কৃষির সাথে জড়িত। খাদ্য উৎপাদন ছাড়াও জীবিকা অর্জনের বড় একটা অংশ হচ্ছে আমাদের এই কৃষি খাত। অথচ প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবে আমাদের কৃষি ও কৃষকের অবস্থার তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না। এজন্য কৃষিতে আমরা সঠিক প্রযুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব¡ দিয়েছি। আমরা নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসছি, সেটি কৃষকের কাছে নিয়ে যাচ্ছি এবং তাদেরকে প্রশিক্ষিত করছি। ফলে আগের চেয়ে কৃষির উৎপানশীলতা বাড়ছে। এতে করে কৃষকেরা তাদের কাজে উৎসাহ পাচ্ছেন। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে  সমাজ লাভবান হচ্ছে। আর এভাবেই সমাজ লাভবান হওয়ার মাধ্যমে আমরা লাভবান হচ্ছি।

আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামের পরিবেশ এবং আলো বাতাসেই আমার বেড়ে ওঠা। তাই খুব কাছ থেকে গ্রামের মানুষকে দেখেছি। তাদের কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং উপলব্ধি করেছি। প্রযুক্তি ও সঠিক তথ্যের অভাবে কৃষকের অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না, সেটি বুঝেছি। আমি ছাত্র জীবনে প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলাম। যে কারণে সমাজটাকে দেখতে, বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে আমার জন্য সহায়ক হয়েছে।”

উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন, বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরে স্বনামধন্য বিজনেস আইকন হিসেবে পরিচিত ড. এফএইচ আনসারি। দেশের কৃষি ব্যবসা জগতে তিনি একজন রোল মডেল এবং ‘কৃষকের জন্য সম্পদ সৃষ্টি’ নামে নতুন এক মিশন নিয়ে কাজ করছেন। কৃষির বিভিন্ন শাখা যেমন- বীজ, সার, ফসলের পরিচর্যা, খামার প্রযুক্তি, কৃষি যন্ত্রপাতি, পশুস্বাস্থ্য ও দেশের পোল্ট্রি শিল্পে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। তাঁর নতুন মিশনের অনুসরণে, তিনি বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।

ড. আনসারী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক -এসিআই মোটরস লিমিটেড, এসিআই এগ্রোলিংক লিমিটেড ও প্রিমিয়াফ্লেক্স প্লাস্টিক লিমিটেড। এছাড়াও তিনি এসিআই এগ্রি বিজনেস -এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। স্বপ্নবান একজন মানুষ। যিনি স্বপ্ন দেখেন একা, কিন্তু বাস্তবায়ন করেন নিজ এবং সমাজের জন্য। স্বপ্ন বাস্তবায়নে থাকেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কৃষি শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিসমূহে দীর্ঘ ৩৫ বছরেরও অধিক সময় ধরে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন ব্যাক্তি। বিগত ২২ বছর তিনি এসিআই গ্রুপের একজন বিজনেস লিডার হিসেবে কর্মরত আছেন।

ড. আনসারী ১৯৫৬ সনের ২২ এপ্রিল দেশের সিল্ক নগরী হিসেবে পরিচিত রাজশাহী জেলার গোদাগারী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে ১৯৭৭ সনে অনার্স, ১৯৭৮ সনে মাস্টার্স পাস করেন। পরবর্তীতে ইকোলজি (ঊপড়ষড়মু) বা বাস্তুবিদ্যা -এর ওপর পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম নজরুল ইসলাম এবং মাতা নুরজাহান বেগম।

কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮১ সনে সুইস বহুজাতিক কোম্পানি ‘সিবা গেইগি’তে (বর্তমানে সিনজেনটা নামে পরিচিত) একজন বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে। এরপর শ্রম, অধ্যাবসায় এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের মাধ্যমে ১৯৮৫ সনে প্রোডাক্ট ম্যানেজার, ১৯৮৬ সনে ন্যাশনাল সেলস ম্যানেজার এবং ১৯৮৮ সনে ন্যাশনাল মার্কেটিং অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৯২ সনে সেতু কর্পোরেশন (জাপানের বিখ্যাত সুমিটোমো কর্পোরেশন বাংলাদেশী এজেন্ট) -এ  জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত তিনি সিবা গেইগি’তে মার্কেটিং অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৯৫ সনে কৃষি শিল্পে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি এসিআই লিমিটেড -এ ‘হেড অব ক্রপ প্রোটেকশন বিজনেস, হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের পরই প্রতিষ্ঠা করেন এসিআই ফর্মুলেশন নামে নতুন একটি কোম্পানি যেখানে ফসল সুরক্ষা  ও মানব স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পণ্য উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত এবং পরিচিত দুটি পণ্য ‘এসিআই এ্যারোসল’ এবং ‘এসিআই মশার কয়েল’ সেখান থেকেই উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতের বিকাশের কেবল তখন শুরু। ১৯৯৭ সনে পশু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ওষুধ বিপণনের মাধ্যমে এসিআই পরিবারে তিনি এক নতুন বৈচিত্র্যতা নিয়ে আসেন। ১৯৯৮ সনে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন এক ফ্যাক্টরি যেখানে উৎপাদিত হয় পশু পাখির স্বাস্থ্য ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, ইনজেকশনসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্য।

ঢাকার শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত বর্তমানে এসিআই লিমিটেড’র কর্পোরেট অফিসের যে নয়নাভিরাম ভবনটি অনেকের কাছেই পরিচিত, সেটি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন ২০০২ সনে। ঠিক তার পরের বছর অর্থাৎ ২০০৩ সনে তিনি জিএমপি (গুড ম্যানুফাকচারিং প্র্যাকটিস) নিয়ম মেনে সেখানে ফার্মাসিউটিক্যালস ফ্যাক্টরির উন্নয়ন করেন। একই বছর প্রতিষ্ঠা করেন ‘টেটলি চা’ ফ্যাক্টরি যা দেশের চা পানকারীদের কাছে একটি সুপরিচিত নাম।

ভ্যাকুয়াম পদ্ধতিতে পরিশোধিত লবণ উৎপাদন দেশে তিনিই প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন ২০০৪ সনে। একই বছর এসিয়ান কনজ্যুমার কেয়ার এর সাথে যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ডাবর ফ্যাক্টরি, যেটি ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত। আবার একই বছরে এসিআই গোদরেজ এগ্রোভেট (প্রাইভেট) লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠা করেন যৌথ উদ্যোগ কোম্পানি; যেটি দেশের সবুজের লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। সেখান থেকে উৎপাদিত হয় আন্তর্জাতিক মানের পোলট্রি ও পশু খাদ্য যা দেশের পোলট্রি ও প্রাণিসম্পদ খাতে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি নাম। এরপর ২০০৫ সনে পঞ্চগড়ে প্রতিষ্ঠা করেন পোলট্রি ব্রিডিং ফার্ম এবং ময়মনসিংহের ভালুকায় পোলট্রি হ্যাচারি।

২০০৭ সনে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবসায় ‘কৃষকদের জন্য সম্পদ সৃষ্টি’ নামে নতুন এক মিশন গ্রহণ করেন ড. আনসারি। মিশনটিকে সফল করার জন্য কৃষকদের বীজ, সার, কৃষি যন্ত্রপাতি, পণ্য বিনিময় ব্যবসার সমস্যাগুলোর সম্পূর্ণ সমাধান ব্যবস্থা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা ক]েরন। ২০০৮ সনে এসিআই পরিবারে যুক্ত করেন প্রিমিয়াফ্লেক্স প্লাস্টিকস নামে নতুন আরো একটি কোম্পানি। বাংলাদেশে ফ্লেক্সিবল প্যাকেজিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান।

ড. আনসারী ব্যাক্তিগত জীবনে খুবই সাধারণ। ভালোবাসেন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে এবং লং টেনিস খেলতে। নতুনকে জানা, সেটিকে সম্প্রসারণ এবং বাস্তবায়ন করা তাঁর একমাত্র শখ।

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য তাঁর পরামর্শ হলো, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করতে হবে এবং সেটি বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে। দেশের কল্যাণে সঠিক লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে গেলে সাফল্য আসবেই।

This post has already been read 32753 times!