রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪

কেঁচোসার হতে পারে স্বনির্ভরতার অন্যতম হাতিয়ার

vermi compostপ্রফেসর ড. এমএ রহিম ও ড. শামছুল আলম মিঠু:
আমাদের দেশের বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রে ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভার্মিকম্পোস্ট সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা চলছে এবং উন্নত মানের ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করতে ইউড্রিলাস ইউজেনি এবং আইসেনিয়া ফিটিডা-কে বেশি প্রাধান্য দেয় হয়। পশ্চিম দেশগুলোতে আবার ইউড্রিলাস ফিটিডার ব্যবহার বেশি। ইউড্রিলাস ইউজেনি কেঁচোর সহনশীলতা বেশি। বিভিন্ন জৈব কীটনাশক যেমন-নিম খোল, মহুয়া খোল, গ্লাইরিসিডিয়া, ইউপাটোরিয়াম ইত্যাদির প্রতি অনেক বেশি সহনশীলতা দেখায়। যে সব দ্রব্যকে কেঁচো সারে পরিণত করা যায় তা হলো-

১. প্রাণীর মল- গোবর, হাঁস-মুরগীর বিষ্ঠা, ছাগল-ভেড়ার মল ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে গোবর উৎকৃষ্ট; মুরগির বিষ্ঠায় প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফেট থাকে যা পরিমাণে বেশি হলে কেঁচোর ক্ষতি করতে পারে। তাই খড়, মাটি বা গোবরের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা ভালো।
২. কৃষিজ বর্জ্য-ফসল কাটার পর পড়ে থাকা ফসলের দেহাংশ যেমন-ধান ও গমের খড়, মুগ, কলাই, সরষেও গমের খোসা, তুষ, কাণ্ড, ভুষি, সব্জির খোসা, লতাপাতা, আখের ছিবড়ে ইত্যাদি।
৩. গোবর গ্যাসের পড়ে থাকা তলানি বা স্লারী (slurry)।
৪. শহরের আবর্জনা এবং
৫. শিল্পজাত বর্জ্য যেমন-দুগ্ধ শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ইত্যাদির বর্জ্য। যে সব বস্তু ব্যবহার করা উচিত নয়, তা হলো- পেঁয়াজের খোসা, শুকনো পাতা, লঙ্কা, মসলা এবং অম্ল সৃষ্টিকারী বর্জ্য যেমন- টমেটো, তেঁতুল, লেবু, কাঁচা বা রান্না করা মাছ মাংসের অবশিষ্টাংশে ইত্যাদি। এছাড়া অজৈব পদার্থ যেমন- পাথর, ইটের টুকরো, বালি, কাঁচা, পলিথিন ইত্যাদি।

তৈরি পদ্ধতি
সার তৈরি করতে প্রথমে ছায়াযুক্ত উঁচু জায়গা বাছতে হবে, যেখানে সরাসরি সূর্যালোক পড়বে না এবং বাতাস চলাচল করে। উপরে একটি ছাউনি দিতে হবে। মাটির পাত্র, কাঠের বাক্স, সিমেন্টের পাত্র, পাকা চৌবাচ্চা বা মাটির উপরেও কেঁচো সার প্রস্তুত করা যায়। লম্বা ও চওড়ায় যাই হোকনা কেন উচ্চতা ১-১.৫ ফুট হতে হবে। পাত্রের তলদেশে ছিদ্র থাকতে হবে যাতে কোনভাবেই পাত্রের মধ্যে জল না জমে। একটি (৫-৬x ৩x২) ঘনফুট চৌবাচ্চা তৈরি করে নিতে পারলে ভালো হয়।

প্রথমে চৌবাচ্চা বা পাত্রের তলদেশে ৩ ইঞ্চি বা ৭.৫ সেমি ইঁটের টুকরো, পাথরকুচি ইত্যাদি দিতে হবে। তার উপরে ১ ইঞ্চি বালির আস্তরণ দেয়া হয় যাতে পানি জমতে না পারে। বালির উপর আস্ত বা গোটা খড় বা সহজে পচবে না এরকম জৈব বস্তু বিছিয়ে বিছানার মত তৈরি করতে হয়। এরপর আংশিক পচা জৈব দ্রব্য (খাবার), ছায়াতে ছড়িয়ে ঠাণ্ডা করে বিছানার উপরে বিছিয়ে দিতে হবে। খাবারে পানির পরিমাণ কম থাকলে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে যেন ৫০-৬০ শতাংশ পানি থাকে। খাবারের উপরে প্রাপ্ত বয়স্ক কেঁচো গড়ে কেজিপ্রতি ১০টি করে ছেড়ে দিতে হবে। কেঁচোগুলো অল্প কিছুক্ষণ স্থির থাকার পর এক মিনিটের মধ্যেই খাবরের ভেতরে চলে যাবে। এরপর ভেজা চটের বস্থা দিয়ে জৈব দ্রব্য পুরোপুরি ঢেকে দেওয়া উচিত। বস্তার পরিবর্তে নারকেল পাতা ইত্যাদি দিয়েও ঢাকা যেতে পারে। মাঝে মাঝে হাল্কা পানির ছিটা দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে অতিরিক্ত পানি যেন না দেয়া হয়। এভাবে ২ মাস রেখে দেয়ার পর (কম্পোস্ট) সার তৈরি হয়ে যাবে। জৈব বস্তুর উপরের স্তরে কালচে-বাদামী রঙের, চায়ের মত দানা ছড়িয়ে থাকতে দেখলে ধরে নেওয়া হয় সার তৈরি হয়ে গেছে। এই সময়ে কোন রকম দুর্গন্ধ থাকে না।

কম্পোস্ট তৈরি করার পাত্রে খাবার দেওয়ার আগে জৈব বস্তু, গোবর, মাটি ও গোবর সার নির্দিষ্ট অনুপাতে (৬ঃ৩ঃ০.৫ঃ০.৫) অর্থাৎ জৈব আবর্জনা ৬ ভাগ, কাঁচা গোবর ৩ ভাগ, মাটি ১/২ ভাগ এবং খামারজাত সার ১/২ ভাগ, মিশিয়ে আংশিক পচনের জন্য স্তুপাকারে ১৫-২০ দিন রেখে দিতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর ঐ মিশ্রিত পদার্থকে কেঁচোর খাবার হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

সাধারণভবে, একটি ১ মিটার লম্বা, ১ মিটার চওড়া ও ৩ সেমি. গভীর আয়তনের গর্তের জন্য ৪০ কিলোগ্রাম খাবারের প্রয়োজন হয়। এরকম একটি গর্তে এক হাজার কেঁচো প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রথম দিকে কম্পোস্ট হতে সময় বেশি লাগে (৬০-৭০ দিন) । পরে মাত্র ৪০ দিনেই সম্পন্ন হয়। কারণ ব্যাক্টোরিয়া ও কেঁচো উভয়েরই সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। তথ্য অনুসারে ১ কেজি বা ১০০০টি কেঁচো, ৬০-৭০ দিনে ১০ কেজি কাস্ট (cast) তৈরি করতে পারে।

এক কিলোগ্রাম কেঁচো দিনে খাবার হিসাবে ৫ কিলোগ্রাম সবুজসার খেতে পারে। তার জন্য ৪০-৫০ শতাংশ আর্দ্রতা বজায় রাখা আবশ্যক। প্রায় ৮০০-১০০০ কেঁচোর ওজন হয় ১ কিলোগ্রাম। এই পরিমাণ কেঁচো সপ্তাহে ২০০০-৫০০০টি ডিম বা গুটি দেয়। পূর্ণাঙ্গ কেঁচোর জন্ম হয় ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যে।

ভার্মিকম্পোস্ট সব প্রকার ফসলে যে কোন সময়ে ব্যবহার করা যায়। সবজি এবং কৃষি জমিতে ৩-৪ টন প্রতি হেক্টরে ও ফল গাছে গাছ প্রতি ৫-১০ কিলোগ্রাম হারে ব্যবহার করা হয়। ফুল বাগানের ক্ষেত্রে ব্যবহারের পরিমাণ আরো বেশি ৫-৭.৫ কুইন্টাল এক হেক্টর জমিতে। বাণিজ্যিক ভিতিতে কেঁচোসার করতে গেলে একটি ছাউনীর নীচে (৫x৩x১.৫ ) মাপের ৫-৬টি চৌবাচ্চায় ন্যুনতম ২০০০টি কেঁচো ছাড়লে ৪০০ কেজি আবর্জনা থেকে ৫০-৬০ দিনের মধ্যে ১০০ কিলোগ্রাম কেঁচোসার বিক্রি করে গ্রামের যুবকেরা সহজেই স্বনিযুক্ত আয়ের সংস্থান করতে পারেন। জমির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা বজায় রাখার জন্য জৈব সার ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। এদেশের মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন এ ব্যাপারে। তাই ভার্মি-কম্পোস্ট উৎপাদন ও তার ব্যবহার এক মূলবান ভুমিকা পালন করতে চলেছে আগামী দিনগুলোতে।

This post has already been read 6067 times!

Check Also

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার আক্রমণ: ফলনের ক্ষতি ও করণীয়

ড. মো. মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে ধান প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিত এবং এর উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির …