শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

ভালো নেই জলরাজ্যের জলপতিরা

sundarbanগৌতম কুমার রায়:
জল-জাল-যান নিয়ে জলরাজ্যের অধিকর্তা হলো জলপতিরা। কেমন আছেন সুন্দরবনের জলস্বর্গের জলপতিরা। প্রকৃতি তার অপরূপ রং-তুলি দিয়ে সাজিয়েছে প্রাণের স্পর্শ জাগানো বৈচিত্র্যময় মনোহরিনী সুন্দরবনকে তার কারিগর হিসেবে জলপতিদের অবদান কিন্তু নেহায়েত কম নয়। সুন্দরবনকে ঘিরে আমাদের অর্থনীতির কৃষি, মৎস্য ও বনজসম্পদ খাতগুলো এবং প্রাণীকুলের অভয় আশ্রয়স্থল। দেশের অর্থনীতির সাথে জেলে বা জলপতিদের জীবন ব্যবস্থা ও জীবন-জীবিকার সাথে সুন্দরবনের সম্পর্ক নিবীড়। আবার প্রকৃতির রূঢ় রূপের প্রতিশোধ পরায়ণতা ঝুঁকি থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে সুন্দরবন  স্বার্থক প্রাচীরের মতো। জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের বিপদের বন্ধু সুন্দরবন। অথচ আজ সেই সুন্দরবন তার আপন অস্তিত্বের জন্য রয়েছে মহাসংকটে। উজাড় হচ্ছে বনের সকল সম্পদ। স্থল ও জলজ  প্রাণী আশ্রয় হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। প্রকৃতির এই প্রাচীর তার রুদ্ররোষ আবার অর্থলোভী ও স্বার্থান্বেষী মানুষের অত্যাচারে এখন অনেকটাই বিবর্ণ। বনের জলপতিদের অত্যাচারিত হয় জলদস্যুদের কারণে। মুক্তিপণের কারণে তাদের জীবন বিপন্ন। শত শত জেলে পরিবারে অশনি যাত্রার কারণ জলদস্যুদের অত্যাচার। তাদের ভাসমান জীবনের জন্য কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই এই জেলে পরিবারের।

আমাদের সুন্দরবন তামাম পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট জোয়ার-ভাটার কারণে এই বনের ভূমি কোথাও ঢালু, আবার কোথাও সমান। প্রকৃতির অপরূপা মোনলোভা এ বনের বিস্তৃতি ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে। বনের মধ্যে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জলরাশির স্পর্শ। বনের মধ্যে জলরাশির বিস্তৃতি সমস্ত বনের আয়তনের শতকরা ৩১.১ ভাগ, অর্থাৎ ১৮৭৪ বর্গ কিমি.। এছাড়াও সমুদ্র বরাবরে ২০ কিমি. দীর্ঘ তটরেখা রয়েছে। যার আয়তন হলো ১৬০৩ বর্গ কিমি.। সুন্দরবনের লোনা ও ঈষৎ লোনা জলের আধারই হচ্ছে মৎস্য প্রজনন সম্ভার। যা কিনা হাজারো জলপতিদের জীবনধারনের অবলম্বন। আমাদের প্রয়োজনী প্রোটিনের যোগান, মাছ থেকে আগত বৈদেশিক মুদ্রা আসে এই জল থেকে। এই বনের মধ্যে রয়েছে ৪৫০টি নদ নদী। ১৬ প্রকারের বিভিন্ন জালের ব্যবহার হয় এই জলে। তবে এখানে ১৮টি নিষিদ্ধ খাল রয়েছে। এছাড়া এখানে ১.৪৮ লাখ জলপতি কাজ করে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকে তাদের শ্রমের বিনিময়ে।

আমাদের জেলেরা অব্যহতভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে গেলেও তাদের সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন আঙ্গিকের। এক সময়ে বারো মাসের তের পার্বণ এবং ঈদ আনন্দের সুর ধারা বেজে উঠতো জেলে পল্লী থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে উপেক্ষিত রাজনৈতিক আবহ, অবমূল্যায়িত সামাজিক নিরাপত্তা এবং অবহেলিত সাংস্কৃতিক ধারায় ছিটকে পড়েছে তারা। দাসত্ব, শোষণ আর সুবিধাবঞ্চিত জলপতি এবং তাদের পরিবারে সবসময় অন্ধকারের ঘোর ছায়া বিরাজমান। এখানকার জেলেরা ক্ষুধাতে খাদ্য পায় না, পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, চিকিৎসা সেবার স্পর্শ নেই, আর্থ-সামাজিক অবক্ষয়ে জর্জরীত। ১.৪৮ লাখ জেলে সরব থেকে জীবন চালায় সুন্দরবনে। অথচ তাদের আহরিত মাছে আমাদের প্রোটিনের যোগান এলেও রাষ্ট্রের বিষয়ে তাদের অংশগ্রহণ তেমন আছে বলে মনে হয়না। অন্তত: এখন আমাদেরকে এই বনকে নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। কেননা বনের বিপর্যয় আমাদের অস্তিত্বের বিপর্যয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার তাগিদের জন্য বনের সব সম্পদ এবং বসবাসকারি প্রাণীকে বসবাসযোগ্য আবাস তৈরির ব্যবস্থা করতে না পারলে মহাবিপর্যয়ে পড়বে গোটা দেশ।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

This post has already been read 3653 times!

Check Also

যে জেলায় ইলিশ উৎপাদন হয়, ওই জেলার মানুষ গরিব হতে পারে না -মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

ভোলা সংবাদদাতা: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, ইলিশের সম্পদ রক্ষায় সবাইকে একসাথে কাজ …