কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ :
নিত্য প্রয়োজনীয় একটি পণ্যের নাম ‘মশার কয়েল’। শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে কয়েল ব্যবহার করে মানুষ। আর একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায় অতি মুনাফা পেতে প্রকাশ্যে বিক্রি করছেন অনুমোদনহীন নি¤œমানের মশার কয়েল। নওগাঁর বাজারে এ অনুমোদনহীন মশার কয়েলে সয়লাব হয়ে পরেছে।
স্থানীয় চিকিৎসকরা বলছেন, নিম্নমানের কয়েল মানুষ দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে দূষিত ধোয়ায় মানবদেহের শ্বাসকষ্ট সহ কিডনি, লিভার নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।
শহরসহ গ্রামের বিভিন্ন দোকানে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে অনুমোদনহীন ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এসব মশার কয়েল। ওইসব কয়েলের বিষক্রিয়ায় বিকলাঙ্গ, ক্যান্সার, শ্বাসনালীর প্রদাহসহ দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব এমনকি গর্ভের শিশুর বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাড়তি লাভের আশায় দোকানিরা ওইসব কয়েল বিক্রি করছেন।
বাজারগুলোতে নিম্নমানের কয়েলের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়লেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি বা কোন মনিটরিং করা হচ্ছে না। অন্যদিকে এসব কয়েল কোম্পানীগুলো ভুয়া পিএইচপি নম্বর ও বিএসটিআই’র লোগো ব্যবহার করে আকর্ষণীয় মোড়কে কয়েল বাজারে ছাড়া হচ্ছে। বিএসটিআই এর নকল ব্যান্ডের ট্রেডমার্ক দিয়ে কয়েল উৎপাদন করে দেশীয় কয়েলের প্যাকেট ব্যবহার করে তা বাজারজাত করে আসছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিদ্যমান বালাইনাশক অধ্যাদেশ- (পেস্টিসাইড অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ ও পেস্টিসাইড রুলস ১৯৮৫) অনুসারে, মশার কয়েল উৎপাদন, বাজারজাত ও সংরক্ষণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। অধ্যাদেশ অনুযায়ী- অধিদপ্তরের অনুমোদন পাওয়ার পর পাবলিক হেলথ প্রোডাক্ট (পিএইচপি) নম্বর ও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিয়েই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বালাইনাশক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হবে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মশার কয়েলে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৩ মাত্রার ‘অ্যাকটিভ ইনটিগ্রেডিয়েন্ট’ ব্যবহার নির্ধারণ করেছে। এই মাত্রা শুধুমাত্র মশা তাড়াতে কার্যকর, মারতে নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনুমোদনহীন ব্যবসায়ীমহল কর্তৃক প্রস্তুত ও বাজারজাতকৃত কয়েলে শুধু মশাই নয়, বিভিন্ন পোকামাকড়, তেলাপোকা এমনকি টিকটিকি পর্যস্ত মারা যায়!
শহরের তিব্বত মার্কেট, আল আমিন মার্কেট, ধর্মতলা রোডসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ‘নাইট রোজ, অতন্ত্র প্রহরী জাম্বো, অতন্ত্র প্রহরী মিনি, ফ্যামিলি, ওয়ান টেন, সান পাওয়ার, তুলসি পাতা, সাঝের তারা, বস ও রকেট সহ অনুমোদনহী কয়েলে বাজার সয়লাব।’
শহরের সুলতানপুরের বাসিন্দা সোহরাব বলেন, ‘মশা নয় মানুষ মারার কয়েল। স্বল্প দামের কয়েলের ধোয়াতে ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। যেন দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। মশাও মরে, সাথে তেলাপোকাও।’
শহরের তিব্বত মার্কেটের মেসার্স মাহমুদ হাসান ট্রেডার্স এর স্বত্বাধিকারি মাহমুদ হাসান বলেন, ‘তিনি কয়েকটি কয়েলের ডিলার (ডিস্ট্রিবিউটর)। অনুমোদনহীন দেশিয় কয়েলের কারণে ব্যান্ডের কয়েল কম বিক্রি হচ্ছে। আর দিন দিন ব্যান্ডের কয়েলের চাহিদাও কমছে। আর দেশিয় কয়েল বাজারে বেশি বিক্রি হচ্ছে।’
প্রহরী কয়েলের বাজারজাত কারক মেসার্স আব্দুল হাই ট্রেডার্স এর স্বত্বাধিকারি আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘সবধরনের প্রক্রিয়া শেষে কয়েলটি বাজারজাত করা হচ্ছে। আমাদের কেমিক্যাল চায়না থেকে আমদানি করা হয়। কয়েলে কোন ধরনের মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি। তবে কতিপয় কিছু ব্যবসায়ীরা সুবিধা না পেয়ে এ গুজব ছড়াচ্ছেন।’
এটুজেড মশার কয়েলের ডিলার আব্দুল মজিদ বলেন, ‘আমাদের কয়েলের রেজিষ্ট্রেশন আছে। আমরা ভ্যাট, ট্রাক্স দিয়ে ১ কাটুন(৬০ প্যাকেট) কয়েল উৎপাদন করতে ২ হাজার ২০ টাকা খরচ হয়। যেখানে অনুমোদনহীন মশার কয়েল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯২০ টাকা। আমরা তো লোকসান দিয়ে বাজারে কয়েল বিক্রি করতে পারব না। আর তাদের কারণে আমরা প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বাজারে টিকতে পারছিনা। এ ব্যাপারে বিএসটিআই প্রশাসনকে জানানো হলেও তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি।’
নওগাঁ সিভিল সার্জন ডা. রওশন আরা খানম বলেন, ‘মশার কয়েল এমনিতেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্রতিটি কয়েল স্বাস্থের উপর প্রভাব ফেলবে। এটি ক্ষতিকর একটি দিক। আর অনুমোদনহীন মশার কয়েল তো বেশি ক্ষতিকর। অতিমাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশক মিশ্রিত কয়েল মানুষ দীর্ঘ মেয়াদী ব্যবহার করলে শ্বাসকষ্ট, লিভার, কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যারা এর সাথে জড়িত তাদের ভ্রাম্যমানের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজিত কুমার মল্লিক বলেন, ‘কয়েল স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। তবে যে লিকুইড আছে সেটার কোন সমস্যা নেই। কয়েলের ক্ষেত্রে কীটনাশকের বিষয়টি ঢাকার হেড অফিস দেখেন। তবে বাজারে অনুমোদনহীন নিম্নমানের যেসব কয়েল আছে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমান দিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’