ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা থেকে):
নানা সমস্যায় জর্জরিত খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত দৌলতপুর জুট মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা। মিল চালুর আড়াই বছর পার হলেও এসব শ্রমিকদের চাকুরি স্থায়ীকরণ করা হয়নি। নেই আবাসন সুবিধা। ফলে অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিলের ন্যায় তারা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মিল কর্তৃপক্ষ বলছেন, চাকুরি স্থায়ীকরণ, চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা বিষয়ে বিজেএমসি সিদ্ধান্ত নেবে। অপরদিকে মিলটি পুনঃ চালুর এক বছর পর থেকে পড়েছে লোকসানে। মিলে অর্থের অভাবের পাশাপাশি রয়েছে পাটের সংকট। ফলে অধিকাংশ তাঁত বন্ধ থাকায় হ্রাস পেয়েছে উৎপাদন। এছাড়া রয়েছে জনবল সংকট।
মিল সূত্র জানায়, নগরীর খালিশপুরের ভৈরব নদীর তীরে ১৯৫৩ সনে ২২.৫৯ একর জায়গা জুড়ে দৌলতপুর জুট মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর মিলটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায় ১৯৫৫ সনে। মিলটি ১৯৫৩ সন থেকে ১৯৬৫ সন পর্যন্ত ব্যক্তি মালিকানায় ছিল। আর ১৯৬৫ সন থেকে ১৯৭২ সন পর্যন্ত ইপিআইডিসি সম্পত্তির আওতায় ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭২ সনে মিলটি বিজেএমসি’র আওতায় আনা হয়। লোকসানের অজুহাতে ২০০২ সনে মিলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
পরবর্তীতে ২০১১ সনের ১০ অক্টোবর সরকার পুনঃ চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। মিলটির রক্ষণাবেক্ষণ কাজ শুরুর পর ২০১২ সনের ১১ এপ্রিল পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যায়। ২০১৩ সনের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানের জনসভায় দৌলতপুর জুট মিলটির উদ্বোধণ ঘোষণা করেন। ওই বছর জুলাই মাসে মিলটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রুপ নেয়। এ সময়ে মিলটি লাভবান থাকলেও ২০১৪ সনে লোকসানে পড়ে।
মিলটি প্রতিষ্ঠাকালে ছিল ২৫০টি তাঁত। বর্তমানে ১৮৫টি তাঁতের বাজেট থাকলেও চলছে মাত্র ৭৭-৭৯টি। আর মিলটি পরীক্ষামূলক উৎপাদনের সময় অদক্ষ শ্রমিক ১৩০ ও দক্ষ শ্রমিক প্রতিদিন ১৬৫ টাকা করে পেত। বর্তমানে ২৭৭ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গ্রেড অনুযায়ী শ্রমিকদের মজুরি দেয়া হয়। মিলে ৯৩৪ জন নিবন্ধিত শ্রমিকদের মধ্যে বর্তমানে ৫৯৪ থেকে ৬শ’ জন কর্মরত রয়েছেন। তাদের দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করানো হচ্ছে। এ মিলটির কর্মরত শ্রমিকদের সপ্তাহে মজুরি পরিশোধ করতে হয় প্রায় সোয়া ১২ লাখ টাকা। বর্তমানে শ্রমিকদের এক সপ্তাহের মজুরি বকেয়া রয়েছে। রয়েছে কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জনবল সংকট। ১৮২ জন কর্মচারীর মধ্যে কর্মরত রয়েছে মাত্র ৮৫ জন এবং ৫৮ জন কর্মকর্তার মধ্যে কর্মরত রয়েছে মাত্র ২৪ জন। প্রতিমাসে কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মজুরি পরিশোধ করতে হয় প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টাকা।
এদিকে মিলটিতেও রয়েছে অর্থ সংকট। ফলে পর্যাপ্ত কাঁচা পাট কিনতে পারছে না। পাটক্রয়ের মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও মিল কর্তৃপক্ষ অর্থের অভাবে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৫ শতাংশ পাট ক্রয় করতে পেরেছে। চলতি অর্থ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিজেএমসি মিলে পাটক্রয়ের জন্য ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা প্রদান করেছে। এ অর্থ বছরে পাট ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১৮ হাজার ৩৩৮ কুইন্টাল। গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাট ক্রয় করা হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৪৭৮ কুইন্টাল। বর্তমানে মিলে ১৪ পাট রয়েছে। অপরদিকে মিলের উৎপাদিত পণ্যের ব্যয়ের চেয়ে হ্রাস পেয়েছে বিক্রয় মূল্য। মিলের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয় মূল্যও হ্রাস পেয়েছে।
ফলে এ মিলটিও বর্তমানে লোকসানে রয়েছে। উৎপাদিত পণ্যের রফতানিও কমেছে। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে এ মিল থেকে রফতানি হয় ৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা মূল্যের ৬৭১ দশমিক ৭০ মেট্রিকটন পাটজাতপণ্য। ২০১৩-২০১৪ সনে তা হ্রাসে পেয়ে ২ কোটি ৭৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা মূল্যের ৩২০ দশমিক ৭৬ মেট্রিকটন পাটজাতপণ্য এবং ২০১৪-২০১৫ সনে ১ কোটি ৭০ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের ২২৪ দশমিক ৭৫ মেট্রিকটন পাটজাতপণ্য রফতানি হয়।
মিলের শ্রমিকরা বলেন, মিল থেকে যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে বাড়ি ভাড়া, বাজার-সদাই, চিকিৎসা খরচ, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়াসহ অন্যান্য খরচ মেটানো সম্ভব হয় না। স্বল্প মজুরি পাওয়া এসব শ্রমিক কর্মচারিরা আবাসন বরাদ্দ না পেয়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
আবার কোন শ্রমিক গুরুতর আহত হলে তাদের নিজস্ব অর্থায়নে চিকিৎসা নিতে হয়। আবাসন থাকা সত্বেও শ্রমিকরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে দাবি মিলের সিবিএ সভাপতি মো. হেমায়েত হোসেনের। মিলের প্রকল্প প্রধান জানান, মিলটি পুনঃচালুর পর এক বছর লাভে ছিল। তবে, বিশ্ববাজারে মন্দা, রফতানি মূল্য হ্রাস, আর্থিক সংকট ও পাটের অভাবে মিলটি বর্তমানে লোকসানে রয়েছে। তিনি বলেন, পাট ক্রয়ে অর্থায়ন প্রয়োজন। আর মিলের শ্রমিক স্থায়ীকরণে বিজেএমসি’র সিদ্ধান্ত নেবে।