ফকির শহিদুল ইসলাম খুলনা থেকে:
সুন্দরবনের খালগুলোতে মাছ শিকারের জন্য হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে বিষ বা কীটনাশক। কোনও নিয়মের বালাই যেন নেই। যে কোনও কীটনাশক দোকানে গেলেই পাওয়া যায় মাছ শিকারের এই ওষুধ। তবে দোকানিদের ভাষ্য, কীটনাশক শুধু যে মাছ শিকারের জন্য ব্যবহার হয় তা নয়।
এদিকে বিভিন্ন খালে প্রতিনিয়ত রাতের আঁধারে বিষ প্রয়োগ করে চলছে মাছ শিকার। এই ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে কার্যকরী উদ্যোগ নেই বললেই চলে। একশ্রেণীর অসাধু জেলে এই বিষ দিয়ে সুন্দরবনের খালগুলোতে মাছ শিকার করছে। এ কারণে হুমকির মুখে পড়ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। চিকিৎসকদের মতে, বিষাক্ত পানির মাছ খেলে মানুষের কিডনি ও লিভারে জটিলতা দেখা দেয় বলে জানিয়েছেন।
অপরদিকে সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধখালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার অভিযোগে তিন জেলেকে আটক করেছেন বন বিভাগের সদস্যরা। শুক্রবার দুপুরে পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের কেয়াখালী খাল থেকে তাদের আটক করা হয়।
আটক ব্যক্তিরা হলেন, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাতনেখালী গ্রামের সবদুল গাজীর ছেলে আক্তারুল (৩৫), আব্দুল মজিদ গাজীর ছেলে আকছেদুর রহমান (৩৫) ও দলিলউদ্দিন গাজীর ছেলে আব্দুল করিম গাজী (৪৫)। আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুন্দরবনের ৩১ দশমিক এক ৫ ভাগ এলাকা জুড়ে রয়েছে বিশাল জলভাগ। এখানকার অসংখ্য খালে আছে প্রায় তিন শতাধিক প্রজাতির মাছ। বনবিভাগ থেকে অবশ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে কিছু খাল।
বনবিভাগের পশ্চিম রেঞ্জের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) বশিরুল আল মামুন জানান, সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের চারটি রেঞ্জের আওতাধীন ১৮টি খালে সব ধরনের মাছ ধরার জন্য নিষেধাজ্ঞা প্রাদান করা হয়। কারণ এই ১৮টি খালে মা মাছ অবস্থান নেয়। মাছের প্রজননের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেউ তা শিকার করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন তিনি। গত পাঁচ বছরে এই অপরাধে ৩৭টি মামলা দিয়ে আসামিদের জেলে পাঠানো হয় বলে তথ্য দেন এই বনকর্মকর্তা।
গত জুনে বিষ দিয়ে মাছ ধরার সময় চার জেলেকে আটক করে কোস্টগার্ড। পরে তাদের খুলনার কয়রা থানায় সোপর্দ করা হয়। এমন তথ্য দিয়ে কোস্টগার্ড পশ্চিমজোনের (মংলা সদর দফতর) অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার ফরিদুজ্জামান বলেন, সুন্দরবনে বিষ দিয়ে ধরায় শুধু অন্য প্রজাতির মাছই ধ্বংস হচ্ছে না, এর সঙ্গে বন ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে কঠোর অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে কোস্টগার্ড। একই সঙ্গে জেলেদের যেসব মহাজনরা বিষ দিয়ে বনের খালে পাঠাচ্ছে তাদেরকেও চিহ্নিত করে ধরা হবে বলে জানান কোস্টগার্ড পশ্চিমজোনের (মংলা সদর দফতর) অপারেশন কর্মকর্তা।
তবুও সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের ধ্বংসযজ্ঞ থেমে নেই। একশ্রেণীর অসাধু জেলেচক্র এই অভয়ারণ্যে প্রতিনিয়ত বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করে চলছে। সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার জয়মনি গ্রামের প্রদীপ মন্ডল, আলমগীর ও নজরুলসহ কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। বেশি মুনাফার আশায় সুন্দরবনের বিভিন্ন নিষিদ্ধ খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করেন বলে স্বীকার করেছেন তারা।
জেলেদের দাবি, এই বিষ বাজারের যে কোনও কীটনাশক দোকান থেকে সংগ্রহ করা যায়। ডায়মগ্রো, ফাইটার, রিপকর্ড এবং পেসিকল নামের কীটনাশক কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য চাষিরা কিনে থাকেন। এগুলো দিয়ে সুন্দরবনের খালে মাছ মারা হয় কিনা তা তার জানা নেই বলে দাবি কয়েকজন দোকানির। কৃষি বিভাগ অনুমোদন দেওয়ার পরই এই কীটনাশক বিক্রি করেন বলেও জানান তারা।
জানা যায়, সুন্দরবনের ঢাংমারী, মরাপশুর, জোংড়া এবং ঝাপসি এলাকায় স্থানীয় কিছু লোকজন প্রতিনিয়ত বিষ দিয়ে মাছ ধরছে। এই বিষাক্ত পানি সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল থেকে ভাটার সময় নদীতে নেমে আসে। এ কারণে মরে যাওয়ায় এখন নদীতে আর ছোট-বড় মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।