কোরবানি দাতা নিজের কোরবানির পশু নিজেই জবেহ করবেন, যদি তিনি ভালভাবে জবেহ করতে পারেন। কেননা রাসূলুল্লাহ সা. নিজে জবেহ করেছেন। আর জবেহ করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম। তাই প্রত্যেকের নিজের কোরবানি নিজে জবেহ করার চেষ্টা করা উচিত।
ইমাম বোখারি রহ. বলেছেন : ‘সাহাবি আবু মুসা আশআরী রা. নিজের মেয়েদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন নিজ হাতে নিজেদের কোরবানির পশু জবেহ করেন।’ [ফাতহুল বারী ১০/২১] তার এ নির্দেশ দ্বারা প্রমাণিত হয় মেয়েরা কোরবানির পশু জবেহ করতে পারেন। তবে কোরবানি পশু জবেহ করার দায়িত্ব অন্যকে অর্পণ করা জায়েজ আছে। কেননা সহিহ মুসলিমের হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সা. তেষট্টিটি কোরবানির পশু নিজ হাতে জবেহ করে বাকিগুলো জবেহ করার দায়িত্ব আলী রা.-কে অর্পণ করেছেন। [মুসলিম- ১২১৮]
জবেহ করার সময় যে সকল বিষয় লক্ষণীয়
(১) যা জবেহ করা হবে তার সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে, তাকে আরাম দিতে হবে। যাতে সে কষ্ট না পায় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। হাদিসে এসেছে ,সাহাবি শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত যে নবী কারীম স. বলেছেন : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল বিষয়ে সকলের সাথে সুন্দর ও কল্যাণকর আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে তখন সুন্দরভাবে করবে আর যখন জবেহ করবে তখনও তা সুন্দরভাবে করবে। তোমাদের একজন যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং যা জবেহ করা হবে তাকে যেন প্রশান্তি দেয়। [মুসলিম-১৯৫৫]
(২) যদি উট জবেহ করতে হয় তবে তা নহর করবে। নহর হল উটটি তিন পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে আর সম্মুখের বাম পা বাধা থাকবে। তার বুকে ছুরি চালানো হবে। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন:‘সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় তাদের উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর।’ [সূরা হজ : ৩৬]
ইবনে আব্বাস রা. বলেন : এর অর্থ হল তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সামনের বাম পা বাধা থাকবে। [তাফসীর ইবনে কাসির]
উট ছাড়া অন্য জন্তু হলে তা তার বাম কাতে শোয়াবে। ডান হাত দিয়ে ছুরি চালাবে। বাম হাতে জন্তুর মাথা ধরে রাখবে। মোস্তাহাব হল জবেহকারী তার পা জন্তুটির ঘারে রাখবে। যেমন ইতিপূর্বে আনাস রা. বর্ণিত বোখারির হাদিসে আলোচনা করা হয়েছে।
(৩) জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন : ‘যার উপর আল্লাহর নাম (বিসমিল্লাহ) উচ্চারণ করা হয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর।’[সূরা আনআম : ১১৮] জবেহ করার সময় তাকবীর বলা মোস্তাহাব। যেমন হাদিসে এসেছে:—
জাবের রা. থেকে বর্ণিত … একটি দুম্বা আনা হল। রাসূলুল্লাহ স. নিজ হাতে জবেহ করলেন এবং বললেন ‘বিসমিল্লাহ ওয়া আল্লাহু আকবর, হে আল্লাহ ! এটা আমার পক্ষ থেকে। এবং আমার উম্মতের মাঝে যারা কোরবানি করতে পারেনি তাদের পক্ষ থেকে।’ অন্য হাদিসে এসেছে—
রাসূলুল্লাহ সা. দুটি শিংওয়ালা ভেড়া জবেহ করলেন, তখন বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বললেন। [সুনানে দারামী- ১৯৮৮] জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর পাঠের পর—اللّهُمَّ هَذَا مِنْكَ وَلَكَ—(হে আল্লাহ এটা তোমার তরফ থেকে, তোমারই জন্য) বলা যেতে পারে। যার পক্ষ থেকে কোরবানি করা হচ্ছে তার নাম উল্লেখ করে দোয়া করা জায়েজ আছে। এ ভাবে বলা—‘হে আল্লাহ তুমি অমুকের পক্ষ থেকে কবুল করে নাও।’ যেমন হাদিসে এসেছে আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. কোরবানির দুম্বা জবেহ করার সময় বললেন :—
‘আল্লাহ নামে, হে আল্লাহ ! আপনি মোহাম্মদ ও তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করে নিন।’ [মুসলিম- ১৯৬৭]
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে পশু জবেহ করা হারাম:
‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শুকর মাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে জবেহকৃত পশু আর শ্বাস রোধে মৃত জন্তু,শৃংগাঘাতে মৃত জন্তু এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া জন্তু ; তবে যা তোমরা জবেহ করতে পেরেছ তা ব্যতীত, আর যা মূর্তি পূজার বেদীর উপর বলি দেয়া হয় তা এবং জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করা, এ সব হল পাপ-কার্য…। [সূরা মায়িদাহ : ৩] ইবনে কাসীর রহ. বলেছেন যা কিছু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে জবেহ করা হয় তা যে হারাম এ ব্যাপারে মুসলিমদের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত।
সালমান রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : এক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে একটি মাছির কারণে। অন্য এক ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে একটি মাছির কারণে। এ কথা শুনার পর লোকেরা জিজ্ঞেস করল এটা কীভাবে হবে ? তিন বললেন : দু ব্যক্তি এক সম্প্রদায়ের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। সে সম্প্রদায়ের নিয়ম হল যে ব্যক্তি তাদের কাছ দিয়ে যাবে তাকে তাদের প্রতিমার উদ্দেশ্যে কিছু উৎসর্গ করতে হবে। সে সম্প্রদায়ের লোকেরা এ দুজনের একজনকে বলল : আমাদের এ প্রতিমার জন্য কিছু উৎসর্গ কর ! লোকটি উত্তর দিল আমার কাছে তো এমন কিছু নেই যা আমি এ প্রতিমার জন্য উৎসর্গ করতে পারি। তারা বলল একটি মাছি হলেও উৎসর্গ কর। সে একটি মাছি উৎসর্গ করল। তারা তাকে ছেড়ে দিল। ফলে সে জাহান্নামে যাবে।তারপর তারা দ্বিতীয় ব্যক্তিকে অনুরূপ কথা বলল। সে উত্তরে বলল আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য কিছু উৎসর্গ করি না। তারা তাকে হত্যা করল। ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করল।
বর্ণিত এ হাদিস থেকে আমারা কয়েকটি শিক্ষা লাভ করতে পারি
- শিরক কত বড় মারাত্মক অপরাধ তা অনুধাবন করা যায়। যদি তা খুব সামান্য বিষয়েও হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘যে আল্লাহর সাথে শরিক করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবশ্যই নিষিদ্ধ করবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম। জালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।’ [সূরা মায়েদা : ৭২]
- যে লোকটি জাহান্নামে গেল সে কিন্তু উক্ত কাজ করতে ইচ্ছুক ছিল না। কিন্তু সে মুশরিকদের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য কাজটি করেছিল।
- যে লোকটি জাহান্নামে গেল সে মুসলিম ছিল, কিন্তু সামান্য বিষয়ে শিরক করার কারণে জাহান্নামে গেল।
- তাওহীদ ও এখলাসের ফজিলত কত বেশি তা অনুধাবন করা যায়।
- যে লোকটি জান্নাতে প্রবেশ করল সে তাওহীদের জন্য নির্যাতন সহ্য করল, নিহত হল তবু শিরকের সাথে আপোশ করল না।
সূত্র : কোরআনের আলো