ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা):
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের শুধুমাত্র সাতক্ষীরা রেঞ্জের ৪০২টি স্টেশনে গাছ বা খুঁটির সঙ্গে আট শতাধিক ক্যামেরা বসিয়ে সুন্দরবনের প্রকৃতির পাহারাদার রয়েল বেঙ্গল টাইগার গণনার কাজ শেষ হয়েছে। তবে এর পূণাঙ্গ রিপোর্ট পাওয়া যাবে চলতি সেপ্টেম্বর মাসে। এর শুরু হবে সুন্দরবনের খুলনা, শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনার কাজ। সবমিলে গোটা সুন্দরবনে বাঘ গণনার কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আরো দু’বছর। তবে গত চার দশকে সুন্দরবনে বাঘ গণনা পরবর্তী মনিটরিংয়ের কার্যক্রম এই প্রথম। আর এবার বাঘের সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাবে। সেই সাথে সুন্দরবনে বাঘের হৃস-বৃদ্ধি, চলাচলের ঘণত্ব এবং জীবনাচরণের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। এমন দাবি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
এদিকে বনবিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৫ সালের পরিসংখ্যানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। বনবিভাগসহ প্রশাসনের নজরদারিতে গত দুই বছরে সুন্দরবনে কোনও বাঘ হত্যা বা শিকারের ঘটনা ঘটেনি। সুন্দরবনে টহলকালে বাঘ ও বাঘের বাচ্চা ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। তাতে প্রমাণ হয় বাঘের সংখ্যা বাড়ছে।’
গত মাসের মধ্যে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে মাছ শিকার শেষে ফিরে আসা জেলেরা জানিয়েছে, সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বাঘের বিচরণ দেখা যাচ্ছে। কয়রা এলাকার এক জেলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২৩ জুলাই সুন্দরবনে মাছ ধরাকালীন সময় বাঘ জেলেদের উপর আক্রমণ করলে জেলেরা কৌশলে বাঘের হাত থেকে রক্ষা পায়। তাছাড়া অনেক জায়গায় বাঘ ও শাবকের দেখা মিলছে বলে জানিয়েছেন জেলেরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে বাঘ গণনার কাজ মার্চ মাসে শেষ হয়েছে। গত বছরের ১ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা রেঞ্জে থেকে এ পদ্ধতিতে সুন্দরবনে বাঘ পরিবীক্ষণ (গণনা) শুরু হয়। সুন্দরবনের শুধুমাত্র সাতক্ষীরা রেঞ্জের ৪০২টি স্টেশনে গাছ বা খুঁটির সঙ্গে ৮০৪টি ক্যামেরা বসিয়ে সুন্দরবনের প্রকৃতির পাহারাদার রয়েল বেঙ্গল টাইগার গণনার কাজ করা হয়। বাঘ মনিটরিং সার্ভে প্রকল্পের পরিচালক ও খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক আমির হোসেন চৌধুরী এগ্রিনিউজকে বলেন, ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে ছবি তোলার কাজ শেষ হয়েছে। এখন তা ল্যাবে সফটওয়ারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এ্যানালাইসিস করা হচ্ছে।
দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এসব ছবি পর্যালোচনা করছেন। এর মাধ্যমে সাতক্ষীরা রেঞ্জে বাঘের বিচরণ ও ঘণত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে। তবে খুলনা, শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে সার্ভে কাজ সম্পন্ন হলে গোটা সুন্দরবনে বাঘের মোট সংখ্যা জানা সম্ভব হবে। এ কাজ শেষ করতে আরো প্রায় দু’বছর সময় লাগবে।
বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সূত্র জানান, প্রথম দফায় সুন্দরবনের ২৬ শতাংশ এলাকায় ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে বাঘ শুমারি করা হয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় দফায় গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে সাতক্ষীরা রেঞ্জের দক্ষিণ দিকে থেকে বনের ৫০ শতাংশ এলাকায় ক্যামেরা স্থাপন করে এবারের গণনা কার্যক্রম চালানো হয়। এর আগে যেসব এলাকায় বাঘের উপস্থিতি বেশি এমন এলাকাগুলো বেছে নেওয়া হয়েছিল। ইউএসএইডের অর্থায়নে বাঘ প্রকল্পের অধীনে ডিসেম্বর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত সাতক্ষীরা রেঞ্জে বাঘ গণনা করা হয়। সূত্রটি জানান, ৮ সদস্য বিশিষ্ট ৬টি টিমের ৪৫ জন সদস্য বাঘ গণনার কাজ করে। ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের পাশাপাশি খাল সার্ভের মাধ্যমেও বাঘ গণনা করা হয়েছে। এখন তা পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। এই কাজে সহযোগিতা করবে বন্যপ্রাণী বিষয়ক বেসরকারি সংস্থা ওয়াইল্ড টিম।
যেভাবে কাজ করে ক্যামেরা ট্রাপিং: ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে কোনও মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্যপ্রাণিদের ছবি পাওয়া যায়। বন্যপ্রাণি চলাচলের রাস্তায় দীর্ঘ মেয়াদের ব্যাটারিচালিত ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। এরপর মানুষহীন এ ক্যামেরার সামনে যে কোন নড়াচড়া হলেই উঠতে থাকে একের পর এক ছবি। এভাবে গবেষকরা পেয়েছেন দিন বা রাতের আঁধারে লুকিয়ে থাকা বন্যপ্রাণীদের চারিত্রিক বৈশিষ্টসহ নতুন সব তথ্য।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. সাইদ আলী জানান, সুন্দরবনের শুধুমাত্র সাতক্ষীরা রেঞ্জের ৪০২টি স্টেশনে ৮০৪টি ক্যামেরা বসিয়ে বাঘের ছবি তোলা হয়। প্রতিটি ক্যামেরা ৫/১০ সেকেন্ড পর পর একটি করে ছবি তোলে। ছবির ডোরাকাটা পর্যালোচনা করে বাঘের সংখ্যা নিরুপণ করা হবে।
সুন্দরবন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ২০১৩ সালের নভেম্বরে সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে বাঘ গণনা শুরু হয়েছিল। সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে গাছ বা খুঁটির সঙ্গে ৯০টি ক্যামেরা বসিয়ে ওই গণনার কাজ করেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৩০ জন কর্মী। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে শেষ হয় গণনার কাজ। ওই শুমারি অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৬টিতে।
গত চার দশকে সুন্দরবনে বাঘ গণনা পরবর্তী মনিটরিংয়ের কার্যক্রম এই প্রথম। ২০১০ সালের বাঘ সম্মেলনের ঘোষণার সুপারিশ অনুযায়ী গত ডিসেম্বর থেকে ইউএসএইড’র বাঘ অ্যাকটিভিটি প্রকল্পের অর্থায়নে এই সার্ভে শুরু করে বনবিভাগ। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের ২৭৭টি গ্রীড পয়েন্ট চিহ্নিত করে প্রতি পয়েন্টে দুটি করে অত্যাধুনিক ক্যামেরা বসানো হয়। বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে টানা ৪৫ দিন বাঘের ছবি ধারণ করা হয়। বন কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে বাঘের বাড়া-কমার সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করা যাবে। ছবিগুলো পর্যালোচনা করে ৩০ জুনের মধ্যে সার্ভের চূড়ান্তভাবে ফল প্রকাশ করার কথা রয়েছে।
উল্লেখ্য, বনবিভাগের তথ্যানুযায়ী সুন্দরবনে ১৯৮২ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৫৩টি, ২০০৪ সালে ৪৪০ এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালের শুমারিতে পাওয়া যায় ১০৬টি।