ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা):
খুলনা মহানগরীতে প্রায় শতভাগ পায়খানা ব্যবহারের পরও শুধুমাত্র মল ব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে থাকার কারণে খোলা স্থানে মল ত্যাগ করার মতোই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। যে কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে খুলনাবাসী। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির অধীনে পরিচালিত ফরমেটিভ রিসার্চ ও বেইজলাইন সমীক্ষায় খুলনা শহরের মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার বর্তমান পরিস্থিতি খুব একটা সন্তোষজনক নয়- বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ এবং খুলনা নগরবাসীকে নিয়মিত নিরাপদ সেপটিক ট্যাংক ও পিট পরিষ্কারে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে আজ মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) থেকে নগরীতে দু’ মাসব্যাপী প্রচারাভিযান কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। এ উপলক্ষে সোমবার দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-এ বছরে অন্তত একবার সেপটিক ট্যাংক খালি করার কথা বলা হলেও এ তথ্য বেশিরভাগ নগরবাসী জানেন না। ৫২ শতাংশ সেপটিক ট্যাংক বা পিট কখনো খালি হয়নি বা মালিকগণ জানেন না কখনো সেপটিক ট্যাংক খালি হয়েছিল কিনা।
অন্যদিকে যে ৪৮ শতাংশ সেপটিক ট্যাংক খালি হয়েছে সেগুলো ১১ শতাংশ তিন বছরেরও বেশি সময় আগে খালি হয়েছে। দু’ থেকে তিন বছরের মধ্যে খালি হয়েছে ১৪ শতাংশ। ২৪ শতাংশ সেপটিক ট্যাংক বা পিট এক বছরের মধ্যে খালি হলেও পরবর্তী কবে খালি হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। একদিকে সেপটিক ট্যাংক খালি করা যেমন কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, অন্যদিকে এ কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দও কম থাকে। কোথা থেকে সেবা পাওয়া যায়, সেবা পেতে কতদিন লাগে বা কত টাকা লাগে এ বিষয়ে অনেকেই কম জানেন। শহরের যে ৪৮ শতাংশ সেপটিক ট্যাংক বা পিট একবার খালি করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ৮১ শতাংশ মানববর্জ্য পরিষ্কারকর্মীদের (শহর সেবক) দ্বারা হাতের কাজের মাধ্যমে খালি করা হয়েছে- যা অস্বাস্থ্যকর, পরিবেশ ও পরিবারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মানববর্জ্য পরিষ্কারকর্মী যারা হাতের মাধ্যমে সেপটিক ট্যাংক বা পিট খালি করেন তাদের অনেকেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেননা বা নিরাপত্তা উপকরণ ব্যবহারও করেন না। ১৭ শতাংশ সেবাগ্রহীতা উভয় পদ্ধতি যথা যান্ত্রিক এবং হাতের কাজের মাধ্যমে সেপটিক ট্যাংক বা পিট খালি করেছেন। ১ শতাংশ বাড়ির মালিক আবার নিজেই এ কাজ করে থাকেন এবং কখনো অপসারিত মল গর্ত করে মাটি চাপা দেন অথবা পার্শ্ববর্তী নর্দমায় ফেলে দেন। মাত্র ১ শতাংশ সেপটিক ট্যাংক যান্ত্রিক পদ্ধতিতে খালি করা হয়।
অপরদিকে, মল কোথায় অপসারণ করা হয় তা ৮১ শতাংশ পরিবার জানেন না। ৯ শতাংশ মনে করেন গর্ত করে মল ফেলে তা মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। বাকি ৪ শতাংশ জলাশয়ে অথবা খোলা জায়গায় ফেলা হয় বলে মনে করেন। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সেপটিক ট্যাংক খালি করা যেমন জরুরি তেমনি তা নিরাপদভাবে অপসারণ করাও জরুরি।
সমীক্ষায় দেখা যায়, খুলনা শহরের ৫৪ শতাংশ স্কুলের সেপটিক ট্যাংক কখনো খালি করা হয়নি। জরিপে মাত্র ১২টি স্কুল পাওয়া গেছে যারা তাদেও সেপটিক ট্যাংক ১ বছরের মধ্যে খালি করেছে। সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, খুলনা শহরে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫টি ভ্যাকুট্যাগ রয়েছে। বড় দু’টি যথাক্রমে ৭ হাজার ও ৫ হাজার লিটার এবং ছোট ৩টির প্রতিটি ১ হাজার লিটার বর্জ্য ধারণের ক্ষমতা রয়েছে। হোল্ডিং মালিকগণ কেসিসি কর্তৃপক্ষ বরাবর যোগাযোগ করলে ভ্যাকুট্যাগের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সেপটিক ট্যাংক খালি করা হয়। সুষ্ঠু ও দ্রুত নগরবাসীকে মানববর্জ্য বিষয়ক সেবা দেয়ার জন্য জিআইএসভিত্তিক ডাটাবেজ ও অনলাইন সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিগত প্রায় চার বছরে মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরে বলা হয়, আচরণ পরিবর্তন যোগাযোগ কৌশলপত্র তৈরি, ভ্যাকুটাগ সেবা উন্নয়নে বিভিন্ন বিজনেস মডেল প্রণয়ন, মানববর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ, মোবাইল ট্রান্সফার স্টেশন কাম ভ্যাকুটাগ তৈরি, পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিষয়ে খুলনা শহরের সেবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, স্বল্প আয়ের সেনিটেশন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত পেশাজীবীদের জন্য ঘূর্ণায়মাণ তহবিল গঠন, কৃষি ও মৎস চাষে কো-কম্পোস্ট ব্যবহারের ওপর গবেষণা কার্যক্রম, সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারে সেবামূল্য প্রদানে আগ্রহের সম্ভাব্যতা যাচাই, বিদ্যমান পাবলিক টয়লেটের ওপর সমীক্ষা ও প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়েছে।
এছাড়া মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ১০ নং ওয়ার্ডে স্বল্প আয়ের জনসাধারণের জন্য অল্প খরচে স্যানিটেশন পদ্ধতি স্থাপনের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ জন মাস্টার্স ছাত্র-ছাত্রীকে মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা করার জন্য বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। এসব কাজের সফলতার ওপর ভিত্তি করে দাতা সংস্থা খুলনা শহরকে মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি মডেল টাউন হিসেবে তৈরি করার জন্য পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরের জন্য খুলনা অনুকরণীয় হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সংবাদ সম্মেলনে কেসিসির প্যানেল মেয়র রুমা খাতুন, কাউন্সিলর কেএম হুমায়ুন কবীর, মো. ফারুক হিল্টন, শেখ ইউনুস আলী সরদার, সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর সাহিদা বেগম, খুলনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সুবীর রায়, নাগরিক নেতা মিনা আজিজুর রহমান, সিডিসি টাউন ফেডারেশনের সভাপতি রোকেয়া রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।