ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা):
হাঁস পা ওয়ালা ‘তক্ষক’ নামের প্রাণি খোঁজেন। দেড়শ গ্রাম হলে বিক্রি করা যাবে ‘হাজার কোটি’ টাকা। শুধু ‘পকেট মানিই’ দেবে দুইশ কোটি টাকা। এটা হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত। দেশের যেখানেই থাকুক না কেন সেখানই বায়ার (ক্রেতা) যাবে। হেলিকপ্টারে গিয়ে নিয়ে আসা হবে’।
স্থানীয় এক চায়ের দোকানে বসে এমনটিই গল্প করছিলেন একজন আরেক জনের সাথে। অপরিচিত ওই দুই ব্যক্তির কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে এ বিষয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় অনেক অজানা তথ্য। তারা একটি প্রাণির কথা বলছিলেন। প্রাণিটির নাম ‘তক্ষক’। দেখতে গুই সাপের বাচ্চার মতো। গায়ে লাল সিঁদুরের ও সাদা ফোঁটার মতো রয়েছে। আকারে ছোট। তবে ছোট হলেও অনেক বয়সী। এই প্রাণিটি চড়ামূল্যে বিক্রি হয়। তাই অনেকেই এটির সন্ধানে ঘুরে ঘুরে নিঃস্ব হতে বসেছেন। তবু তারা হতাশ নন; খুঁজেই চলছেন। যেখানে একটু সন্ধান পাচ্ছেন, সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন।
তাদের মতে, তক্ষক নামের এই প্রাণির দুই ধরনের পা রয়েছে। কোনটার ‘মুরগী পা’ আর কোনটা দেখতে ‘হাঁস পা’ এর মতো। ‘হাঁস পা’গুলোর দাম খুব বেশি। তবে এক্ষেত্রে সাইজ হতে হবে সর্বনি¤œ সাড়ে ৯ ইঞ্চি লম্বা এবং ওজন হতে হবে ৫২ গ্রাম, সাইজ এবং ওজন এর কম হলে চলবে না। ইঞ্চির মাপ ধরা হয় চোখ থেকে লেজের শেষ পর্যন্ত। ‘মুরগি পা’ ওয়ালা তক্ষকের ওজন হতে হবে ২৫৫ গ্রাম এবং সাড়ে ১৫ ইঞ্চি লম্বা হতে হবে। এছাড়াও তক্ষকের আরো একটা জাত আছে নাম- ‘বার্মিজ’। ‘বার্মিজটা’ ওজন সাড়ে তিনশ গ্রামের নিচে হলে বিক্রির অনুপযুক্ত।
খুলনা বিভাগীয় (পশ্চিম) বন কর্মকর্তা বশির আল মামুন এগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, এটি সরিসৃপ জাতীয় প্রাণি। এরা নিশাচর। গাছের গর্তে বাস করে। বিভিন্ন পোকামাকড়, পাখির ডিম খেয়ে এরা বেঁচে থাকে। সাউথ ইস্ট এশিয়ায় অনেকেই পোষা প্রাণির মতো তক্ষক লালন করে বলে শোনা যায়। তারা মনে করেন, এই প্রাণি বাড়িতে থাকলে তাদের সৌভাগ্য বয়ে আনে। নিঃসন্তানদের সন্তানাদি হয়। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত কিছু কিছু দ্বীপাঞ্চলে এই প্রাণি রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, তক্ষকের বিষয়টি আমরা এখনো পরিষ্কার হতে পারিনি। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে জানা গেছে, পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে এই প্রাণি চড়ামূল্যে বিক্রি হয়। তক্ষকের ওষুধি গুণ রয়েছে বলে শোনা যায়। কোনো কোনো দেশে এটি দিয়ে ওষুধ তৈরি করে থাকতে পারে।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, ভারত ও বাংলাদেশসহ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্পুচিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির তক্ষকের বাস।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই প্রাণি বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দরদাম হয় দুইভাবে। একটা থোক, আরেকটা স্ক্যান করে প্রাণির শরীরে থাকা ‘দানা’ হিসেব করে। তবে বেশিরভাগ বিক্রেতা স্ক্যানের বিপক্ষে। তারা থোক দরদাম করেন।
তক্ষক দিয়ে কী করা হয়, জানতে চাইলে কেউ বলেন- প্রাণিটা পুরো গলিয়ে ক্যান্সারসহ দূরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ তৈরি করা হয়। এই প্রাণি কাউকে কামড় দেওয়ার পর তার ঘাঁ শুকিয়ে গেলে ওই ব্যক্তির শরীওে কোনো ধরনের রোগ-জীবাণু থাকবে না। আবার কেউ কেউ বলেন, এটার শরীরে থাকা দানা এক করে ড্রোন তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কেউ নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি।
এই প্রাণির সন্ধানে ঘোরা মানুষদের সঙ্গে আরেক শ্রেণির মানুষ প্রতারণা করছেন। জেলার তেরখাদা উপজেলার আলমগীর নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি অধিক লাভবান হওয়ার জন্য এর পিছনে অনেক টাকা খরচ করেছেন। পিরোজপুরের নাজিরপুরে একটা কিনতে গিয়ে ৫ লাখ টাকা ধরা খেয়েছেন। তারা যেটা দেখিয়েছিল বাক্সে দেওয়ার সময় আরেকটা দিয়ে দেওয়া হয়। বাসায় এসে দেখেন যেটা দিয়েছে তা অনেক ছোট। তিনি জানান, তার দুটি গাড়ি ছিল। এর পিছনে ঘুরে গাড়ি দুটিও বিক্রি করে দিতে হয়েছে।
একই এলাকার ইলিয়াচ জানান, তিনি চট্টগ্রাম থেকে চারটি তক্ষক ধরে এনেছিলেন। বিক্রির জন্য তার এক পরিচিত লোকের কাছে দিয়েছিলেন। সে তাকে মাত্র ৬০ হাজার টাকা দেয়। এর দাম অনেক শুনে তিনি পরে আবার রাঙ্গামাটি যান এই প্রাণির সন্ধানে। সেখানে যাওয়ার পর ওখানকার সিন্ডিকেটের লোকজন তাকে ধরে মারধর করে। তার টাকা পয়সা মোবাইল সবকিছু রেখে দেয়। বেঁচে ফিরতে পেরেছেন তাই আল¬াহর কাছে হাজার শুকরিয়া।
এ সম্পর্কে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালিন সহকারী কমিশনার (ডিবি) কনক কুমার দাস জানান, গত বছরের মে মসে খুলনার খালিশপুর থানা এলাকার নেভী চেক পোস্টের রেল কলোনীর একটি বাসা থেকে একটি তক্ষক সাপসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মো. রুহুল আমিন ওরফে কাজল (৪০), মো. ইদ্রিস আলী (৩৪), মো. শাহজাহান ওরফে সাজু (৬২) ও মো. ফজলু সরদারের (৩২)। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে খালিশপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এছাড়াও আটককৃত তক্ষক সাপটি সুন্দরবনের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের কাছে হস্থান্তর করা হলে সংরক্ষণ বিভাগ তক্ষক সাপটিকে সন্দরবনের গহীনে অবমুক্ত করেন।
অপর একটি সূত্র জানায়, তক্ষক সাপের দুটি জাতের মধ্যে ‘হাঁস পা’য়ের দাম বেশি শুনে কেউ কেউ আবার সার্জারি করে ‘হাঁস পা’ লাগিয়ে নেয়। বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার জিহির নামের এক ব্যক্তি সার্জারিতে পারদর্শী। তিনি বাদুরের ডানা দিয়ে সার্জারি করেন। তাই প্রতারণার জন্য অনেকে নাকি তার কাছে ধরনা দেন। তবে বায়ারের ক্যামিস্টরাও এক্ষেত্রে সতর্ক। তারা এটা ধওে ফেলতে পারেন।
গারা দেশেই এখন এই প্রাণিটি বেচাকেনার সিন্ডিকেট আছে। ঢাকা থেকে যারা কিনতে জেলা শহরে আসেন তারা প্রথমে ঐ জেলা শহরের সিন্ডিকেটের কাছে প্রাণির ছবি চান। পরে সদ্য করা ভিডিও। এটা কোনো পত্রিকার উপওে ডেটলাইনের পাশে রেখে করতে হয়। এই ভিডিও বিশ্নেষণ করার পর ঢাকা থেকে প্রকৃত ক্রেতা আসেন।
সম্প্রতি ডুমুরিয়ায় ২২ ইঞ্চি লম্বা এই তক্ষকের সন্ধান পাওয়া এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানান, আমরা সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল থেকে প্রাণিটা সংগ্রহ করেছি। এই প্রাণিটির ক্রেতা দুইদিন নগরীর হোটেলে অবস্থান করেন। বিক্রেতারা প্রাণিটা দেখার জন্য তাদের গ্রামে আসতে বলেন। কিন্তু ক্রেতারা ঐ এলাকায় যেয়ে প্রাণিটা দেখার চেয়ে প্রাণিটিকে আনতে বলায় আমাদের প্রতি বিশ্বাস না হওয়ায় কারণে তারা সেটি দেখায়নি। তবে আমরা যাওয়ার আগে তারা ভিডিও পাঠিয়েছিল।
আপনার কি এখনো পর্যন্ত দুই-একটা বিক্রি করতে পেরেছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কিনতেও পারিনি, বিক্রিও করতে পারিনি। মূলত এই ব্যবসায় যারা জড়িত তারা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এ কারণেই কেনাবেচা হয় না। হয় প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে, না হয় না খেতে পেরে প্রাণিটি মারা যায়। এই ব্যক্তি ১২ বছর ধরে এর পিছনে ছুটছেন।
আর কতদিন ঘুরবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখি! আশা করি আজ হোক, কাল হোক ব্যাটে-বলে মিলবে। তাকে প্রশ্ন করা হয়, ধরেন তক্ষক বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা পেলেন। কিন্তু টাকার লেনদেন কীভাবে করবেন। জবাবে তিনি জানান, আমরাতো অনেক লোক। ইউরো নেবো। তাছাড়া অন্য ব্যবস্থাও করা যাবে। এতো টাকা পেলে কী করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি একটা টেলিভিশন চ্যানেল করবো’। এমন অনেক আশা নিয়ে ঘুরছে এই সিন্ডিকেটের লোকজন। কিন্তু আদৌ তাদের আশা পূরণ হবে কী না, তা কেউই জানে না।