কৃষিবিদ ড. এমএ মজিদ মন্ডল:
কলা পৃথিবীর সব দেশে হয় এবং সারা বছর ফসল পাওয়া যায়। বাংলাদশসহ পৃথিবীর সব স্থানে কলা অন্যতম প্রধান ফসল হিসেবে বিবেচিত। এটি অতি খাদ্যমান সমৃদ্ধ জনপ্রিয়, সস্তা ও সুস্বাদু ফল। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার জমিতে কলা চাষ হয় এবং উক্ত জমি থেকে উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ মেট্টিক টন, যা বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত ফলের প্রায় ৪২ শতাংশ। দেশে ফল উৎপাদনের দিক থেকে বিবেচনা করলে কলার স্থান প্রথম কিন্তু উৎপাদনের জমির পরিমাণ বিবেচনা করলে এর স্থান দিতৃীয়। বিশ্বে ফল বাণিজ্যে কলার স্থান দ্বিতীয় (লেবুজাতীয় ফলের পরে কলার স্থান)। বাংলাদেশের কৃষক কলা চাষ করতে যেসব রোগ ও পোকার কারণে বাঁধার মুখমখি হচ্ছেন তার প্রধান দিকগুলি ও তার সমাধান এখানে আলোচনা করা হল। বাংলাদেশে যেসব কারণে কলা চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার মধ্যে শতকরা ৮০-৯০ শতাংশ ক্ষতি হয় পানামা ও সিগাটোগা রোগ এবং পাতা ও ফল বিটল দ্বারা। তাই নিম্নে কলার উল্লেখিত রোগ ও পোকা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
পানামা
এই রোগ কলার চাষিদের জন্য মারাত্মক এক সমস্যা। কারণ এ রোগের কারণে কলার উৎপাদন শুণ্যের কাছাকাছি নেমে যেতে পারে। এ রোগ (Esarium oxysporum cubense) নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
রোগের অনূকুল অবস্থা
ক. পূর্বের ফসলে রোগ থাকলে বা রোগাক্রান্ত গাছ থেকে চারা সংগ্র করলে পরে বছর আবার হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
খ. চারা রোপনের সময় বয়স কম হলে।
গ. নিন্নমানের নিষ্কাশিত মাটি হলে।
ঘ. অধিক আগাছা ও ঘাস হলে।
ঙ. আন্তঃ পরিচর্যার অভাব।
লক্ষণসমূহ
১. পুরাতন পাতায় হলুদ বর্ণের দাগ দেখা যায়।
২. পুরাতন পাতা ক্রমান্বয়ে সমস্ত অংশ হলুদ হয়ে যায়। পাতার কিনারা ফেটে যায় ও বোটা ফেটে যায়। লিফব্লেট (পাতা) ঝুলে পড়ে ও শুকে যায়।
৩. দুই-তিন দিনের মধ্যে গাছের সমস্ত পাতা ঝুলে পড়ে (মধ্যের মাইজ বা হার্ট লিফ ছাড়া)।
৪. কলাগাছের গোড়া মাটির লেভেলের কাছাকাছি লম্বালম্বি ফেটে যায়।
৫. আক্রান্ত গাছ থেকে অস্বাভাবিক থোড় বের হয়।
৬. আক্রান্ত গাছ ও রাইজোম এর ভেতর কালচে বর্ণের দেখা যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা
১. রোগমুক্ত মাঠ খেকে সাকার সংগ্র করতে হবে।
২. মাঠ থেকে রোগাক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে পুুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৩. রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
৪. রোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয় এমন ফসল, যেমন- বেগুন, টমেটো, ঢেড়স প্রভৃতির সাথে কলা চাষ না করা।
৫. একই জমিতে ২-৩ বছর পর ফসল বদল করে শস্য পর্য়ায় অলম্বন করা।
৬. চুন প্রয়োগ করে মাটির পিএইচ বৃদ্ধি করা।
৭. ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা। যেমন – ফুরাডন ৫ জি প্রতি গাছে ৫ গ্রাম হারে (১.৫ কেজি/ একর) প্রয়োগ করতে হবে।
সিগাটোগা
এ রোগের কারণ হলো সারকোসপোরা মুছি (Cercospora musae) নামক এক প্রকার ছত্রাক।
রোগের অনূকূল অবস্থা
ক. পূর্বের ফসলে রোগ থাকলে পরে বছর আবার হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
খ. গাছে বেশি পাতা হলে এবং মাটি থেকে প্রথম পাতার দূরত্ব কম হলে।
গ. নিম্নমানের নিষ্কাশিত মাটি হলে।
ঘ. বাগানে অধিক আগাছা ও ঘাস হলে এ রোগ হয়ে থাকে।
লক্ষণসমুহ
১. সবচেয়ে নিচের পাতার কিনারায় সমান্তরালভাবে হালকা-বাদামী থেকে হলুদ বর্ণের দাগ দেখা যায় এবং দাগগুলো পানি ভেজা মনে হয়।
২. দাগগুলো আকারে বৃদ্ধি পায় এবং স্পিন্ডিল আকার ধারন করে, যার কেন্দ্রস্থল ধুসর থেকে বাদামী বর্ণের হয়।
৩. রোগের অগ্রগতি অবস্থায় অনেকগুলো দাগ একত্রে বড় আকারে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং পাতার কিনারা শুকাতে শুরু করে।
৪. রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করলে গাছ ছোট ছোট সাকার উৎপাদন করে।
দমন পদ্ধতি
১. রোগাক্রান্ত পাতা সংগ্র করে ধ্বংস করতে হবে।
২. বাগানের মাটি সুনিষ্কাশিত রাখতে হবে।
৩. যেসব শস্য রোগ বহন করে (যেমন- বেগুন, টমেটো প্রভৃতি) সেগুলো অপসারন করা।
৪. শস্য পর্যায় অবলম্বন করা।
৫. মুড়ি ফসল চাষ না করা।
৬. রোগাক্রান্ত হলে ফসলে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। যেমন- টিলর্ট ০.২% হারে বর্ষার পূর্বে একবার এবং পরে দুই বার সেপ্র করতে হবে।
লেখক : প্রভাষক কৃষি শিক্ষা বিভাগ, নাটোর সিটি কলেজ, নাটোর।