মো. খোরশেদ আলম জুয়েল : স্বাধীনতাত্তোর দেশে জনসংখ্যা যখন মাত্র ৭ কোটি ছিল তখন বাংলাদেশকে খাদ্যের জন্য বিশ্বের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। সময় গড়িয়েছে, জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, কমেছে আবাদি জমির পরিমাণ, বেড়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ -এত কিছুর পরও প্রায় পাঁচ দশক পর এসে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।
একটি প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবে এসে যায় তাহলে, কীভাবে সম্ভব হলো এটি? আবাদি জমির পরিমাণ কমে মানুষ যেখানে বেড়েছে সেখানে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সম্ভবটা হলো কীভাবে? সোজা কথায়, আগের তুলনায় একই পরিমাণ জমিতে উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। শুধু ফসল নয়, হাঁস-মুরগি থেকে গবাদিপশু সবকিছুর উৎপাদন বাড়ছে। সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন বাড়ার পেছনে আমাদের কৃষকদের যেমন রয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম, আন্তরিকতা এবং তরুন-তরুনীদের কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঠিক তেমনি রয়েছে দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাওয়া দেশীয় কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা ও উদ্ভাবন। পরিবেশের সাথে মানানসই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনশীল ও রোগ প্রতিরোধী বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন এবং ফসলের জাত ও চাষ কৌশলের উন্নয়নের ফলে এসব সম্ভব হয়েছে। তবে, দেশের কৃষিক্ষেত্রের গবেষণা আগে যেমন শুধু সরকারি গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ ছিল, বর্তমানে সেটি বেসরকারি পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। দেশের কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে নিজেরাই চেষ্টা করছেন নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের, গড়ে তুলেছেন আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার এবং সেক্ষেত্রে তারা সফলও হচ্ছেন। আজকে সে রকম-ই এক প্রতিষ্ঠানের গল্প শোনাবো আপনাদের।
এসিআই লিমিটেড। বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরে অত্যন্ত সুপরিচিত একটি নাম। প্রতিষ্ঠানটি শুধু গতানুগতিক কৃষি ব্যবসার সাথে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে জোর দিয়েছে গবেষণা কাজে। ঢাকার গুলশানে গড়ে তুলেছেন দ্যা এ্যাডভান্সড সীড রিসার্চ অ্যান্ড বায়োটেক সেন্টার (ASRBC) নামে একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার। গবেষণাগারটি মূল কাজ হলো এসিআই এগ্রিবিজনেস যেমন- এসিআই ফার্টিলাইজার, সীড, এনিমেল হেলথ, ক্রপ কেয়ার, সহ সকল ডিপার্টমেন্টকে সহায়তা করা। এছাড়াও রয়েছে প্রাণিসম্পদ যেমন- হাঁস, মুরগি, ভেড়া, গরু, ছাগল, কবুতর সহ অন্যান্য সৌখিন পাখির রোগ-বালাই, জাত ইত্যাদির সমস্যা সমাধান করা। তবে এএসআরবিসি শুধু নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের জন্যই কাজ করেনা বরং অন্য যে কেউ বা প্রতিষ্ঠানের জন্য তাদের সহায়তার দ্বার উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে মূলত কাজ করছেন দশজন বিজ্ঞানী, রয়েছেন তাঁদের সহযোগী। গবেষণাগারে কাজ করা এসব বিজ্ঞানীদের বেশিরভাগই বায়োটেকনোলজি এক্সপার্ট এবং কৃষিবিদ। এএসআরবিসি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সাথে পিপিপি’র প্রকল্পের আওতায় যৌথ গবেষণা কাজে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
গবেষণাগারটি সম্পর্কে এগ্রিনিউজ২৪.কম কে এসিআই ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এফএইচ আনসারি বলেন, এএসআরবিসি মূলত গড়ে তোলা হয়েছে এসিআই এগ্রিবিজনেসকে সহায়তা করার জন্য, যেটি দেশের কৃষি সেক্টরের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট একটি অবদান রাখতে চায়। এ চিন্তা থেকেই আমরা ২০১২ সনে এডভান্স মলিক্যুলার বায়োটেকনোলজি ল্যাবটি প্রতিষ্ঠা করি। গবেষণাগারটি প্রতিষ্ঠায় দেশের কৃষি গবেষণা ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখা প্রফেসর লুৎফর রহমান সরাসরি দায়িত্ব নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কাজের উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
ড. আনসারি আরো বলেন- মানুষ বাড়ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফসল ও প্রাণির রোগবালাই। কৃষিতে আসছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং পরিবেশের সাথে সহাবস্থানে থেকে এসিআই দেশের কৃষিতে অবদান রেখে চলেছে।
তিনি বলেন, দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০১৫ সনে ইরি’র (IRRI) সাথে এএসআরবিসি (ASRBC)’র একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় যেটির জন্য IRRI কে অর্থায়ন করেছে ইউএসএআইডি (USAID) যার মূল উদ্দেশ্যই হলো বেসরকারি সেক্টরে প্রতিষ্ঠিত ল্যাব ব্যবহার করে ধানের নতুন নতুন জাত সৃষ্টি করা এবং জাত সৃষ্টি কর্মযজ্ঞে উন্নত বৈশিষ্ট নির্বাচন করা। চুক্তিটি মূলত পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) এর আওতায়। এ চুক্তির আওতায় (এসিআই-ইরি-পিপিপি) এসিআই এবং ইরি’র বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে কাজ করছেন এবং অধিকন্তু গবেষণার প্রয়োজনে এসিএআই’র এক্ষেত্রে নিজস্ব আলাদা এক বিশাল বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। এছাড়াও আমরা হাইব্রিড রাইস ডেভেলপমেন্ট কনসোর্টিয়াম (HRDC) -এর সাথে গবেষণা কাজে শক্তিশালী একটি বন্ধন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।
ড. আনসারি বলেন, আমরা প্রথমেই কাজ শুরু করেছি জাত উন্নয়নে বীজ গবেষণা নিয়ে। মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা এবং আমদানি নির্ভরতা কমানো। কম সময়ে অধিক উৎপাদনশীল, তাপ, বন্যা, খরা, লবণ সহিষ্ণু ছাড়াও বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য। শুধু তাই নয়, এসিআই প্রাণিসম্পদ শাখাকে সহায়তা করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এসিআই এনিমেল হেলথ ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরী।
প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করা জ্যৈষ্ঠ্য বিজ্ঞানী (মলিকুলার ব্রিডিং) আদিবা রায়হান এগ্রিনিউজ২৪.কম কে জানান, ২০০৬ থেকে এসিআই হাইব্রিড জাত উন্নয়ন করা শুরু করে। এই ল্যাব থেকে আলু, গম, ধান, টমেটো, বেগুন, মুগডাল, পেপের জাত উন্নয়ন কর্মসূচির বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন ফসলের বীজের গুণাগুণ সম্পর্কিত টেস্ট করে এসিআই এগ্রিবিজনেসকে সার্ভিস প্রদান করার পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও সহায়তা করা হয়। যেমন- এসিআই বাজারজাতকৃত বীজে কোন রকম রোগ জীবাণু আছে কী না, সেগুলোর অংকুরোদগম ক্ষমতা ও হার কেমন হবে, হাইব্রিড জাত বলে চিহ্নিত জাতগুলো সত্যি হাইব্রিড হয়েছে কী না -এসব বিষয়গুলো ডিএনএ পরীক্ষা করার মাধ্যমে আমাদের ল্যাব থেকে নিশ্চিত করা হয়। এছাড়াও এসিআই উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাতগুলোর ‘প্যারেন্ট স্টক নির্বাচন’ হাইব্রিড হয়েছে কীনা সে বিষয়ে নিশ্চিতকরণ কাজগুলো এখান থেকে ডিএনএ বা মলিকুলার পর্যায়ে পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। শুধু এসিআই নয়, বীজের এ ধরনের গুণাগুণ ও রোগ নির্ণয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্যেও করে দেয়া সম্ভব।
এসিআই এনিমেল হেলথ ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ন্যাশনাল লাইভস্টক কনসালট্যান্ট ডা. নূরুল আমীন বলেন, গবেষণা, উন্নয়ন এবং প্রাণিসম্মদ খাতে নিয়োজিত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিসম্মদ খাতের উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখা আমাদের মূল লক্ষ্য। একই সাথে প্রাণিসম্পদ খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে দেশে একটি নজির স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসিআইকে সু-প্রতিষ্ঠিত হতে চায়।
ল্যাবরেটরীতে খামারিদের নিয়ে আসা হাঁস ও মোরগ-মুরগির ময়নাতদন্ত এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ও তদনুযায়ী ব্যবস্থাপত্র প্রদান, জীবাণু কালচার, এন্টিবায়োটিক সেনসিটিভিটি পরীক্ষা, রক্ত নমুনার এইচএ এবং এইচআই টাইটার পরীক্ষা, এগ ড্রপ সিনড্রোম, সিরাম প্লেট এগ্লুটিনেশন টেস্ট ও ইলাইজা পরীক্ষা, দ্রুত রোগ নির্ণয়ক অন্যান্য সিরাম পরীক্ষা, দুধের ক্যালিফোর্ণিয়া ম্যাস্টাইটিস টেষ্ট (সিএমটি), সকল ধরনের পশুপাখির মল পরীক্ষা, ব্লাড বায়োকেমিস্ট্রি এবং পশুপাখির রক্ত পরজীবী সনাক্তকরণ পরীক্ষা, দুধের জীবাণু পরীক্ষা, পানির জীবাণু পরীক্ষা, পানির রাসায়নিক ভৌত গুণাগুণ পরীক্ষা, মলিকুলার বায়োলজিক্যাল টেস্ট, পোলট্রির বিভিন্ন রোগ পরীক্ষা এবং শৌখিন পাখির লিঙ্গ সনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে গবাদিপশুর ক্ষুরারোগের টিকা পরবর্তী এন্টিবডির উপস্থিতি নির্ণয় করা হয় এই গবেষণাগার থেকে।
উল্লেখ্য, যে কোন ব্যাক্তি বা খামারি এসিআই এনিমেল হেলথ্ ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরীতে সরাসরি নিজেরা নমূনা প্রেরণ করতে এবং নির্র্দিষ্ট ফি প্রদান করে পরীক্ষা এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকের নিকট থেকে পরামর্শ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা পত্র নিতে পারবেন।