জনাব শাহ্ হাবিবুল হক। প্লানেট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন (বিপিএ) এর সহ–সভাপতি এবং জিবি মেম্বার, এফবিসিসিআই। ছিলেন উত্তরা ব্যাংকের পরিচালক এবং কার্যনির্বাহী সদস্য। মি. হক বাংলাদেশের পোলট্রি শিল্পে এক সুপরিচিত নাম। তিনি ১৯৭৩ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন এবং তারপর কর্মজীবন শুরু করেন ইসলাম গ্রুপ একজন বিজনেস এক্সিকিউটিভ হিসেবে। ইসলাম গ্রুপের কনস্ট্রাকশন বিভাগ দেখাশুনার জন্য ১৯৭৬ সনে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত যান; সেখান থেকে ১৯৯২ সনে দেশে ফিরে এসে ইসলাম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আফতাব বহুমূখী ফার্মস লি. নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, এনিমেল হেলথ প্রোডাক্টস এবং জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
২০১০ সনে তিনি ইসলাম গ্রুপ থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং একই বছর সম্পূর্ণ নিজস্ব মালিকানায় গড়ে তোলেন প্লানেট গ্রুপ। প্লানেট গ্রুপের রয়েছে ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি, ফিডমিল এবং প্রাণি স্বাস্থ্য সেবা ও পুষ্টি সংক্রান্ত পণ্য যা ইউরোপসহ বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন কোম্পানি থেকে আমদানি করে দেশে বাজারজাত করা হয়। গড়ে তুলেছেন প্লানেট ফার্মা লিমিটেড, প্লানেট এগ্রো লিমিটেড এবং প্লানেট ফিডস। তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং বিচক্ষণতায় প্লানেট গ্রুপ খুব অল্প সময়ে ইতোমধ্যে দেশের পোলট্রি শিল্পে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছ। জনাব শাহ্ হাবিবুল হক –এর সাথে পেশাগত জীবন, অভিজ্ঞতা, দেশের পোলট্রি শিল্পের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন এগ্রিনিউজ২৪.কম –এর সম্পাদক ও সিইও মো. খোরশেদ আলম জুয়েল । সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ সুপ্রিয় পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো–
এগ্রিনিউজ২৪.কম: পোলট্রি শিল্পে আপনার শুরুর গল্পটা বলুন।
শাহ্ হাবিবুল হক: পোলট্রি শিল্পে আমার পদার্পন মূলত ১৯৯২ সন থেকে আফতাব বহুমূখী ফার্মস লিমিটেড এর দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে। এক সময় সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করি এবং নিজেই স্বতন্ত্র পোলট্রি ফার্ম করার চিন্তা করি যার–ই ফল আজকের প্লানেট পোলট্রি, প্লানেট ফিডস এবং প্লানেট ফার্মা।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: প্রাথমিক অবস্থায় প্লানেট পোলট্রি লিমিটেড কীভাবে এবং কবে থেকে শুরু করেছিলেন?
শাহ্ হাবিবুল হক: ২০১৩ সনের অক্টোবর মাসে তিনটি সেড দিয়ে আমরা মুলত প্লানেট পোলট্রির কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু করি। প্রতিটি শেড দোতালা অর্থাৎ তিনটি শেডে ছয়টি ফ্লোর। এক বছর পরে অর্থাৎ ২০১৪ সনের ২৭ অক্টোবর শেডগুলোতে ৬০ হাজার পিএস (প্যারেন্ট স্টক) উত্তোলন করি। ২০১৫ সনের ২ জুন তারিখ আমরা আমাদের হ্যাচারি থেকে প্রথম ব্যাচের একদিন বয়সী বাচ্চা বাজারজাতকরণ শুরু করি। আমরা এখন পর্যন্ত প্যারেন্ট স্টক এর পরিমাণ বা ডে ওল্ড চিকস উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াইনি। তবে খুব শীঘ্রই আমরা এটিকে আরো সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে উৎপাদন আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করছি, এ বছরের শীতেই আমরা এ সংক্রান্ত কাজ শুরু করতে পারবো ইনশা–আল্লাহ।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: আপনি এনিমেল হেলথ্ প্রোডাক্টস নিয়ে কাজ করেছেন বহুদিন। আপনার প্রতিষ্ঠিত প্লানেট ফার্মা সম্পর্কে জানতে চাই?
শাহ্ হাবিবুল হক: ২০১০ সালে আমরা প্লানেট ফার্মা শুরু করি। এটা হচ্ছে এ্যানিমেল হেলথ প্রোডাক্টস। এসব পণ্য আমরা দেশের বাইরে থেকে আমদানী করি সম্পূর্ণ প্যাকেটকৃত অবস্থায় এবং ক্রেতার চাহিদা মাফিক সরাসারি সরবরাহ করি। আমাদের বেশিরভাগ প্রোডাক্ট আসে ইউরোপ –এর দেশসমূহ থেকে। তাদের মধ্যে ইতালি, হল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও কিছু প্রোডাক্ট আমদানি করে থাকি। আমাদের এসব আমদানিকৃত পণ্যগুলো বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের। বাংলাদেশের বাজারে আমরা মূলত এসব কোম্পানির সোল এজেন্ট হিসেবে কাজ করি এবং তাদের পণ্যগুলো বাজারজাত করে থাকি।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: প্লানেট ফিড সম্পর্কে বলুন –কী অবস্থা, কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
শাহ্ হাবিবুল হক: প্লানেট ফিড আমরা প্রথমে ছোট আকারে শুরু করি যার উৎপাদন ক্ষমতা আপাতত ঘণ্টায় ১০টন। বর্তমান মার্কেটে বড় বড় কোম্পানির তুলনায় হয়তো আমাদের বাজার সীমীত। তবে আমরা খুশি এ কারণে যে, মার্কেটে আমরা আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি। কারণ আমরা পণ্যের কোয়ালিটির (গুণগতমান) ক্ষেত্রে কোন আপোষ করতে চাইনা। আমরা প্রতিনিয়ত ট্রায়াল দিয়ে যাচ্ছি কি করে আমাদের তৈরি ফিড আরো মানসম্মত করা যায়। খামারিদের কাছে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করার চেষ্টায় আমাদের কোন কমতি নেই। ভালো পণ্য এবং সেবা দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। আমরা পোলট্রি এবং মাছের খাবার উৎপাদন এবং বাজারজাত করছি। খুব শীঘ্রই এটিকে আরো বিস্তৃত করার ইচ্ছে আছে আমাদের।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: আপনিতো দীর্ঘদিন ধরেই পোল্ট্রি শিল্পের সাথে জড়িত। এ শিল্পে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, হঠাৎ হঠাৎ দাম যেমন বেড়ে যায় আবার কমে যায়। আমাদের আমাদের বাজারের আকার ও বিনিয়োগ বেড়েছে প্রচুর কিন্তু টেকসই কোন জায়গায় পৌঁছতে পারেনি এখনো। শিল্পের সাথে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায়, এ ব্যাপার আপনার বক্তব্য কী?
শাহ্ হাবিবুল হক: আসলে এখানে অনেকগুলো ফ্যাক্টর জড়িত, যেমন– ডিমান্ড এবং সাপ্লাই এর একটা বড় ব্যাপার। আমাদের খামারিরা যখন বিনিয়োগে ঝুঁকেন তখন একসাথে ঝুঁকেন যে কারণে বিপর্যয়ও একসাথেই হয়। বাজারের স্বাভাবিক আচরনের মতো তখন বাচ্চার দাম বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে কিছু অসাধু ডিলার অতি মুনাফার সুযোগ নেয়। আবার বাচ্চার দাম কমে যাওয়াতে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল প্রেসার কাজ করে। যেহেতু একদিন বয়সী বাচ্চা এক ধরনের কাঁচামাল এবং এটিকে সংরক্ষণ করার উপায় নেই তখন আবার বাচ্চার দাম পড়ে যায়। আবহাওয়ার বিরূপ আচরণও ইদানিং একটা কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। বিশেষ করে এ বছরের বৈরি আবহাওয়া গত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হওয়ায় তা ব্যবসার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: এক্ষেত্রে সমাধান কি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
শাহ্ হাবিবুল হক: আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। জেনেবুঝে পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ করার মতো এখনো প্রচুর সুযোগ রয়েছে। এজন্য মানুষদেরকে আমাদের বুঝাতে হবে। পোলট্রি ডিম ও মাংসের ব্যাপারে নেতিবাচক এবং ভ্রান্ত ধারনা দূর করতে হবে। মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। অপপ্রচারের জওয়াব তথ্যভিত্তিক এবং যৌক্তিতভাবে মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসাথে কাজ করতে হবে।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: বিশ্ব বাজারে এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছে। তাছাড়া আমাদের বড় বড় উদ্যোক্তারা চিন্তা করছেন খুব শীঘ্রই পোলট্রিজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দেয়ার। কিন্তু এসবের জন্য নিরাপদ এন্টিবায়োটিক ফ্রি চিকেন একটি বড় ফ্যাক্টর। এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করে আমরা কিভাবে নিরাপদ মুরগী পেতে পারি?
শাহ্ হাবিবুল হক: আমি একেবারেই এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের পক্ষে না। কারণ, বর্তমানে যেখানে একটা মুরগী মাত্র ২৮ দিনে বা সর্বোচ্চ ৩০দিনে ১৮০০ গ্রাম ওজন হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে গ্রোথ প্রমোটর হিসেবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করার কোন দরকার আছে বলে আমি একদমই মনে করি না। আমরা যদি সঠিক ব্যবস্থাপনা ও বায়োসিকিউরিটি মেইনটেইন করতে পারি তবে ওষুধ খরচ এবং এন্টিবায়োটিক খরচও কমে যাবে। এই মুরগীগুলো কিন্তু আমরাও খাই, আমাদের ছেলে–মেয়েরা খাচ্ছে। সুতরাং জেনেশুনে কোন কোম্পানীই চাইবে না তাদের এতো বড় ক্ষতি হোক।
দেশের স্বনামধন্য কোম্পানিগুলো তাদের ব্রিডার ফার্মের মুরগীর জন্য এমনকি কমার্শিয়াল ও লেয়ার বার্ডের জন্য খুবই উচ্চমানের বায়োসিকিউরিটি মেইনটেইন করেন। সেখানে কোনো এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করার প্রয়োজন নাই।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: কিন্তু ছোট বা মাঝারি খামারিদের পক্ষেতো এত হাই সিকিউরড বায়োসিকিউরিটি মেইনটেইন করা সহজ নয়, সেক্ষেত্রে তাদের জন্য আপনার পরার্মশ কী?
শাহ্ হাবিবুল হক: আমাদের দেশে এখন খুবই উন্নত কোয়ালিটির ফিড তৈরি হচ্ছে যা জাপান, মালেয়েশিয়া, আমেরিকার মত দেশের ফিডের গুণগত মানের চেয়ে কোন অংশে কম না। আমাদের খামারিদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে তারা যেন, খোজখবর নিয়ে ভালো সোর্স থেকে ফিড এবং বাচ্চা ক্রয় করেন। তাহলে দেখবেন বাড়তি ওষুধ বা এন্টিবায়োটিকের খরচের হাত থেকে অনেকটা রেহাই পাবেন। তাছাড়া যতটুকু সম্ভব বায়োসিকিউরিটি ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে, কারণ এর বিকল্প নেই।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহ্ হাবিবুল হক: আপনাকে এবং এগ্রিনিউজ পরিবারের সকল সদস্যকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।