বুধবার , ডিসেম্বর ২৫ ২০২৪

ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা

fruitsকৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম: ব্যবস্থাপনা হলো সমন্বয় করা। ফলের বালাই ব্যবস্থাপনায় অধিকাংশ কৃষক বালাইনাশকের ওপর নির্ভরশীল বেশি। কেননা বালাইনাশক বাজারে সুলভ, চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায়, সহজে ব্যবহার করা যায় এবং দ্রুত ফল দেয়। বাণিজ্যিক ফলচাষিরা চান রোগ ও পোকামুক্ত আকর্ষণীয় ফল, তাতে যতোবার যতো বালাইনাশক দেয়া লাগে তারা ততবার তা দেন। সেজন্য ফলচাষিদের কাছে আইপিএম ধারণার গ্রহণযোগ্যতা এখনো বালাইনাশকের মতো হয়ে ওঠেনি। পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষত যদি বিদেশে ফল রপ্তানি করতে হয় তাহলে সেসব দেশের ক্রেতারা ক্ষতিকর রাসায়নিক দেয়া ফল কিনবে না। আইপিএম একটি পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা কৌশল যার মাধ্যমে বালাই ব্যবস্থাপনার উপযোগী কল কলাকৌশলের মধ্য থেকে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে একাধিক কৌশল বেছে নিয়ে একযোগে প্রয়োগ করে বালাইয়ের সংখ্যাকে আর্থিক ক্ষতিসীমার নিচে নামিয়ে রাখা হয় এবং বালাই ব্যবস্থাপনার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগের একটি প্রক্রিয়া। বরং এর মাধ্যমে এমন এক পরিবেশ বা অবস্থা তৈরি করা হয় যাতে বালাই কমবে বা নিয়ন্ত্রিত হবে। আইপিএম একাধিক প্রাকৃতিক উপাদানকে বিবেচনা করে কাজ করে বিধায় এটি পরিবেশসম্মত হয়ে পোকা দিয়ে পোকা দমন, রোগজীবাণু দিয়ে পোকা ও রোগ ধ্বংস, প্রাকৃতিক শক্তি বিশেষ করে সূর্যালোক, পানি, তাপকে আইপিএর বিবেচনা করে। এর সফলতা বা কার্যকারিতা আসলে নির্ভর করে নিয়মিত মনিটরিং বা ফলগাছ পর্যবেক্ষণ, অবস্থা বিশ্লেষণ, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ওপর। নিরাপদ ফল উৎপাদনের জন্য বালাই নিয়ন্ত্রণে আইপিএম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য
সাধারণভাবে আইপিএম এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, সুস্থ ও মানসম্পন্ন ফসল উৎপাদনে কৃষকের প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমানভাবে ফসল উৎপাদন ও কৃষকের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সামগ্রিক পরিবেশ তথা জনস্বাস্থ্যের উন্নতি। অনেকের ধারণা যে, আইপিএম পদ্ধতিতে আদৌ কোনো বালাইনাশক ব্যবহার চলবে না। আসলে তা নয়। পোকামাকড় ও রোগবালাই যদি অন্যান্য দমন পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, শুধুমাত্র তখন শেষ ব্যবস্থা হিসেবে বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে। তবে তার ব্যবহার করতে হবে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে ও যুক্তিসঙ্গতভাবে। এর মধ্যে আছে-নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন, কৃষি পরিবেশ বিশ্লেষণ ও নিয়মিত বালাই জরিপ নিশ্চিত করা; ক্ষেতে ক্ষতিকর ও উপকারি পোকামাকড়ের ভারসাম্য বজায় রাখা; শুধু বালাইনাশকের ওপর নির্ভরশীল না হওয়া ও বালাইনাশকের এলোপাতাড়ি ব্যবহার বন্ধ করা; আইপিএম ধারণায় কৃষককে দক্ষ করে গড়ে তোলা- যাতে করে নিজের ফসলের বালাই ব্যবস্থাপনার সঠিক সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই গ্রহণ করতে পারেন।

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার সুফল
সমন্বি বালাই ব্যবস্থাপনার ম্যাধমে আমরা যেসব সুফল পেতে পারি তা হলো- সুস্থ সবল উৎপাদন; ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো; পরিবেশ দুষণমুক্ত ফসল উৎপাদন; বালাইনাশকের ব্যবহার বন্ধ বা কমানো; জমিতে বন্ধুজীবের সংখ্যা বাড়ানো; বালাই ব্যবস্থাপনার খরচ তথা ফলের উৎপাদন খরচ কমানো; বালাই ব্যবস্থাপনায় কৃষকের দক্ষতা বাড়ানো; কৃষকের স্বাস্থ্য ভালো রাখা; কৃষকের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে লাভবান করাই হলো বালাই ব্যবস্থাপনার সুফল।

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার কৌশল
বাংলাদেশে প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত আইপিএম এর প্রধান ৫টি উপাদান বা কৌশল হলো-

১. বালাই সহনশীল জাতের ফল চাষ
এটি সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি উপাদান কিন্তু ফলের ক্ষেত্রে এ উপাদানের কার্যকারিতা কম। কেননা, এ দেশে ফলের যতো জাত উদ্ভাবিত হয়েছে সেসব জাতের বালাই সহনশীলতা বা প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কিত তথ্য খুব বেশি নেই। তবু যা আছে তার ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যায়। বিশেষ করে কোনো এলাকায় যদি কোনো নির্দিষ্ট বালাইয়ের আক্রমণ নিয়মিতভাবে প্রতি বা মৌসুমে ঘটতে থাকে তাহলে নতুন বাগান করার ক্ষেত্রে সে বালাই প্রতিরোধী জাতের চারা বা কলম সংগ্রহ করে তা লাগাতে হবে। যেমন- অ্যানথ্রাকনোজ রোগ প্রতিরোধী জাতের পেয়ারা চাষ করে বাউ পেয়ারা ১, বাউ পেয়ারা ২, বাউ পেয়ারা ৩, মুকুন্দপুরী ও কাঞ্চননগর জাতে এ রোগের আক্রমণ কম হয়। অন্য দিকে স্বরূপকাঠি ও কাজী পেয়ারাতে এ রোগ বেশি হয়।

২. জৈবিক পদ্ধতিতে ফলের বালাই নিয়ন্ত্রণ
এটা হলো সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি। প্রকৃতিতেই বালাই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু সেসব ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো হলো আমাদের কাজ। এসব প্রাকৃতিক শক্রর কেউ পরভোজী, কেউ পরজীবী আবার কেউবা বালাইয়ের দেহে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু। ফলবাগানে কোনো রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগ না করলে এসব উপকারী প্রাকৃতিক শক্রদের সংখ্যা বাড়ে ও প্রকৃতির নিয়মে তারাই বিভিন্নভাবে বালাই নিয়ন্ত্রণ করে। এতে পরিবেশের মধ্যে শক্র মিত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে। এজন্য বালাই চাষির কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তাই ফলবাগানে এসব বন্ধুজীবদের বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ফলবাগানে প্রধানত যেসব বন্ধু পোকামাকড় দেখা যায় সেগুলো হলো লেডিবার্ড বিটল, ইয়ার উইগ, প্রিডাসিয়াস মিজ, সিরফিড মাছি, অ্যানথ্রোকোরিড বাগ, মুলিয়েন বাগ, বোলতা, কোটেশিয়া বোলতা, পরভোজী মাকড় ইত্যাদি।

৩. আধুনিক প্রযুক্তিতে ফল চাষ
ফল চাষের যতো ভালো উন্নত প্রযুক্তি আছে সব মেনে ফল চাষ করাই হলো আধুনিক নিয়মে ফল চাষ। এতে সুস্থ সবল গাছ হয়, গাছের বৃদ্ধি ও তেজ ভালো থাকে। এসব গাছ প্রাকৃতিকভাবে অনেক বালাই প্রতিরোধ করতে পারে। এজন্য ফলগাছের উন্নত চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যা করা দরকার তা হলো- এলাকার উপযোগী উন্নত জাতের ফলগাছ লাগানো; সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে ও সঠিক মাত্রায় সার দেয়া। অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ফলগাছে না দেয়া; আগাছা ও পানি ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা; নিয়মিত গাছ ছাঁটাই করা; আক্রান্ত ফল ও গাছের আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।

৪. যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা
ফলের বালাই নিয়ন্ত্রণে হাত বা যে কোনো যন্ত্রের ব্যবহারই হলো যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে বালাইসমূহ বিতাড়িত হয়, মরে যায় অথচ উপকারী জীবের কোনো ক্ষতি হয় না। যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যেসব বিষয়াদি বিবেচনা করতে হবে তাহলো- ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ বা বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার; কাইরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করা; গাছ যখন দুর্বল বা আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন তা থেকে কাইরোমোন নি:সৃত হয় যা অনেক পোকাকে আকৃষ্ট করে। কৃত্রিমভাবে এরূপ কাইরোমোন ব্যবহার করে ফাঁদ তৈরি করে পোকাদের আকৃষ্ট ও ফাঁদে আটকে মারা যায়; আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা; বর্ণফাঁদ ব্যবহার করা; ইঁদুরের কল বা ফাঁদ ব্যবহার করা; গাছের তলার মাটি চষে দেয়া; পাখি ও বাদুড় তাড়ানোর জন্য আওয়াজ সৃষ্টিকারী টিন/যন্ত্রের ব্যবস্থা করা; বিভিন্ন ব্যাগ দিয়ে ফল ঢেকে দেয়া; মালচিং করা; করাত বা দা দিয়ে কেটে আক্রান্ত অংশ সরিয়ে ফেলা।

৫. রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা
রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা হলো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে বালাই নিয়ন্ত্রণ। বর্তমানে বিভিন্ন জৈব ও জৈব রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যেসব বিষয়াদি বিবেচনা করা যায় তাহলো- মরিচের গুঁড়া, আদা ও রসুনের রস এসব। জৈব পদার্থসমূহ স্প্রে করে বিভিন্ন পোকাকে বিতাড়িত করা যায়; এসিটিক এসিড, লবঙ্গের তেল, ফ্যাটি এসিড প্রভৃতি স্প্রে করা; সালফার ও চুন প্রয়োগ করা; বোর্দো মিশ্রণ প্রয়োগ করা; ট্রাইকোডার্মা বা ট্রাইকো কম্পোস্ট ব্যবহার করা।

সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বুদ্ধিমত্তার সাথে বালাইনাশক ব্যবহার করা। যে কোনো বালাইনাশক ব্যবহারে আগে তার ব্যবহারের নির্দেশনা পড়ে নিতে হবে। বালাইনাশক সাধারণত কারখানায় তৈরি করা কৃত্রিম রাসায়নিক দ্রব্য। এছাড়া প্রাকৃতিক বা জৈবিক বালাইনাশক ও আছে। জৈবিক বা প্রাকৃতিক বালাইনাশক ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিছু বালাইনাশকের কার্যকারিতা ব্যাপক, একই বালাইনাশক বহু রকমের বালাইকে মেরে ফেলতে পারে। কিছু বালাইনাশকের কার্যকারিতা পোষক বা বালাই সুনির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট বালাইকে তারা মারতে পারে। এরূপ বালাইনাশক ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিছু বালাইনাশকের অবশেষ ক্রিয়া দ্রুত শেষ হয়ে যায় (যেমন বিটি)। কিছু বালাইনাশকের (ডিডিটি) অবশেষ ক্রিয়া থাকে অনেকদিন। স্বল্প অবশেষ ক্রিয়া সম্পন্ন বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। ফলে কোনো তীব্র বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে না। রাসায়নিকের চেয়ে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে অধিক আগ্রহী হতে হবে। তবে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক প্রদ্ধতিতে, সঠিক মাত্রায় প্রযোগ করতে হবে। তা না হলে ফল ভালো আসবেনা।

লেখক : পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

This post has already been read 9329 times!

Check Also

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার আক্রমণ: ফলনের ক্ষতি ও করণীয়

ড. মো. মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে ধান প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিত এবং এর উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির …