* ২২ বছর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ব্যবসা, দু দেশের নাগরিকত্ব ফেলে দেশে এসে মৎস্য চাষী।
* শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর, রেডত্রক্রসহ একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও মাছ চাষই ভালো লাগে তার।
* বেকার তরুণদের করে দিচ্ছেন কর্মসংস্থান।
* নিজের টাকায় গ্রামে একাধিক মাটির ও ইটের রাস্তা নির্মাণ করেছেন।
আলতাব হোসেন: পুরো পরিবার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার নাগরিত্ব পান। যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে গাড়ির শো রুম, রয়েছে রিয়েল এস্টেট ও রেস্তোরার ব্যবসা। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শেষ করে রেডত্রক্রসসহ কয়েকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ২২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এতকিছু ফেলে দেশে এসে মাছ চাষী হলেন গাজীপুর শ্রীপুরের দমদমা গ্রামের আকরাম হোসেন।
স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৯১ সনে যুক্তরাষ্ট্রে যান মেধাবী আকরাম হোসেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর শেষ করে সেখানেই শুরু করেন ব্যবসা। পড়াশোনা, ব্যবসা ও চাকরিতে শিকাগো শহরে কাটান দীর্ঘ ২২ বছর। এ সময়ে গাড়ির শো রুম, রিয়াল এস্টেট ও রেস্তোরা ব্যবসায় নিজেকে জড়ান। ব্যবসার পরিধি বাড়ায় কানাডাতেও শাখা অফিস খোলা হয়। প্রবাসেই স্থায়ী হতে স্ত্রী, সন্তানসহ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার নাগরিকত্ব নেন তিনি। হঠাৎ করে তার তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রবাসী ভাই ও আত্মীয়দের বুঝিয়ে দিয়ে শুরু করেন চাকরি। রেডত্রক্রসসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন প্রায় ১৫ বছর। দায়িত্ব পালন করেন ইন্দোনেশিয়া, ইরাক ও সোমালিয়ায়। ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতিবেশী ও রাগবী খেলার পার্টনার। স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান নিয়ে প্রবাসে বেশ সুখেই ছিলেন তিনি।
কিন্তু প্রবাস–জীবন তার আর সইছিলো না। তার মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিল দেশে ফিরে কিছু একটা করার। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। তার কেবলই মনে হতো অন্য দেশের উন্নয়নে ২২ বছর শ্রম ও মেধা দিয়েছি। এবার নিজের দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করা উচিত। আর এ ভাবনায় তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উঠেন। দেশপ্রেম আর মানবতার তাগিদ থেকেই দেশে ফিরেন তিনি।
প্রবাসের বিলাসী জীবন ছেড়ে দেশে কিছু করার ঘটনায় আত্মীয়–পরিজন, বন্ধুবান্ধব সবাই হাসাহাসি করতেন প্রথম, প্রথম। এমন সিদ্ধান্তে নিকট আত্মীয়রা হন নাখোশ। সবাই বলতে লাগলো মাথা নষ্ট পাগলার। এমন সুখের জীবন ফেলে কেউ দেশে আসে? স্ত্রী ও সন্তান প্রথমে কিছুটা বেঁকে বসলেও অটল সিদ্ধান্ত থেকে তাকে নড়াতে পারেনি। স্ত্রী–সন্তানসহ দেশে ফিরে আসেন। শুরুতে তার এ পাগলমোকে
সমর্থন করে উৎসাহ ও সহযোগীতা দেন তার প্রবাসী বড় ভাই লোকমান হোসেন।
দেশে ফিরে কী করা যায়, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলেন। হঠাৎ তার মনে পড়ে ইন্দোনেশিয়ার একটি ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র রেডত্রক্রসের হয়ে ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি আঘাত হানার পর ত্রাণ দিতে গিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। ত্রাণ দেওয়ার সময় জেলেপল্লীর জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন তারা তাদের বাড়ী ঘর ধ্বংস হওয়ায় যতটা না আঘাত পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছেন মাছের খামার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়। মাছ চাষের আয় থেকেই তরতর করে শিল্পপতি হয়ে উঠেন মাছচাষিরা। উপকূলের ওই জেলেরা বিএমডব্লিউ ও পাজারো গাড়ীতে চলাচল করতেন। মাত্র এক যুগে মাছ চাষ করে নিজের ভাগ্যের পাশাপাশি পুরো এলাকাই বদলে দিয়েছিলেন তারা। সেই থেকেই মাছচাষ বিষয়ে আগ্রহ জন্মে তার।
এই ঘটনাটি স্মৃতির পটে ভেসে উঠার পর থেকেই মাছ চাষ বিষয়ে খোঁজ–খবর নিতে থাকেন তিনি। তার কয়েকজন আত্মীয় তাকে অবহিত করেন মাছ চাষ করে পাশর্^বর্তী ভালুকা, ত্রিশাল, ময়মনসিংহের কয়েকটি উপজেলায় বিপ্লব ঘটে গেছে। তিনি তার গ্রামের বাড়ির পুকুরের মাটি ও পানি পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষায় ওই এলাকায় মাছ চাষ করা যাবে বলে মৎস্য কর্মকর্তারা আশ্বত্ব করেন তাকে। আর কোনো কিছুতেই কান না দিয়ে নিজের গ্রাম শ্রীপুরের প্রহলাদপুর ইউনিয়নের দমদমায় শুরু করেন মাছের খামার। খামারের নাম রাখেন ‘লা এগ্রো ফার্মা এন্ড ফিশারিজ’। প্রায় ১২০বিঘা জমিতে গড়ে উঠেছে এ খামার। অথচ ২০০৯ সালে শুরু করেন মাত্র তিন বিঘার পুকুর দিয়ে।
তার খামার শুধু মৎস্য খামারে আটকে থাকেনি। কারো কথায় কর্ণপাত না করে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন একটি সমন্বিত খামার। খামারে এখন মাছ চাষের পাশাপাশি হাঁস, মুরগি ও গরু লালন–পালন করা হয়। হাঁস–মুরগির খামার থেকে দৈনিক দুই থেকে আড়াই হাজার ডিম আসে। গরু থেকে দুধ আসে প্রায় ১০০ লিটার। দেশীয় পদ্ধতিতে খামারে গরু মোটাতাজা করে বিক্রি করা হয়। পুকুরের পারে গড়ে তোলা হয়েছে সবজির বাগান। লাগানো হয়েছে ফুল ও ফলের গাছ। এসব খুচরা খাত থেকেও তার মাসিক আয় কয়েক লাখ টাকা। খামারে মাছের রেণু ও পোনা মাছ বিক্রি হয়। ময়মনসিংহ, ভালুকা ও গাজীপুরের মাছ চাষীরা পোনা মাছ সংগ্রহ করেন তার কাছ থেকে। খামারের পাশে একটি ভাসমান বিলেও ভাসমান পদ্ধতিতে মাছ চাষ করেন তিনি। সেখান থেকে কৈ আর শিং মাছ বেচে তার বছরে আয় প্রায় ৫০ লাখ।
ভালো ও গুণগতমানসম্পন্ন মাছের খাবার নিশ্চিত করতে খামারের মধ্যেই একটি ফিডমিল স্থাপন করেছেন আকরাম হোসেন। ফিডমিলের যন্ত্রপাতি ও সুষম খাবার মিশ্রণের ফর্মূলাও তিনি নিজে তৈরী করে নিয়েছেন। ভুট্টা, চালকল থেকে আনা তুষ ও মোটা চাল চিকন করতে চালের কেটে ফেলা ওপরের অংশ এবং খইল দিয়ে তৈরী করেন মাছের খামার। ফিশমিল থেকে দুই টন মাছের খাদ্য উৎপাদন হয় প্রতি ঘণ্টায়। খামারে পানির স্তর অনুযায়ী একাধিক জাতের মাছ চাষ করা হচ্ছে একই পুকরে। তেলাপিয়া, সরপুঁটি, বিগ্রেড, পাঙ্গাস, কালিবাউশ, রুই, সিলভার কার্প, শিং ও পাবদা মাছের চাষ হয়। খামারে দেড় থেকে দুই টন করে মাছ বিক্রি হয় প্রতি সপ্তাহে। পাইকাররা অগ্রিম টাকা দিয়ে খামার থেকে ট্রাক ভরে মাছ নিয়ে যান। তার খামারের মাছের সুখ্যাতি রয়েছে গাজীপুরে। হাটে মাছ বিক্রেতারা দমদমার মাছ বলে হাক দেন। অনেকেই জানেন আকরাম হোসেনের খামারের মাছে কোনো দুর্গন্ধ নেই, খেতে সুস্বাদু। গাজীপুর ছাড়াও রাজধানীর বেশ কয়েকটি আড়তে আসে তার মাছ।
ইতিমধ্যে তিনি একাধিকবার পেয়েছেন জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের সেরা মাছ চাষীর পদক। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধি দল তার খামার পরিদর্শন করেছেন। তারা খামারের মাছ ও অন্যান্য উপকরণ নিয়ে যান। তারা পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) মান অনুসরণ করে তার খামারে মাছ চাষ হচ্ছে। তার খামার থেকে মাছ রফতানির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তারা। আগামী ডিসেম্বর থেকে তার খামার থেকে মাছ রফতানি শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জনহিতৈষী একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও নিজেকে পরিচিত করে তুলেছেন আকরাম হোসেন। এলাকার অসহায় তরুণদের লেখাপড়া, বেকারদের কর্মসংস্থান, অর্থের অভাবে কেউ মেয়ের বিয়ে দিতে না পারলে তার বিয়ের ব্যবস্থা, অসুস্থদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে যাচ্ছেন। তার খামারে কাজ করা সকল শ্রমিকদের সপরিবারে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন খামার এলাকাকেই। শ্রমিকরা খামার থেকেই তাদের খাবার সংগ্রহ করে থাকেন। আলাদা পয়সা দিতে হয়না এর জন্য। খামারের শ্রমিকদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য প্রাইভেট টিউটরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের পড়াশোর ব্যয় খামারের আয় থেকেই মেটানো হয়।
প্রতি সপ্তাহে এলাকার বেকার তরুণদের নিয়ে মিটিং–এ বসেন আকরাম হোসেন। তরুণদের আত্মনির্ভরশীল সফল জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখান সেই বৈঠকে। এগিয়ে যাবার পথ বাতলিয়ে দেন, সহযোগীতার হাত বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এলাকার শিক্ষিত তরুণ বেকাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ওইসব তরুণদের হাতে–কলমে গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি শিখিয়ে দিচ্ছেন নিজে। কাউকে কাউকে দিচ্ছেন মৎস্য চাষের জ্ঞাণ। অসমর্থদের নিজের পকেটের টাকায় কিনে দিচ্ছেন গরু। বাকিতে দিচ্ছেন মাছের পোনা। ইতিমধ্যে এলাকার বহু তরুণ বেকার তার সহযোগীতায় কর্মসংস্থান পেয়েছেন।
এমন একজন যুবক দমদমা পশ্চিম পাড়ার আলী আকবর। তিনি জানান, আকরাম ভাইয়ের আর্থিক সহযোগীতা ও পরামর্শে এখন ভালো আছেন। অথচ পড়াশোনা শেষ করে কয়েক বছর বেকার ছিলেন। পরিবার ত্যাক্ত–বিরক্ত হয়ে বিদেশ পাঠানোর পরিকল্পনা করেন। এমন সময় আকরাম ভাই–এর ঘরোয়া পাঠশালায় এসে তার উজ্জীবিত কথা শুনে দেশে গরু মোটাতাজা করার পরিকল্পনা নিই। এখন আমার খামারেও বছরে ৪০ থেকে ৭০টি গরু মোটাতাজা হয়। অথচ শুরুতে আকরাম ভাই আমাকে তিনটি ছোট গরু ৪৫ হাজার টাকা দাম দরে মোটাতাজার জন্য দিয়েছিলেন। তিনমাস গরুগুলো মোটাতাজা করে কোরবানীর ঈদে বিক্রি করে আকরাম ভাই–এর টাকা পরিশোধ করার পরও আমার এক লাখ ১২ হাজার টাকা লাভ থাকে। পরবর্তীতে এ পুজি দিয়েই খামার বড় করেছি।
আকরাম হোসেনের খামার সংলগ্ন প্রতিবেশী বৃদ্ধ ইদ্রিস আলী ফকির বলেন, ‘আগে ছেলে–পেলেরা কোনও কাজ করত না। আকরাম খামার করার পর তার সঙ্গে আলাপ করে এসব ছেলে–পেলে কেউ মাছ, কেউ কেউ সবজি, কেউ মুরগি আবার কেউ গরু পালছে। এখন গ্রামে দলাদলি নাই।’
নিজ গ্রামের মানুষ রাস্তা খারাপ থাকায় চলাচলে দুর্ভোগ পোহানোর কারণে তিনি নিজের অর্থে ইটের রাস্তা, একাধিক মাটির রাস্তাা নির্মাণ করে দিয়েছেন। তার খামারের বিদ্যুৎ আশপাশের প্রতিবেশীদের বাড়িতেও সংযোগ দিয়েছেন। খামারে কাজ করা দীর্ঘদিনের শ্রমিক অনিল কুমার বলেন, ‘আকরাম কাকার এখানে চাকরি করি এটা মনে হয় না, মনে হয়–এ খামার আমার।’ তিনি আরো বলেন, ‘পরিবারের চিকিৎসা, দুই মেয়ের বিয়ে সবকিছুই কাকা দিয়েছেন। মরলে শশ্মানে যেন কাকাই নিয়ে যান।’
আকরাম হোসেন বলেন, মাছে–ভাতে বাঙালী এ প্রবাদ এখন বাসি। বাঙালীর ভাতের থালায় আবার মাছ ফিরিয়ে আনতে চাই। গ্রামের শিক্ষিত তরুণরা ভিটে–মাটি বেঁচে বিদেশ গিয়ে প্রতারিত হয়ে নি:স্ব হয়ে ফিরে। দেশেই যাতে ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান হয় তার জন্য ছোট পরিসরে কাজ করছি। চাকরি করবো এটা না ভেবে তরুণরা যাতে অন্যকে চাকরি দেবো এটা ভাবতে শেখে তার চেষ্টা চলছে। বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো–আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। আমার মেধা ও অভিজ্ঞতাকে আমার এলাকার মানুষের ভাগ্যউন্নয়নে কাজে লাগাতে চাই। একজন বিপদগ্রস্ত মানুষের মুখের হাসি, আমার কাছে মহামূল্যবান।
খামার পরিচালনায় আকরাম হোসেনের স্ত্রী মনিরা সুলতানা মুনমুন পাশে থাকেন সবসময়। স্ত্রীকে স্বাবলম্বী করতে দেশী–বিদেশী ফুলের ব্যবসা গড়ে দিয়েছেন তিনি। চীন ও নেদারল্যান্ড থেকে ফুলের চারা আমদানি করা হয়। বিমানবন্দর থেকেই এসব ফুলের চারা ক্রেতারা নিয়ে যান। অনলাইনেই বিক্রি হয় দামি এসব ফুলের গাছ। একমাত্র কন্যা মিফতা হোসেনকে নিয়ে তাদের সোনার সংসার।