বৃহস্পতিবার , নভেম্বর ২১ ২০২৪

দেশি ফলের সেনসেশন: পানি ফল বনাম সিঙ্গারা ফল

পানি ফল এবং ইসসেটে সিঙ্গার ফল
পানি ফল এবং ইসসেটে সিঙ্গার ফল

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম : পানিতে জন্মে বলে পানি ফল। প্রায় ৩ হাজার বছর আগে থেকেই চীন দেশে পানি ফলের চাষ হয়ে আসছে বলে ধারণা করা হয়। বিগত কয়েক দশক থেকে আমাদের দেশেও পানি ফলের চাষ হয়ে আসছে বিচ্ছিন্নভাবে কারো কারো ব্যক্তিগত আগ্রহে। যদিও পানিফল নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা বা সুষ্ঠু পরিকল্পনা এখনও হয়নি। তবে বর্তমানে এ দেশেও সাতক্ষীরার দেবহাটা, নওগাঁ পানিফলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। এ ফলের গাছ হয় পানিতে। স্থির বা ধীর প্রবাহমান ¯্রােতের পানিতে পানিফল জন্মে। ফল দেখতে অনেকটা সিঙ্গাড়ার মতো বলে সাতক্ষীরার লোকেরা এক ডাকে সিঙ্গাড়া ফল নামে। দেশের আরো বেশ কিছু জায়গায় পানিফল সিঙ্গারা ফল নামেই পরিচিত।

এটি একটি বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। ইংরেজি নাম Water chestnut, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Trapa bispinosa পরিবার- Onagraceae। এটি ইংরেজিতে Water chestnut হলেও স্থানভেদে Water caltrop, Buffalo nut, Devil Pod এসব নামে পরিচিত। প্রজাতির নাম বাইস্পাইনোসা মানে দুটো কাঁটা থেকেই বোঝা যায় যে ফলে দুটি কাঁটা বর্ষজীবী জলজ গাছ। পানিফলের গাছ ৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পানির নিচে মাটিতে এর শিকড় থাকে এবং পানির উপরে পাতাগুলো ভাসতে থাকে। মূলকা-ের সাথে গাঢ় সবুজ বা লালচে সবুজ ত্রিভূজাকৃতি মোটা ও নরম পাতাগুলো গোলাকারভাবে পানির উপর ভাসে। পাতা ৮ সেন্টিমিটার লম্বা ও পাতার কিনারা খাঁজকাটা, প্রায় ৬ সেন্টিমিটার চওড়া। পাতার বোঁটা পশমযুক্ত। পত্রফলক বেশ মাংসল পুরু তেলতেলে।

সাধারণত চীন, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, ফিলিপাইন, আফ্রিকা এসব দেশে পানিফল আবাদ হয়। এটি পুরোপুরিভাবে পানীয় ফল। কাঁচা অবস্থায় এ ফল খাওয়া যায়। আবার সিদ্ধ করে, রান্না করে কিংবা প্রক্রিয়াজাত করেও খাওয়া যায়। চীনে বিভিন্ন সবজির সাথে মিশিয়ে সবজি রান্না করা হয়। চীনের খাদ্য তালিকায় পানিফল বেশ জনপ্রিয় এবং আবশ্যকীয়। চীনারা পানিফলকে শুকিয়ে আটা তৈরি করে। সে আটা দিয়ে তারা পিঠা কেক বিস্কুট তৈরি করে খায়, বাজারে বিক্রি করে। মোটকথা তারা পানি ফলকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছে। কোথাও কোথাও পানিফল গোখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অতি পরিচিত পানিফলটি শুধু গ্রামেই নয় শহরের ফুটপাতের ফলের দোকানে স্থান করে নিয়েছে। তবে কালচে সবুজ রঙের এ ফলটি এখনো শহরের বড়বড় ফলের দোকানে স্থান করে নিতে পারেনি অজ্ঞাত কারণে।

পানিফলের পুষ্টি ও ভেষজগুণ
পানিফল পুষ্টিতে ভরপুর। প্রায় ৯০% কার্বোহাইড্রেট, ৬০% শর্করা আছে। তাছাড়া বেশ ভালো পরিমাণ আঁশ, রাইবোফ্লেবিন, ভিটামিন বি, পটাসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আমিষ, ভিটামিন আছে। পুষ্টিমানের বিবেচনায় পানিফলে খাদ্যশক্তি আছে ৬৫ কিলোক্যালরি, জলীয় অংশ ৮৪.৯ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০.৯ গ্রাম, খাদ্যআঁশ ১.৬ গ্রাম, আমিষ ২.৫ গাম, চর্বি ০.৯ গ্রাম, শর্করা ১১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.১৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি ২০.০৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১৫ মিলিগ্রাম। পানি ফলের শুধু খাদ্যগুণই না, রয়েছে ওষুধি গুণও। পানিফলের শাস শুকিয়ে রুটি বানিয়ে খেলে আ্যালার্জি ও হাতপা ফোলা রোগ কমে যায়। উদরাময় ও তলপেটে ব্যথায় পানিফল খুবই উপকারী। বিছাপোকা বা অন্যান্য পোকায় কামড় দিলে যদি জ্বালা পোড়া হয় তবে ক্ষতস্থানে কাঁচা পানিফল পিষে বা বেটে লাগালে দ্রুত ব্যথা দূর হয়। কাঁচা পানিফল বলকারক, দুর্বল ও অসুস্থ মানুষের জন্য সহজপাচ্য খাবার। পানি ফলে শর্করা ও প্রোটিন আছে যথেষ্ট। শাঁস শুকিয়ে রেখে খাওয়া যায়। বিছা বা পোকার কামড়ে কাঁচা পানিফল বেটে সেখানে লাগালে দ্রুত ব্যথা দূর হয়।

সিঙ্গাড়া ফল
অনেকে পানি ফলের সাথে সিঙ্গাড়া ফলকে গুলিয়ে ফেলেন। সিঙ্গাড়া ফলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Trapa natans; পরিবার Trapacae। সিঙ্গাড়া ফল খুব শক্ত, বাদামি রঙের শক্ত সে খোসার মধ্যে থাকে নাট বা বাদামের মতো শাঁস। দা দিয়ে জোর করে কাটতে হয়। এজন্য প্রজাতির নাম Trapa natans রাখা যায়। ইংরেজি নাম Water caltrop সিঙ্গাড়ার মতো গড়ন বলে এ ফলেল নাম সিঙ্গাড়া ফল। তবে এটিও এক ধরনের পানিফল। সচরাচর আমরা যে পানিফল দেখি তার শাঁস ও খোসা নরম, কাঁটা থাকে দু’দিকে দুটি। আর সিঙ্গাড়া ফলের শাঁস ও খোসা শক্ত, কাঠের মতো, কাঁটা থাকে চারটি। কাঁটাগুলো  সরু, শক্ত বেশ তীক্ষè। চারটি কাঁটা থাকায় সম্ভবত সিঙ্গাড়া ফলের পূর্বের প্রজাতির নাম ছিল Trapa quadrispinosa সিঙ্গাড়া ফলের গাছ ভাসমান বর্ষজীবী জলজ প্রকৃতির। পাতা ত্রিভূজাকৃতির, গাঢ় সবুজ। শিকড় ও কন্দ থাকে প্যাঁক বা কাদার মধ্যে, কা- থাকে পানিতে আর পাতা, ফুল ও ফল পানির উপর ভেসে থাকে। ফলের আকার অনেকটা ত্রিভূজাকার, প্রিজমের মতো, শক্ত। কেটে ভেতরের সাদা শাঁস খাওয়া যায়। শাঁস স্বাদে পানসে মিষ্টি, কিন্তু চিবিয়ে খেতে মজা লাগে। কোথাও কোথাও  পাকা ফলের শাঁস আলুর মতো রান্না করে খাওয়ারও প্রচলন আছে। এমনকি শাঁস শুকিয়ে গুঁড়া করে রেখে পরে খাওয়া যায়। কাঁচা ফল প্র¯্রাব ও রুচি বৃদ্ধিকারক, বলবর্ধক। সিঙ্গাড়া ফলের দেখা মিলেছে পাবনার বিল কুরারিয়ায়। সুনামগঞ্জের হাওরেও আছে।

পানি ফলটি দেশব্যাপী খুব বেশি পরিচিত নয়। অনেকে হয়তো এখনো চিনেনই না। পানিফল পুষ্টিসমৃদ্ধ, ভেষজগুণ সম্পন্ন সহজ সরল কৌশলে উৎপাদিত দামি ফল। আবাদের খরচ নেই বললেই চলে। লাভ হয় অনেক বেশি। সবচেয়ে বড় কথা যেসব জমিতে অন্যান্য ফসল আবাদ করা যায় না সেখানে অনায়াসে পানিফল আবাদ করা যায়। পতিত জমি আবাদের আওতায় এনে লাভবান হওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে পানিফলটি আমাদের কৃষি উন্নয়ন সমৃদ্ধিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। তবে এক্ষেত্রে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ব্যবহার এসবের ওপর ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার, সার ব্যবস্থাপনা, বালাই ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ পরামর্শ ও অনুমোদন দরকার। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর বিনিয়োগে পানিফল দিয়ে আমরা আরও অনেক দূরে এগিয়ে যেতে পারব।

লেখক : পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

This post has already been read 7245 times!

Check Also

বারি ও সুপ্রিম সীড কোম্পানি লি: এর মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর

গাজীপুর সংবাদদাতা: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এবং সুপ্রিম সীড কোম্পানি লিমিটেড এর মধ্যে এক …