রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪

মরক্কোর কমলা

মুনিম সিদ্দিকী: মরক্কোতে মান্ডারিন কমলার মধ্যে নাদরকট, তাঞ্জারিন, নুর নামীয় কমলা উতপাদিত হয়, মাল্টার মধ্যে ওয়াশিংটন ব্লাড,মারকলেট, নাভেল নামীয় মাল্টা পাওয়ায়। মরক্কো কমলাগুলোতে বীজ নেই খেতেও খুব মিষ্টি।

আসলে কমলাও কমলা মালটাও কমলা, মূলত উভয় Rutaceae রুটেস পরিবারের সদস্য। কমলা বলতে যাদেরকে খোসা সহজে তুলে ফেলা যায় তাকে কমলা বলে, আর যে সবের খোসা সহজে তুলা যায়না সেগুলোকে মাল্টা বলে।

মালটার প্রকৃত নাম মালটা নয়, ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ মাল্টায় এই কমলা প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয় বলে কেউ কেউ তাকে মালটা নামাকে ডাকেন। ইংরেজিতে মাল্টাকেই অরেঞ্জ বলে, আবার আমরা কমলাকে অরেঞ্জ বলি।

আমরা যাদেরকে কমলা বলি সেগুলো মূলত Citrus Reticulata সিট্রাস রেটিকুলাটা প্রজাতির লেবু। মালটা হচ্ছে মূলত Citrus Sinesis সিট্রাস সিনেসিস প্রজাতির লেবু।

মরক্কোতে কমলালেবু এত সস্তা, তাই কমলা মৌসুমে আমি খাবার কম খেয়ে কমলাই বেশি খেতাম। মাত্র দুই দিরহামে এককেজি কমলা পাওয়া যায়। ছোট সাইজের কমলা, তারা বলতেন মান্দারিন।

প্রথমদিকে আমি বিক্রেতার মর্জিমাফিক কিনে নিয়ে আসতাম। তখন আমার স্ত্রী বললো, তুমি কমলা চিনে কিনতে পারবেনা। তুমি টক (সামান্য টক) নিয়ে আসো। তার এই চিনিনা বললে আমার পুরুষত্বে আঘাত করতো, শুধু কমলার বিষয়ে নয়, পিয়াজ মরিচ, আপেল ইত্যাদির বিষয়ে বলতো আমি এসব চিনে ক্রয় করতে পারিনা।

রাগ হতো বলতাম- তাহলে তুমি কিনে আনবে, অামি আনতে পারবোনা। আসলে মরক্কো আর ইউরোপে দেখেছি ক্রেতারা আলু সবজি, ফলমূল একটি একটি করে বেছে বেছে ব্যাগে ভরে তারপর ওজন করিয়ে কিনে নিয়ে আসে। যা আমাদের অভ্যাস বা আমাদের দেশের বিক্রেতারা বাছাই করতে দিবেনা।

কমলা কিনতে টিপে দেখতে হয়, যদি খোসা ফাঁপা থাকে তাহলে সেই ফাঁপা কমলা কিনলে তা মিষ্টি হবে, ফাঁপা ছাড়া কিনতে টক হবে। কমলা ভালোভাবে পাকলে ভিতরে ছোট হয়ে আসে, তাতে খোসার সাথে গ্যাপ সৃষ্টি হয়।

আমি অবশ্য সমালোচনা থেকে বাঁচতে উনাকে ড্রাইভার এর সাথে বাজারে পাঠিয়ে দিতাম, তিনি আস্তে ধীরে একটি একটি যাচাই বাছাই করে কিনে আনতেন।

কমলার আদিনিবাস হচ্ছে চায়না। ৪ হাজার বছর আগ থেকেই কমলার চাষ চায়নায় হতো তার প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়।

খোদ চায়নাতে কমলাকে চেং-জি, চাং, চি-চিদা বলে। আমাদের প্রতিবেশী আসামের লোকেরা সুমথিরা বলে, নেপালিরা লাইনভানিনছা বলে।

আদিকালে ভারতে কমলাকে নারেংগী বলতো এখনো অনেক জায়গায় নাকি নারেংগী থাকে। কমলা যখন ভারত পার হয়ে ইরান এলো এখানে এসে সে নারাংগ হয়ে গেল। ইরান পার হয়ে আরবে এসে হয়ে গেল নারাঞ্জ ফ্রেঞ্চ আর ইংলিশ কাছে এসে নারাঞ্জ অরেঞ্জ হয়ে যায়।

মরক্কোর লোকেরা কি মালটা কি কমলা সব কে লিমুন বলে। আর লেবুকে কি বলে জানেন? হামদ। সকল প্রকার লেবুকে তারা হামদ বলে।

মরক্কোতে বিক্রেতাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন কি জাতের লিমুন? তখন বলে লিমুন মান্দারিন, লিমুন বুর্তুগাল,লিমুন নাভিল।

মুলত সিত্রাস রিতিকুলাতা প্রজাতি কমলা বিভিন্ন দেশে গিয়ে সেখানকার মাটি, আলোবাতাসে আর ঋতুর প্রভাবে অন্যান্য লেবু প্রজাতির রেণুর দ্বারা প্রকৃতিগতভাবে জেনিট্যাকেলি পরিবর্তিত রূপে বিকাশ লাভ করে বিভিন্ন নাম ধারণ করে।

মরক্কোরে সকল কমলা চায়নার মান্দারিন প্রজাতি থেকে বিবর্তিত, যাকে মরক্কানরা বুর্তুগাল বলে থাকেন। মান্দারিন থেকে বিবর্তিত আরেকটি জাত হচ্ছে নাদরকট। আরেকটি নুর Nour নামক। মান্দারিন সুইট অরেঞ্জ মিলে নতুন জাতের কমলা সৃষ্টি হয়, যাকে Clementine’s বলে।

ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ফ্রান্সের মিশনারি মিশনের এক ব্রাদার বা পাদ্রী মরক্কোর পাশের দেশ আলজেরিয়া বাস করতেন, উনার নাম ক্লিমেন্ট রোজার বা রোদার। তার বিশাল একটি কমলার বাগান ছিল। সে বাগানে মান্দারিন আর সুইট অরেঞ্জ প্রজাতির গাছ ছিল। ১৯০২ সনে তিনি আবিষ্কার করলেন তার বাগানের একটি গাছে ভিন্ন রকমের কমলা এসেছে, যা মান্দারিন থেকেও উন্নত ঘ্রাণ আর স্বাদের। তিনি বুঝতে পারলেন আল্লাহর কুদরতেই মিস্টি অরেঞ্জ আর মান্দারিনে অটোম্যাটিক পরাগায়ণ ঘটে এই নতুন জাতের উদ্ভব ঘটেছে। এরপর থেকে এই প্রজাতির নাম ক্লিমেন্টাইনিস করা হয়। পৃথিবীর সকল আরব রাষ্ট্রে কমলাকে বুর্তুগাল বলে। ইউরোপের অনেক দেশেও পুর্তুগাল বলে।

এর কারণ, এই কমলাকে পর্তুগীজ বনিকেরা হাজার বছর আগে চায়না থেকে ভারত হয়ে ইরান নিয়ে আসে। তাই ইরানীরাও কমলাকে পর্তুগাল বলে, তুর্কিরা, বুলগেরিয়ানরা পর্তুকাল আর গ্রীকরা পর্তুকালি বলে থাকে।

অন্যদিকে সুইডিশ, ডেনিশ, রাশিয়া, জার্মানরা বলে আপেলসিন, মানে চিনের আপেল। আইসল্যান্ডিরা আপেলসিনা, ফিনিশিয়রা আপেলসিনি,আর ডাচরা আপেল সিয়েন/সিনা আপেল বলে।

বর্তমান পৃথিবী প্রধান প্রধান কমলা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে মরক্কো অন্যতম। মরক্কো কম বৃষ্টি আর কোমল আবহাওয়া কমলা চাষের জন্য অতি উত্তম জায়গা।

বাংলাদেশে যারা কোটিপতি আছেন তারা টাকা মরক্কোতে বিনিয়োগ করতে পারবেন। মরক্কোর সরকার বিদেশীদের কাছে নামমাত্র দরে পাহাড়ি জায়গা লিজ দিয়ে থাকে। সে জায়গায় কমলা, অলিভ বাণিজ্যি ভাবে চাষ করা যায়।

This post has already been read 8091 times!

Check Also

ভারতীয় পশুতে ক্ষুরা রোগ: মহিষে কমছে রপ্তানি আয়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সুস্বাদু, দামেও সস্তা হওয়ার কারণে এক সময় ভারতীয় মহিষের মাংসের বেশ কদর ছিল …