রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪

খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ফোলিয়ার ফিডিং প্রযুক্তি

কৃষিবিদ মো. আরিফ হোসেন খান: সদ্য স্বাধীন দেশে জনসংখ্যা ৭ কোটি, জমিও প্রচুর; তারপরেও এদেশের মানুষকে না খেয়ে মরতে হয়েছে। কৃষিই যে এদেশের প্রাণ তা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্দি করেন এবং অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ান কর্মকর্তার মর্যাদা প্রদান করেন। তিনি চিন্তা করেন মেধাবী ছেলে মেয়েদের কৃষিতে সম্পৃক্ত করতে না পারলে এদেশের কৃষির উন্নতি করা সম্ভব হবেনা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আজ তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের এসে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তবে কৃষিতে আজকের যে সাফল্য তা আগামীতে ধরে রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ, এখন প্রতি বছর ১ ভাগ হারে জমি কমছে এবং ২২ লক্ষ হারে মানুষ বাড়ছে। আমারা যদি আজকের এই সাফল্যের বিষয়ে কিছু পিছনে ফিরে তাকাই তা হলে কি দেখবো?

১. দেশ স্বাধীন হবার পরে অধিকাংশ জমিতে স্থানীয় প্রজাতির ধানের চাষ হতো যার ফলনশীলতা ছিল খুবই কম।

২. দেশের অনেক জমি বছরের অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে থাকতো । উচ্চফলনশীল বোরো ধানের আবাদ ছিলনা বললেই চলে।

৩. বরেন্দ্র এলাকার জমিতে বৃষ্টি নির্ভর একমাত্র আমন ধানের চাষ হতো।

৪. চাষিরা নিজ বাড়ির সাধারণ বীজ ব্যবহার করতেন।

৫. রাসায়নিক সারের ব্যবহার চাষিরা  তেমন জানতেন না। অনেক চাষ রাসায়নিক সারের ব্যবহারকে পাপ বলে মনে করতেন।

৬. উৎপাদিত ফসলের এক বড় অংশ রোগবালাই এবং পোকামাকড়ের আক্রমণে নষ্ট হয়ে যেত এবং চাষাবাদ কৌশল তেমন উন্নত ছিলনা।

৭. কৃষকদের কৃষি বিষয়ে পরামর্শ দেবার সম্প্রসারণ কর্মীও পর্যাপ্ত  ছিলনা।

আইআর-৮ জাতের ধানের সম্প্রসারণ এদেশের কৃষিতে প্রথম বিপ্লবের সূচনা করে।  খাল খননের মাধ্যমে বিলের পানি নিষ্কাশন এবং স্লুইচ নির্মাণের মাধ্যমে অনেক জমি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ফসল আবাদে চাষিদেরকে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শিখানো হয়। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ফসলের ফলনশীলতা অনেক বৃদ্ধি করা হয়।

উন্নত মানের বীজ ব্যবহারের চাষিদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হয়।  বালাইনাশকের ব্যবহারের মাধ্যমে চাষিদেরকে তার ফসল সুরক্ষা দেবার কৌশল শিখানো হয়। সেচের সম্প্রসারণ ঘটানো হয়।  এক ফসলের স্থলে ৩-৪ ফসল ফলানোর কৌশল শিখানো হয়। যান্ত্রিক চাষাবাদের প্রচলন করা হয়। এক কথায়, ফসল স্বাধীনতার পরে ৪৬ বছর সময়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির যতগুলি প্রধান কৌশল রয়েছে আমরা তার প্রায় সবগুলিই ব্যবহার করার মাধ্যমে আমাদের কৃষিকে আজকের অবস্থানে আনতে সক্ষম হয়েছি। সকল কিছুর বিবেচনাতে আমাদের কৃষি আজ তুঙ্গে অবস্থান করছে। এ কারণে আমরা বিশ্বে ধান উৎপাদনের চতুর্থ শাকসব্জি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে অষ্টম এবং আম উৎপাদনে নবম অবস্থানে রয়েছি।

তবে এ সময়ে আমাদের মূল চিন্তার বিষয় হলো আগামী দিনের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়। আগামীর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য পাঁচটি বিষয় সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিবে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।

১. আবাদি জমি কমে যাওয়া।

২. জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া।

৩.পানির স্তর বিপদজনকভাবে নীচে নেমে যাওয়া। ইতোমধ্যেই বরেন্দ্র এলাকাতে ধান চাষ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। বোরা মৌসুমের শেষদিকে বিল এলাকাতেও অগভীর নলকূপ ডিপসেট করে সেচ দেওয়া হচ্ছে।

৪. জলবায়ু পরিবর্তন। এবং

৫. ক্রমাগত অধিক হারে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল ফসল উৎপাদনের কারণে মাটির উৎপাদনশীলতা হ্রাস।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক  মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস. কে জামান এর একটি তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যযন্ত  সময়ের মধ্যে বাংলাদশের মাটির মোট নাইট্রোজেনের পরিমাণ কমেছে ৩১%, মোট কার্বনের পরিমাণ কমেছে-১১% এবং গ্রহণযোগ ফসফেট কমেছে ৯%। সুতরাং, পরবর্তী ২০ বছর সময় পরে এ তথ্য যে আরো অনেক বেশী হবে বলে মনে করি। এ সমস্যাটি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের সমস্যা। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা  FAO সাম্প্রতিক সময়ে SAVE AND GROW নামক একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে যার মূল উদ্দেশ্য হলো সর্বাধিক কম পরিমাণ কৃষি উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে কিভাবে বেশী ফসল ফলানো যায়। তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, ৬০ এর দশকের সবুজ বিপ্লবের সূচনার মাধ্যমে বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষ অনাহারের কবল থেকে রক্ষা পেলেও অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে অধিক হারে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, কীট নাশকের ব্যবহার এবং ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে মাটি, পানি এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এজন্য FAO এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গুরুত্বে সাথে বাস্তবায়ন করার প্রয়াস নিয়েছে।

এ সময়ে আমাদের দেশে উচ্চফলনশীল বিভিন্ন ফসল চাষের নিবিড়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে ফলে প্রতিনিয়ত মাটির নিজস্ব উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে আর মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির ক্ষতি বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, দেশের মাটির স্বাস্থের বিষয়টি নিয়ে আজ সকলেই সচেতন এবং কিভাবে মাটির উর্বরতাশক্তি বৃদ্ধি করা যায় সে বিষয়ে চিন্তিত। যার ফলশ্রুতিতে ডিএইর মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় মাটিতে জৈব পদার্থ বৃদ্ধির প্রয়াস চালানো হচ্ছে।

এ অবস্থাতে অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে হলে ট্রাডিশনাল কৃষির পরিবর্ততন আনাটা জরুরী বলে। আগামীর কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাতে উন্নত বিশ্বে বহুল প্রচলিত পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদানের ফোলিযার ফিডিং  প্রযুক্তির সুসংহত ব্যবহার এক্ষেত্রে আমাদের জন্য সহায়ক হতে পারে। এছাড়া দেশের সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বিষয়ে নীচে কিছু আলোকপাত করলাম।

প্রথমেই দেখা যাক ফোলিয়ার ফিডিং  ( Foliar Feeding ) বিষযটি কি?

আমরা মুখ দিয়েই আমাদের খাদ্য গ্রহণ করে থাকি কিন্তু কখনও যদি বেশী মাত্রায় অসুস্থ হয়ে যাই তবে আমাদেরকে ভেইনের মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান করে ( বহুল প্রচলিত স্যালাইনের মাধ্যম) সুস্থ করা হয়। গাছ সাধারণভাবে তার শিকড়ের মাধ্যমে মাটি থেকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে।  কিন্তু যদি কোন কারণে শিকড়ের মাধ্যমে পুষ্টি উত্তোলনে  অসুবিধার সন্মুখীন হয় ( সাময়িক খরা, জলাবদ্ধতা, পিএইচ জনিত সমস্যা, নিম্ন তাপমাত্রা ইত্যাদি) তবে গাছকে পাতার মাধ্যমে পুষ্টি দিয়ে বেশ ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আর স্বাভাবিক সময়ে এভাবে পুষ্টি প্রদান করে ফসলের ফলন অনেক বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। এছাড়া পাতার মাধ্যমে কৌশলগতভাবে পুষ্টি প্রদান করে উল্লেখযোগ্য পরিমানে মাটিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। গাছকে পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদানের এই বিষয়টিকেই  Foliar feeding/Foliar fertilization/Foliar fertigation বলে। প্রকৃতপক্ষে শুধু পাতা নয়, মাটির উপরের যে কোন অংশ দিয়েই গাছ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে। এ বিষয়টিকে Non root absorbtion বলে।

যতদুর জানা যায়, ফসল উৎপাদনের এই প্রযুক্তির প্রথম প্রয়োগ হয় ১৮৪৪ সালে আমেরিকাতে। তবে এটা যে বৈজ্ঞানিকভাবে সত্যি এবং কার্যযকর পদ্ধতি তা প্রমাণ হয় ১৯৫০ সালে। আমেরিকার মিসিগান স্টেট ইউনিভারসিটির উদ্যানতত্ব বিভাগের ২ জন বিজ্ঞানী বিষয়টি সর্বপ্রথম সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করেন যে, ফসলে পুষ্টি প্রদানের ক্ষেত্রে এই ফোলিযার ফিডিং একটি কার্যযকর পদ্ধতি। পরবর্তীতে তারা এবিষয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন এবং নিম্নোক্ত তথ্য পান-

Foliar Fertilization is the most efficient way to increase yield and plant health. Tests have shown that foliar feeding can increases yields from 12% to 25% when compared to conventional fertilization.

Tests, conducted in different locations, under different environmental conditions, have reflected the following;

**When fertilizers are foliar applied, more that 90% of the fertilizer is utilized by the plant. When a similar amount is applied to the soil, only 10 percent of it is utilized.

**In the sandy loam, foliar applied fertilizers are up to 20 times more effective when compared to soil applied fertilizers.

**Foliar feeding is an effective method for correcting soil deficiencies and overcoming the soils inability to transfer nutrients to the plant under low moisture conditions

চাকুরীর সূচনালগ্ন থেকে শখের বসে গাছকে পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমি দেখেছি যে, আমরা যদি ফসল উৎপাদনে অতিরিক্ত পরিপূরক হিসাবে কিছু পুষ্টি উপাদান (ম্যাক্রো এবং মাইক্রো)  পাতার মাধ্যমে প্রদান করি। তবে তা ফসলের ফলন অনেক বৃদ্ধি করছে। পাতার মধ্যে অতিরিক্ত পরিপূরক হিসাবে পুষ্টি প্রদান করে ধান ও গমের ক্ষেত্রে ১০-১৫% এবং সব্জির ক্ষেত্রে ২০-৫০% এর মধ্যে ফসলের ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে প্রমাণ পাই। এখন প্রশ্ন আসতে পারে পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান করলে কেন ফসলের ফলন বৃদ্ধি পাবে? এ বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণএবং মতামত  নিম্নরূপ:

উচ্চফলনশীল বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদের সময় আমরা আজকাল আর জমিতে সেভাবে জৈব পদার্থ প্রদান করি না। এজন্য মাটিতে অনুখাদ্যের ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। আমরা যে সকল অনুখাদ্য ব্যবহার করছি তার অধিকাংশই ভেজালে ভরা যা এসআরডিআইএর ফলাফল থেকে জানা যায় (দেশে ১৭ ধরণের রাসায়নিক সারের মধ্যে ১৫টিতেই ভেজাল পাওয়া গেছে) এ সকল অনুখাদ্য খুব কম পরিমাণে প্রয়োজন হলেও এগুলোর গুরুত্ব ফসল উৎপাদনে খুবই বেশী। যেমন, কোন জমিতে দস্তার ঘাটতি থাকলে সে জমিতে ধান গাছ প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, বোরণের ঘাটতি থাকলে গম এবং ভূট্টার পরাগায়ণে সমস্যা হয় বলে চিটা বেশী হয়, বিভিন্ন ফল জাতীয় সবজির সঠিকভাবে পরাগায়ণ না হবার কারণে ফলন অনেক কমে যায়।

অম্লধর্মী মাটিতে ফসফরাস মৌলটি আয়রন এবং এলুমিনিয়ামের সাথে বিক্রিয়া করে ফসফেটের কমপ্লেক্স তৈরী করে বলে গাছ সঠিকভাবে ফসফেট পায়না, ফলে গাছে ফুল ফল কমে যায়। ক্ষারীয় মাটিতেও ক্যালসিয়ামের সাথে জটিল যোগ গঠন করে বলে সহজলভ্য থাকে না।

কীটনাশকের অধিক ব্যবহার এবং জৈব সার ব্যবহার না করে কেবল রাসায়নিক সারের ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল চাষ করতে গিয়ে আমাদের জমিতে অনুজীব বা কেঁচোর সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। অনুজীবের অভাবে ব্যবহৃত ইউরিয়া পূর্ণমাত্রায় গাছের জন্য গ্রহণোপযোগী হতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, বিষয়টি আজ আমরা সকলে একবাক্যে স্বীকার করছি।

জলাবদ্ধ বা সাময়িক খরার সময় ধানের জমিতে সময়মত নাইট্রোজেন না দিতে পারার কারণে ফলন অনেক কমে যায়। আবার লবণাক্ত মাটিতে ইউরিয়েজ এনজাইমের কার্যকারিতা কম থাকার কারণে প্রয়োগকৃত ইউরিয়া হাইড্রোলাইসিস হয়ে এ্যামোনিয়াম আয়ন তৈরী করতে অসুবিধার সন্মুখীন হয়। এছাড়া ফসফেট এবং পটাশ কম গ্রহণ করতে পারে। আবার কপার, আয়রণ, জিঙ্ক এবং ম্যাঙ্গানিজ অনুপুষ্টি উপাদানগুলিও গাছ সহজে গ্রহণ করতে পারে না বলে ভালো ফলন পাওয়া যায় না।

পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান সংক্রান্ত ফোলিয়ার ফিডিং কৌশলের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে এ ধরণের সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা যায় এবং অধিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। পাতার মাধ্যমে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান তরল আকারে প্রদান করলে তা গাছের জন্য হেলথ ড্রিংক্স এর মত (হরলিক্স, বুষ্ট, কমপ্লান, নিডো) কাজ করে থাকে, ফলে গাছ মাটির কিছু সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে পুষ্টি উপাদান নিয়ে সুস্থ এবং সবল ভাবে বেড়ে উঠে  এবং বেশী ফলন দেয়। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বর্তমান সময়ে আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনায় ফোলিয়ার ফিডিং কৌশল প্রয়োগ ব্যতীত তারা ফসল উৎপাদনের কথা চিন্তাও করতে পারে না। আমরা যে সকল বিদেশী ফল খাই তার ১০০% ফোলিয়ার ফিডিং কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহারে উন্নত বিশ্বের ইলেকট্রোস্ট্যাটিক বুম স্প্রেয়ার, হেলিকপ্টার, বিমান এমন কি ড্রোন পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে।

বর্তমান সময়ে আমরা প্রধানত নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে কেবল খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে একটু বেশী চিন্তা করছি। আজ মাঠের দিকে দেখলে দেখা যায় যে ব্রি উদ্ভাবিত ৮৬টি জাতের মধ্যে ১৫-২০ টি জাত মাঠ পর্যায়ে রয়েছে। বোরো মৌসুমের উচ্চফলনশীল ব্রিধান-২৮ এবং ব্রিধান-২৯ এর চেয়ে বেশী ফলনশীল কোন জাত চাষি পর্যায়ে সম্প্রসারণ বা জনপ্রিয় করা এখনও সম্ভব হয়নি। ভারতের আই কিষাণ ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় অন্ধ প্রদেশ এবং তামিলনাড়ুতে ধান গাছের উপরে অতিরিক্ত পরিপূরক হিসাবে মিশ্র তরল সার ব্যবহার করার কারণে ধানের ফলন ১০% বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। এমন আরও অনেক তথ্য অনলাইন থেকে জানা যায়।

তাহলে আমরা যদি আমাদের দেশের কৃষিতে ধান চাষে অতিরিক্ত পরিপূরক খাদ্য হিসাবে মিশ্র তরল সার প্রয়োগের বিষয়ে সুপারিশ করার বিষয়টি চিন্তা করি তা হলে এখনই সকল জাতের ধানের ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব হতে পারে এবং এর ফলে ধানের ফলন ঘাটতি (Yield gap) কমে আসবে। এছাড়া চওড়া পাতাবিশিষ্ট সবজির উৎপাদন অনেক বেশী বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। ফসল উৎপাদনের পাতার মাধ্যমে পুষ্টি (ম্যাক্রো এবং মাইক্রো) প্রদানের মাধ্যমে ফসলের ফলন বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে দেশের সকল গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করা উচিত বলে মনে করি। কারণ, এখন আর হরাইজন্টাল এক্সপানশনের মাধমে ফসলের ফলন বৃদ্ধির কোন সুযোগ তেমন নেই। আমাদেরকে ভাটিক্যালি এক্সপানশন বা প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধমে ফসলের ফলন বৃদ্ধির দিকেই আগাতে হবে। এক্ষেত্রে ফোলিয়ার ফিডিং কৌশলটি অন্যতম সহায়ক প্রযুক্তি হতে পারে।

উন্নত বিশ্বের গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায় যে, ফোলিযার ফিডিং কৌশলের ব্যবহার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে ১০-১৫% নাইট্রোজেন ফসফরাস এবং পটাশ সারের ব্যবহার কমানো সম্ভব। আর আমি কৌশলগতভাবে কিছু ইউরিয়া মাটিতে (৫০-৬০%) এবং কিছু ইউরিয়া পাতায় প্রদান করে বিভিন্ন ফসল উপাদন করে মাঠ পর্যযায়ে প্রমাণ পেয়েছি যে, এভাবে ফসল ভেদে ২০-৩৫% ইউরিয়া সাশ্রয় করেও ভালোভাবে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।  সুতরাং, ফসল উৎপাদনের ফোলিযার ফিডিং প্রযুক্তিটি আমাদের মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে দেশের সম্মানিত নীতিনির্ধধারক এবং গবেষকগণ ভাববেন এটা প্রতাশা রইলো।

লেখক : যুগ্ম পরিচালক (সার), সার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বিএডিসি, রাজশাহী অঞ্চল, রাজশাহী।

ই মেইল : arif.kbd_63@yahoo.com

This post has already been read 4449 times!

Check Also

খামারীদের টাকা নিয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নয়-ছয়ের অভিযোগ!

মো. মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর সংবাদদাতা) : চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ ও উত্তরে ১৬০ জন খামারীর প্রত্যেকের …