শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

মাত্র দুটো ডিম যার পুঁজি, সে এখন লাখোপতি!

মোখোরশেদ আলম জুয়েল: কিছু কিছু সত্য স্বপ্নের মতো। কখনো সখনো তা স্বপ্নকেও হার মানায়। কথায় আছে, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। বড় হওয়ার ইচ্ছাই মানুষকে বড় করে তোলে। তবে আট দশটা মানুষ থেকে প্রতিটা উদ্যোক্তার স্বপ্নের একটা ব্যাতিক্রম থাকে। আপনাদের তেমনই এক স্বপ্নবাজ তরুণ উদ্যোক্তার গল্প শোনাবো যা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।

নাম তার মো. আরিফ বিল্লাহ। বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানার বেতাগা গ্রামে ১৯৯৭ সনের মে মাসের ২০ তারিখে তার জন্ম। পিতা: মরহুম মো. আনিছুর রহমান, মাতা: জেসমিন নাহার। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট। বর্তমানে হাজী আব্দুল মালেক ইসলামিয়া কলেজের মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এই বয়সে সাধারণভাবে এটুকু পরিচয়ই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু স্বপ্নবাজ পরিশ্রমী মানুষেরা সাধারণ পরিচয়কে ছাড়িয়ে যাবেন এটাইতো স্বাভাবিক!

সময়টা ২০০৪ সন, আরিফ তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। একদিন নানা বাড়ীতে বেড়াতে গেলেন। নানামামা বাড়ীতে বেড়াতে গেলে ওই বয়সের ছেলেরা যেখানে নাটাই, লাটিম ইত্যাদি খেলনা সামগ্রী নিয়ে আসে সেখানে আরিফ নিয়ে আসলেন কী না ডিম! হ্যাঁ, হাঁসের মাত্র দুটো ডিম পকেটে করে বাসায় নিয়ে ফিরলেন। নাহ্, আরিফ সেই ডিম দুটো সিদ্ধ কিংবা অমলেট করে খাননি। বরং সেগুলো বাড়ীতে পালা মুরগির কোলে দিলেন বাচ্চা ফোটাতে। সৌভাগ্যক্রমে দুটো ডিমের একটিও নস্ট হলোনা। নির্দিষ্ট সময়ে পেয়ে গেলেন দুটো হাঁসের ছানা। সেই থেকে শুরু হলো আরিফের স্বপ্ন বোনা।

আরিফ যত্ন নিতে থাকলেন হাঁসের ছানা দুটোর। এক সময় হাঁসের ছানা বড় হয়ে নিজেরাই ডিম দিতে শুরু করলো। এবার সেই ডিম বিক্রির টাকা জমিয়ে ক্রয় করলেন এক জোড়া কবুতর। পড়াশোনার পাশাপাশি যত্ন নিচ্ছিলেন হাঁসকবুতরের। হাঁসের ডিম এবং কবুতরের ছানা বিক্রি করে একসময় ৯৫০ টাকা জমলো তার কাছে। এবার স্বপ্নটাকে আরেক ধাপ বড় করার চিন্তা। জমানো সেই নয়শত পঞ্চাশ টাকা নিয়ে গেলেন বাজারে এবং সেখান থেকে কিনে আনলেন একটি ছাগল। এবার হাঁস কবুতরের পাশাপাশি চলতে থাকলো ছাগল পালন। পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন সমান তালে। এর দুই থেকে আড়াই বছর পর হাঁসকবুতর এবং ছাগলের আয় থেকে জমা হলো ১৪ হাজার টাকা। এবার স্বপ্নটাকে আরো বড় করার পালা, তাই একটু বড় সাইজের প্রাণির দিকে মনোনিবেশ করলেন। সেই চৌদ্দ হাজার টাকা দিয়ে বাজার থেকে কিনে আনলেন একটি গরু।

সময়টা ২০০৭ সন। আরিফ তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। পিতা মো. আনিছুর রহমান হঠাৎ মারা যান। কিন্তু আরিফের স্বপ্ন মরেনা। সিদ্ধান্ত নেন নিজের পড়াশোনার খরচ এবার নিজেই চালাবেন। পরিবার কিংবা বড় ভাইয়ের ওপর কোন চাপ সৃষ্টি হোক আরিফ সেটি চায় না। হাঁস, কবুতর এবং গরু পালন করে যা আয় হয় সেটি দিয়েই চলছিল তার পড়াশোনা। অস্টম শ্রেণী থেকেই আরিফ নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালায়।

একটা সময় গরু বাচ্চা দেয়া শুরু করলো। বাড়তে থাকলো গরুর সংখ্যা। সময়টা ২০১৩ সন। আরিফ সেখান থেকে গরুর তিনটি বাচ্চা বিক্রি করে হাতে পেলেন নগদ ৬০৬৫ হাজার টাকা। আরিফের স্বপ্ন আরো ডানা মেলতে থাকে। আশেপাশের বেশিরভাগই যেহেতু মাছ চাষের সাথে জড়িত এবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মাছ চাষ করবেন। তবে কোনকিছু না জেনে বুঝে আরিফ কিছু করতে অনাগ্রহী। তাই, প্রাথমিকভাবে পৈতৃক রেখে যাওয়া ১০ কাঠা আকারের পুকুরের মাঝে শুরু করলেন মাছ চাষ। সেই সাথে অল্প বিস্তর জমিতে ধান চাষ। ব্যাপারকে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে নিলেন।

আরিফের ভাষ্যমতে, গরু বিক্রির টাকা দিয়ে মাছের ঘের শুরু করলাম। প্রথম বছর ঠিকমতো বুঝতে না পারায় মাছে খুব একটা লাভ হলোনা। তারপরেও ১৫২০ হাজারের মতো লাভ হয়েছিল। কিন্তু ধান ভালো হয়েছিল। কিন্তু এর পরের বছর আল্লাহর রহমতে মাছে ভালো লাভ হলো। একেকটা কাতলা মাছের ওজন ছিল প্রায় দুই কেজি, গ্রাসকার্প দুইতিন কেজি, মিরর কার্প .. কেজি, চিংড়ির ওজনও ছিল ভালো।

তিনি আরো বলেন, গত বছর যেসব মাছ ছেড়েছিলাম তার মধ্যে ১০ পিস ব্লাক কার্পও ছিল। সেগুলোর ওজন যখন কেজি হলো তার থেকে ৬টা বিক্রি বাকী ৪টা মাছ রেখে দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে সেগুলোর একেকটার ওজন হয়েছিল ১২১৪ কেজি।

পৈতৃক সম্পক্তি এবং লীজ নেয়া জমি সহ আরিফের এখন বিঘার মতো জমি। সেখানে চলছে মাছ এবং পাশাপাশি ধান চাষ। বড় ঘেরের মাছ এখনো বিক্রি করেননি আরিফ। সেখানে কাতলা, রুই, মিরর কার্প, গ্রাস কার্প, ব্লাক কার্প, বাটা ছাড়াও চিংড়ি রয়েছে। বাড়ির কাছেই ৬০ শতক আয়তনের একটা পুকুর লীজ নিয়েছে সেখানেও কিছুদিন আগে মাছ ছাড়া হয়েছে। সাথে কিছু বড়ো মাছও আছে।

আরিফ বলেন, খরল্লা মাছ ছেড়েছিলাম প্রচুর হয়েছে। মাছগুলো পানির উপর দিয়ে যখন লাফিয়ে বেড়ায় দেখতে কী যে আনন্দ লাগে বুঝাতে পারবোনা।

আরিফের এসব কর্মকান্ডে দারুন খুশি এলাকার বন্ধুবান্ধব সহপাঠীরা। আশেপাশের গ্রাম থেকে শিক্ষিত যুবকেরা তার কাছে আসেন পরামর্শ নিতে। অনেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মাছ ছাষ শুরু করেছেন। কলেজের শিক্ষকেরাও উৎসাহ দেন তাকে।

বছর শেষে আরিফের এখন কয়েক লাখ টাকা আয়। মাছ চাষের পাশাপাশি পোলট্রি ব্যবসা করার ইচ্ছে এখন তার। ইতোমধ্যে এক হাজার মুরগি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন পোলট্রি শেডও তৈরি করেছেন। সময় সুযোগ বুঝে সেখানে মুরগি উঠাবেন। আপাতত এটাকেও পরীক্ষামূলক প্রজেক্ট হিসেবে দেখবেন তিনি।

আরিফ ফুটবল খেলতে খুব ভালোবাসেন। ফুটবলের প্রতি দারুন আসক্তি তার। প্রতিদিন ফযরের নামাজ পড়ে সকালে যান বাজারে দুধ বিক্রি করতে। সেখান থেকে ফিরে নিয়ম করে সবগুলো পুকুরে মাছের খাবার দেন। এরপর যান খুলনায় কোচিং পড়তে। সেখান থেকে ফিরে আবারো পুকুরে। দুপুরে খাবারের পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে চলে যান ফুটবল খেলতে। আল্লাহর রহমত, মায়ের দোয়া এবং মানসিক শক্তিকে নিজের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি মনে করেন তিনি।

আরিফের শখ স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার শখ তেমন কিছু না। তবে আমি যারা বেকার এবং শিক্ষিত তাদের দেখিয়ে দিতে চাই যে, লেখাপড়া শিখলে যে শুধু চাকুরির জন্যে ছুটাছুটি করতে হবে বা শিক্ষা শুধুমাত্র চাকুরির জন্যে এটা ভুল ধারনা। আগামিতে একটা মটরসাইকেল কিনবো রকম একটা শখ বা ইচ্ছা আছে।

This post has already been read 7021 times!

Check Also

ইটভাটাতে বিদেশি ফলের বাগান গড়ে আলোচিত চাঁদপুরের হেলাল উদ্দিন

মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর প্রতিনিধি) : চাঁদপুর শহরতলীর শাহতলী গ্রামে নিজেদের ৬০ বছরের লাভজনক ইটভাটা ছেড়ে …