কৃষিবিদ দীন মোহাম্মদ দীনু (বাকৃবি):
‘সেফ ফিড, সেফ ফুড’ অর্থাৎ নিরাপদ পশু খাদ্যই দিতে পারে নিরাপদ মাংস, দুধ ও ডিম। সে লক্ষ্যে মায়ের জন্য নিরাপদ খাদ্য (মাংস, দুধ ও ডিম) নিশ্চিত করা না হলে শুধু মায়ের স্বাস্থ্যই নয় নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্যেও পড়তে পারে মারাত্মক ঝুকিতে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু পুষ্টি বিভাগ এর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আল-মামুন BAS-USDA PALS -এর অর্থায়নে প্লান্টেইল হার্ব কৃষক পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগীর মাংস উৎপাদনে এবং গাভীর দুধের ফ্যাট এসিড এর গুণগত মান উন্নয়নে কাজ করে সফলতা পেয়েছেন। এজন্য তিনি মানিকঞ্জের সদরে গীলন্ট গ্রামে এক একর জমি লিজ নিয়ে প্লান্টেইল হার্ব চাষ করে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এবং ঐ এলাকার ৬টি ব্রয়ালার ফার্ম গবেষণার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।
প্রধান গবেষক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আল-মামুন এক গবেষণাপত্রে জানান পশুসম্পদ মাংস, দুধ ও ডিমের মাধ্যমে মানুষের অন্যতম পুষ্টি উপাদান, প্রানীজ আমিষ সরবরাহ করে থাকে। পৃথিবীর দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় প্রোটিনের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানী এবং পশু খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গবাদিপশু দ্রুত মোটাতাজাকরনের লক্ষ্যে আশির দশকে শুরু করেছিল গ্রোথ প্রোমোটার বা গ্রোথ হরমোনের ব্যবহার। কিন্তু কালের ধারাবাহিকতায় এসকল গ্রোথ প্রোমোটারের ক্ষতিকারক দিক সম্বন্ধে মানুষ অবহিত হয়। গ্রোথ প্রোমোটার পশুর দেহে ব্যাবটেরিয়ার কার্যকারিতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি সহ বিভিন্নভাবে পশুর মেটাবীলজমের বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে থাকে। কিন্তু এসকল সিনথেটিক এন্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার ব্যবহারের ফলে প্রানীদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। শুধু তাই নয়, এসকল ঔষধ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত পশু পণ্য অর্থ্যাৎ মাংস, দুধ ও ডিম ভক্ষনের ফলে মানুষের মধ্যেও ক্ষতিকারক রেসিডিউয়াল ইফেক্ট লক্ষ্য করা যায়। যার ফলশ্রুতিতে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস সহ দেখা দেয় বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ন্যাচারাল হার্বস হতে পারে স্বাস্থ্যপ্রদ, নিরাপদ মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনের বিকল্প মাধ্যম। ন্যাচারাল হার্বস ইতোমধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রীন গ্রোথ প্রোমোটার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্লানটেইন একটি বহুবর্ষজীবি ঘাস জাতীয় হার্বাল প্ল্যান্ট যার বৈজ্ঞানিক নাম Plantago lanceolata যে কোন ধরনের মাটিতে জন্মায় এবং খরা ও প্রতিকূল পরিবেশেও নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে। এটি ৮ থেকে ২৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাল জন্মায়। উচ্চতা ৪০-৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয় এবং হেক্টর প্রতি উৎপাদন ক্ষমতা ৪-৭ টন। ট্র্যাডিশনাল হিউম্যান মেডিসিন হিসেবে ইউরোপ, আমেরিকা এবং চীনে এই হারবাল প্ল্যান্টের ব্যবহারের রয়েছে শত শত বছরের পুরানো ইতিহাস। মানবদেহে স্বর্দি, কাশি, ঘা, উচ্চ রক্তচাপ সহ ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য ব্যাধিতেও রয়েছে এর কার্যকারিতা । মানবদেহে এই হারবাল প্ল্যান্টের রয়েছে কৃমিনাশক, বেদনানাশক, উচ্চ রক্তচাপনাশক এবং এন্টি ক্যান্সার সহ বিভিন্ন শুভ দিক। অধিকন্তু প্রাণীদেহের সেল বা কোষ ধ্বংস হওয়া থেকেও রক্ষা করে। তাই এই প্লানটেইন বর্তমানে ইউরোপীয় দেশগুলোতে গ্রীন টি (চা) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাপানের মত উন্নত দেশেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে গ্রীন টি এবং লজেন্স এর উপকরণ হিসেবে।
তিনি তার গবেষণাপত্রে আরো উল্লেখ করেণ, এই হার্বস শুধু পশুর উৎপাদন বৃদ্ধিই নয় বরং পশু উপাদান সংরক্ষণে এবং মাংসের গুণাগুণ অর্থাৎ লাল টকটকে রং, ফ্লেভার এবং চর্বির গুনগত মানবৃদ্ধিতেও সহায়তা করবে। মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের সর্বত্রই মানুষ ঝুঁকে পড়ছে অর্গানিক প্রোডাক্টের দিকে। আর তাইতো ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন সহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদিত পশু উপাদানের (মাংস, দুধ ,ডিম) চেয়ে অর্গানিক অর্থাৎ হারবাল খাদ্য খাইয়ে উৎপাদিত পশু উপাদান ক্ষেত্রবিশেষে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
অর্থাৎশিক্ষিত সচেতন মানুষ এখন খাদ্যের গুণগতমানের দিকেই বেশি খেয়ালী হয়ে পরছেন। উন্নত বিশ্বের চিত্র যখন এই তখন আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো হিমসিম খাচ্ছে প্রয়োজনীয় মাংস, দুধ ও ডিমের যোগান দিতে। আমাদের কাছে কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টিটি অর্থাৎ গুনাগুনের চেয়ে পরিমানটাই মূখ্য বিষয়ে পরিণত হয়ে পরেছে। গ্রোথ প্রোমোটারের ব্যবহারের কোন তাৎক্ষনিক বা তড়িৎ প্রতিক্রিয়া বা উপসর্গ নাই। তাই সাধারণ মানুষ এর কুফল/ ক্ষতিকর দিক সহজেই অনুধাবন করতে পারে না। কিন্তু এদের রয়েছে সাইলেনট লিথাল স্ট্রেথ বা ধীর প্রতিক্রিয়া। এজন্য আমাদেরকে এখনই সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে সাধারণ মানুষের মাঝে।