নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকার আগামী ২ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। দিবসটি পালনের অংশ হিসেবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিসেফ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে রবিবার (২৮শে জানুয়ারি) বিএআরসি কনফারেন্স হলে ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে বিরাজমান চ্যালেঞ্জসমূহ এবং করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভার মধ্যে দিয়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে বিশেষ তহবিল গঠন এবং বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, গ্লোবাল গ্যাপ/ কোডেক্স মান এর আলোকে বাংলাদেশ মানদন্ড (গ্যাপ) চূড়ান্ত করা, নিরাপদ খাদ্য বাজারজাতকরণে কমিউনিটি সার্টিফিকেশন এর ব্যবস্থা করা, রাসায়নিক দ্রব্য আমদানী হ্রাস করা ইত্যাদি দাবী তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মাহবুব কবির বলেন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য হবার পর থেকে অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি দেশের খাদ্য পরিস্থিতি বেশ ভয়াবহ। জাতিগতভাবে সম্মিলিতভাবে কাজ না করলে কোন বিকল্প নেই। অনিচ্ছাকৃত ভেজালের চাইতে ইচ্ছাকৃতভাবে ভেজালের পরিমানই বেশি। স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা থেকে শুরু করে কোটিপতিরাও এই ভেজালের সাথে জড়িত। প্রায় সকল পণ্যই সমস্যা আছে। তাই নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে অনুমোদিত ল্যাব থেকে টেষ্ট ব্যতীত কোন পণ্য বাজারজাত করা যাবে না। যদিও অনেক সমস্যা আছে, পর্যাপ্ত ল্যাব নেই। আশা করছি সকলের চেষ্টায় চলতি বছরের মধ্যেই জাতিকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে ভালো খবর দিতে পারবো।
তিনি বলেন, সম্প্রতি বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গুঁড়ো দুধে যে ভারী ধাতু পাওয়া গেছে আমরা সে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছি। ভবিষ্যতে আমরা সচেতনতা তৈরি থেকে কঠোর অবস্থানে যাবো। সারাদেশ থেকে পোলট্রি খামারিদের তালিকা করা হয়েছে তাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা, সচেতন করার উদ্যোগ নেয়া হবে। এ সময় তিনি মতিঝিল, দিলকুশা, পল্টন এবং তোপখানা এলাকার হোটেলগুলোকে ‘গ্রীন জোন’ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন পর্যায়ক্রমে যা সারাদেশে বাস্তবায়িত করা হবে।
তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পটাশিয়াম ব্রোমাইড নিষিদ্ধ হলেও আমাদের দেশে সেটি রুটি, বিস্কুটে অবাধে ব্যবহার করা হচ্ছে। আইনগত দুর্বলতার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছিনা। তবে খুব শীঘ্রই এটি নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়াও আমদানি পর্যায়ে প্রায় ৯০ শতাংশ কীটনাশক কোন প্রকার টেস্ট ছাড়াই দেশের বাজারে প্রবেশ করছে বলে জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে সাবেক খাদ্য মন্ত্রী এবং অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’র সভাপতি, ড. আব্দুর রাজ্জাক, এমপি বলেন এদেশে শোষকেরা দিন দিন কাড়ি কাড়ি অর্থের মালিক হলেও কৃষকরা এখনো বঞ্চিত। বর্তমান সরকার এসব প্রান্তিক কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে ‘খাদ্য ও পুষ্টি’ বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে বলে এ সময় জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, সচেতনতার পাশাপাশি অধিক ভীতিও আমাদের ভেতর কাজ করে। আমাদের ল্যাবগুলোকে আরো বেশি কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়াও পোলট্রি খাদ্যে বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য নিয়ে যে কথা উঠেছিল তা খুবই নিতান্ত পরিমাণ ছিল।
অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক। তিনি বলেন, খাদ্য মানেই নিরাপদ হতে হবে। যেগুলো অনিরাপদ সেগুলো অখাদ্য। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত না হলে সে উন্নতির চূড়ান্ত ফলাফল কী? নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। নিরাপদ খাদ্য আইন সম্পর্কে আমাদের জনগণকে আরো সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে।
বিশেষ অতিথি অধ্যাপক ড. শাহ মনির হোসেন তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন আমরা যখন নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য পুষ্টিমান নিয়ে কথা বলছি তখন আমাদের প্রধান খাদ্য চাল শুধুমাত্র বানিজ্যিক কারণে পলিসিং করে এর পুষ্টিমান ধ্বংস করছি। আবার অন্যদিকে চালের পুষ্টিমান ঠিক রাখার জন্য কৃত্রিমভাবে ফরটিফিকেশন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রাকৃতিক পুষ্টি নষ্ট করে এই ফরটিফিকেশন কোন সমাধান হতে পারে না। কিভাবে প্রাকৃতিকভাবেই পুষ্টিমান ধরে রাখা যায় সেই নীতিমালা নিয়ে কাজ করতে হবে।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয় নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ বাস্তবায়নেও বিসেফ ফাউন্ডেশন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে সম্ভাব্য সহযোগিতা দিতে আগ্রহী। যদিও বিসেফ ফাউন্ডেশন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ‘মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়’। আমরা বাংলাদেশকে একটা বৃহত্তর কারাগার হিসেবে দেখতে চাই না। কাউকে শাস্তি দেয়ার আগে বরং আইন অনুযায়ী বা আইনের আওতায় নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, আমদানী, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় সহায়তা করার বিষয়ে মনযোগী হতে আমরা বিশেষভাবে প্রস্তাব করছি। এছাড়াও আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয় মতবিনিময় সভায় প্রাপ্ত সুপারিশসমূহ সরকারের উর্দ্ধতন মহলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নিমিত্তে পৌঁছানো হবে।
অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক খাদ্য মন্ত্রী এবং অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’র সভাপতি, ড. আব্দুর রাজ্জাক, এমপি। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মাহবুব কবির, এফএও ফুড সেফটি প্রজেক্ট এর সিনিয়র ন্যাশনাল এ্যাডভাইজার অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন, কৃষি ঋণ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক এর মহাব্যবস্থাপক মনোজ কান্তি বৈরাগী। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সাবেক কৃষি সচিব, আনোয়ার ফারুক। মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন বিসেফ ফাউন্ডেশন এর সভাপতি ও ইরি’র সাবেক বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. জয়নুল আবেদীন।
এছাড়াও অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময় সভায় সংশ্লিষ্ট সরকারী-বেসরকারী উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, গণমাধ্যম কর্মী এবং পেশাজীবীগণদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএআরসি এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন, বারি এর সাবেক মহাপরিচালক রফিকুল ইসলাম মন্ডল, বাংলাদেশ ব্যাংক এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুভঙ্কর সাহা, পরিচালক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ড. তাজুল ইসলাম, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন এর সহকারি মহাব্যবস্থাপক কৃষিবিদ মিটুল কুমার সাহা, সিডিসিএস এর ব্যবস্থপনা পরিচালক ফারজানা মোর্শেদ প্রমুখ। বক্তাগণ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চতকরণে করণীয় বিষয়ক তাদের সুপারিশসমূহ তুলে ধরেন।