রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪

সংরক্ষণশীল কৃষি : চাষাবাদের নতুন দিগন্ত

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত। কৃষি বিজ্ঞানের উন্নতির মাধ্যমে বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হলেও প্রাকৃতিক সম্পদ (জমি, পানি) কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। শুধু তাই নয়, অধিক উৎপাদনের জন্য জমিতে মাত্রাতিরিক্ত বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে পাশাপাশি পানি দূষিত হচ্ছে। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে কৃষি কাজ মারাত্মক হুমকির সম্মুক্ষীন হবে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৃষি কাজ টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন কৃষি কাজের ধরনের পরিবর্তন ও সচেতনতা বৃদ্ধি। যাতে প্রাকৃতিক সম্পদেরও ক্ষতি না হয় এবং ফসল উৎপাদন সম্ভব হয়। এজন্য আধুনিক বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে চালু করা হচ্ছে সংরক্ষণশীল কৃষি বা সুরক্ষা কৃষি। এটি মূলত একটি চাষাবাদের পদ্ধতি যার মাধ্যমে স্বল্প চাষে পূর্ববর্তী ফসলের কিছু অবশিষ্টাংশ রেখে কম সময়ে ও কম খরচে লাভজনকভাবে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।

সংরক্ষণশীল কৃষির সুবিধা সমুহ
– কম চাষ জমির রস সংরক্ষণ করে, ক্ষয় রোধ করে ও মাটির উর্বরতা বাড়াতে সহায়তা করে।
– অধিক চাষে খরচ ও সময়ের অপচয় হয় কিন্তুু কম চাষে খরচ কম হয় সময়ের অপচয় কম হয়।
– শ্রমিক কম লাগে ফলে উৎপাদন খরচ কম হয়।
– জমিতে নাড়া রাখার ফলে জমিতে জৈব পদার্থ যোগ হয়।
– মাটির পানি ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং লবণাক্ততা কমাতে সাহায্য করে।
– ধান, গম, ভুট্টা, ডাল শস্য এমনকি পাটও চাষ করা যায়।
– স্বাভাবিক চাষের চেয়ে আগাম বীজ বপন করা যায় যা শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
– সংরক্ষণশীল কৃষি সময়, সেচ, শ্রমিক, সার, বীজ সর্বোপরি উৎপাদন খরচ সাশ্রয় করে এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

সংরক্ষণশীল বা সুরক্ষা কৃষি এর মূলনীতি ৩টি
১. যথাসম্ভব কম চাষ করে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং মাটির রস বজায় রাখা।
২. মাটির রস ধরে রাখতে পূর্ববর্তী ফসলের কিছু অবশিষ্টাংশ মাটির উপরীভাগে রেখে দেওয়া।
৩. ধান এবং অন্যান্য ফসলের মধ্যে লাভজনক শস্য পর্যায় অবলম্বন করা।

সংরক্ষণশীল কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার
– পূর্ববর্তী ফসল সংগ্রহের পর জমিতে ৩০% (২০ -৩০ সে.মি.) নাড়া রেখে দিবেন।
– জমিতে ফসল লাগানোর আগে যদি জমিতে আগাছা থাকে তাহলে স্প্রেয়ার মেশিনের সাহায্যে নিরাপদভাবে আগাছানাশক ব্যাবহার করে আগাছা দমন করুন।
– সহজলভ্য যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করে সংরক্ষশীল কৃষি অনুশীলন করা যেতে পারে, যেখানে জমির চাষ কমবে এবং একই সাথে বীজ বপন ও সার প্রয়োগ করা যাবে।
– পাওয়ার টিলারের সাথে স্ট্রিপ টিলার, সিডার সংযুক্ত করা হয়। এতে একই সাথে জমি তৈরি, বীজ বপন ও সার প্রয়োগ করা যায়।

অধিক চাষে অধিক ফসল এ ধারনাটি প্রচলিত থাকলেও আধুনিক কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে বার বার চাষের ফলে মাটির গঠন কাঠামো নষ্ট হয় সাথে সাথে মাটিতে বিদ্যমান পানি ও খনিজ পদার্থ সমূহের গুণাগুণ নস্ট হয়। এতে জমির উর্বরতা কমে যায়। এছাড়াও অধিক চাষের ফলে মাটির নিচে একটি প্লাউ প্যান বা শক্ত স্তর তৈরি হয় যার ফলে শস্যের শিকড় এই স্তর ভেদ করে নীচের দিকে যেতে পারেনা, ফলশ্রুতিতে পানি ও পুষ্টি উপাদান আহরনের সুযোগ কমে যায়। তাছাড়া বৃষ্টির পানির নিম্নমুখী প্রবাহ কমে যায় ফলে ভূপৃষ্ঠ প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এতে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পায় ও জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। এছাড়া পানির নিম্নমুখী প্রবাহ কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের পুনঃভরাট কম হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে শূন্য চাষ ও স্ট্রিপ চাষ ব্যবহার করা যেতে পারে। স্ট্রিপ চাষ পদ্ধতিতে জমিতে সরু লাইনে চাষ করা হয় যেখানে বীজ বপন ও সার প্রয়োগ করা হয় এবং দুই লাইনের মাঝের জমি চাষের দরকার হয়না। শূন্য চাষ পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় স্থানে মাটি চিরে বীজ বপন করা হয়। আধুনিক এই পদ্ধতিতে কম খরচে লাভজনকভাবে ফসল উৎপাদন করা যায়।

সুরক্ষা কৃষির আরেকটি মূলনীতি হলো পূর্ববর্তী ফসল সংগ্রহের পর জমিতে ৩০% (২০-৩০ সে.মি.) নাড়া রেখে দেয়া। জমিতে নাড়া রাখার ফলে জমিতে জৈব পদার্থ (যেমন- ফসফরাস) যোগ হয়, মাটির পানি ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশে অধিকাংশ জমি মূলতঃ ধানভিত্তিক কৃষি বিন্যাসের আওতাভূক্ত। বার বার ধানের পর ধান চাষ করলে ফসলের শিকড় মাটির একটি নির্দিষ্ট স্তর হতে খাদ্য সংগ্রহ করে এবং এ ঘাটতি মেটাতে বেশি বেশি সার প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু ধান এবং অন্যান্য ফসলের সমন্বয়ে লাভজনক শস্য পর্যায় অবলম্বন করা গেলে কৃষকরা লাভবান হবে। এছাড়াও ধান কর্তনের পর সাধারণত কৃষকরা জমি ফেলে রাখে এবং অনেকে চাষ দিয়ে জমি ফেলে রাখে এতে জমির রস হারিয়ে যায় এজন্য পরবর্তী ফসলে যাবার সময় পুনরায় সেচ দিয়ে জমিতে জো আনতে হয়। এর পরিবর্তে সুরক্ষা কৃষির অনুসরন করে, জমি ফেলে না রাখে যদি শূন্য চাষ ও ফালি চাষ ব্যবহার করে পরবর্তী ফসলে যাওয়া হয় এতে খরচ সাশ্রয় হয় এবং সঠিক সময়ে আরেকটি মধ্যবর্তী ফসল চাষ করে ঘরে তোলা সম্ভব হয়। সুপরিকল্পিকভাবে সুরক্ষা কৃষির প্রয়োগ ঘটালে কৃষকরা লাভবান হবে ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৃষি সুরক্ষিত থাকবে।

লেখক: মো. আকতারুল ইসলাম, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা  এবং ড. মো. হোসেন আলী, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষি প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ-২২০২।

This post has already been read 5460 times!

Check Also

খামারীদের টাকা নিয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নয়-ছয়ের অভিযোগ!

মো. মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর সংবাদদাতা) : চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ ও উত্তরে ১৬০ জন খামারীর প্রত্যেকের …