শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

সুপেয় পানির ভোগান্তিতে শোভনা গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ

ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা): ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানির অভাবে ভোগান্তিতে খুলনার শোভনা গ্রামের প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ। প্রচন্ড গরমের তাপপ্রবাহ এবং কৃষি কাজের জন্য অতিমাত্রায় সেচ পাম্প দিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। এতে পানির স্তর (লেয়ার) নিচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থা সৃস্টি হয়েছে। জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ৭নং শোভনা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের খাওয়ার যোগ্য এক কলসি পানির জন্য দির্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। তারপরই মিলছে তাদের পানি। আর যারা ক্লান্ত শরীরে দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিতে পারছেন না, যাদের সচ্ছল পরিবার তারা নগদ টাকার বিনিময়ে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন। এভাবেই গ্রীষ্মে পানি সংগ্রহে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাদের।

প্রচন্ড গরমের তাপপ্রবাহ এবং কৃষি কাজের জন্য অতিমাত্রায় সেচ পাম্প দিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। এতে পানির স্তর (লেয়ার) নিচে নেমে গেছে। এ কারণে গ্রামের অধিকাংশ ডিপ-টিউবওয়েলেই (নলকূপ) পানি উঠছে না, পরিত্যক্ত হয়ে পড়ছে অনেক টিউবঅয়েল। এ অঞ্চলের লবণাক্ততায় পুকুরের পানিও পানের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ফলে সুপেয় পানির অভাবে ভোগাস্তিতে পড়তে হচ্ছে কয়েকটি গ্রামের ৪০ হাজারের বেশি মানুষকে। ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গড়ে উঠেছে ডুমুরিয়া উপজেলার ৭নং শোভনা ইউনিয়নটি। ৪০ হাজার জনসংখ্যার ঘনবসতিপূর্ণ এ ইউনিয়নে ভোটার রয়েছেন ১৮ হাজার। কিন্তু চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচন্ড খরা ও কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য অতিমাত্রায় সেচ পাম্প স্থাপনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বেশিরভাগ নলকূপে পানি উঠেছে না। গৃহস্থালির কাজে পুকুর, নদী ও খালের লবণাক্ত পানি ব্যবহৃত হলেও বাদুরগাছা ও বাগাছড়াসহ প্রতিটি গ্রামেই সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অন্য এলাকা থেকে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের।

স্থানীয় ইউপি সদস্যরা জানান, শোভনা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে ৫০টির অধিক গভীর নলকূপ রয়েছে। এসব নলকূপের গভীরতা অন্তত ৫৩০ ফুট। কিন্তু বর্তমানে মাত্র একটি নলকূপে পানি উঠছে। বাকিগুলোয় পানি উঠছে না। ফলে ১০ কিলোমিটার দূরে কাঁঠালতলা বাজার থেকে খাবার পানি আনতে হচ্ছে। অথবা সেচ পাম্প থেকে ৫০ লিটার পানি ২০ টাকা দরে কিনে আনতে হচ্ছে। ফলে জনসাধারণের ভোগান্তির শেষ নেই। পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ওয়ার্ডেও বাদুরগাছা ও বাগাছড়া গ্রামের ১৫টি ডিপ-টিউবওয়েলের একটিতেও পানি উঠছে না। জনদুর্ভোগ এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, নারীরা অনেক দূরে গিয়ে খাবার পানি আনছেন। এটা খুবই কষ্টসাধ্য। ধানে পানি দেওয়ার শ্যালো বরিংগুলোয়ও পানি উঠছে না। শিগগিরই বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্থ হয়ে পড়বে। সংকট উত্তরণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

বাদুরগাছা গ্রামের গৃহবধূ স্বপ্না বলেন, উত্তরপাড়ার ডিপ-টিউবওয়েলে (নলকূপ) পানি উঠছে না। তাই দুই গ্রাম ডিঙ্গিয়ে দক্ষিণপাড়ায় পানি নিতে এসেছি। কিন্তু এখানেও টিউবওয়েলে ভালো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এক কলসি পানি ভর্তি করতে সময় লেগে যাচ্ছে আধাঘণ্টা। চাপতে চাপতে ক্লান্ত হয়ে পড়তে হচ্ছে। এত কষ্ট আর সহ্য হয় না। বাগাছড়া গ্রামের গৃহবধূ আরতি বলেন, খাবারের অভাব নেই। কিন্তু খাবার পানি নেই। অধিকাংশ নলকূপে পানি উঠছে না। এলাকা যেন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। দুইবার বিশ্রাম নিয়েও এক কলসি পানি ভরা যাচ্ছে না। স্থানীয় পল্লীশ্রী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের পাশের টিউবওয়েলে গ্লাস আর প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে পানি নিতে দেখা যায় ওই বিদ্যালয়ের পাঁচ থেকে ছয় শিক্ষার্থীকে। তারা জানায়, কল চাপতে চাপতে হাঁফিয়ে উঠছি। কিন্তু পাত্রে পানি ভর্তি করা যাচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দা স্বর্ণা রায় বলেন, পানির কষ্টে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আগে দুই থেকে তিন মিনিটে একটি কলসি ভর্তি করা যেত। কিন্তু এখন আধাঘণ্টায়ও কলসি ভরা সম্ভব হচ্ছে না।

ঢাকায় অবস্থানরত স্থানীয় বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী আলী বাদশা জানান, সম্প্রতি তিনি সপরিবারে গ্রামে বেড়াতে আসেন। কিন্তু সুপেয় পানি সংকটের কারণে তার শিশুকন্যা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে একদিন থেকেই ফিরে যান তিনি। তিনি বলেন, সত্যিই এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে শোভনায়। জিয়ালতলা ও শোভনার বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করে মিষ্টি পানি উত্তোলন করায় ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত এসব গভীর নলকুপ বন্ধের পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে খাবার পানি পাওয়া দুষ্কর হবে। তিনি মাছ চাষে অতিমাত্রায় মিষ্টি পানির ব্যবহার বন্ধের আহ্বান জানান।

শোভনা ইউপি চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত বৈদ্য বলেন, ৪০ হাজার জনসংখ্যার জন্য তার ইউনিয়নে পাঁচ শতাধিক নলকূপ রয়েছে। কিন্তু প্রচন্ড খরা ও কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য অতিমাত্রায় সেচ পাম্প স্থাপনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপ এখন পানিবিহীন হয়ে পড়েছে। ফলে সুপেয় পানির অভাবে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন থেকে কৃষি কাজে খাল ও নদীর পানি ব্যবহারে কৃষককে উৎসাহিত করা হবে। ফলে আগামীতে সমস্যার উত্তরণ ঘটবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক হাসান বলেন, শোভনা ইউনিয়নে পানি সংকটের বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে পানির এ সমস্যা সাময়িক। বৃষ্টি হলেই সমাধান মিলবে। এছাড়া বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

This post has already been read 2700 times!

Check Also

ভেটেরিনারি ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ভ্যাব) এর বিক্ষোভ সমাবেশ

ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামলীগের বিদায়ের তিন মাস অতিক্রান্ত হলেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে …