বৃহস্পতিবার , নভেম্বর ২১ ২০২৪

খুলনায় ভৈরব-রূপসা নদীর জমি দখল ও পানি দূষণের চলছে মহোৎসব

ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা): খুলনার ভৈরব নদী দখল ও দুষণ প্রতিরোধে সরকারী সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ও কেসিসির টেকসই পরিকল্পনায় বাস্তবমুখী কোন প্রকল্প গ্রহন না করায় রূপসা ও ভৈরব নদী এখন প্রতিনিয়ত ভুমিদস্যু, দূষণকারীদের বিচরন ক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে। ভৈরব নদীর দুপারের প্রায় ২শ একর সম্পত্তি বিআইডব্লিউটিএ এর হলেও তা নিয়ন্ত্রন করছে স্ব-স্ব স্থানের উপজেলা ও জেলা প্রশাসন। নদীর দুই তীরের ভুমিদস্যুদের কালো থাবায় নদী হারাচ্ছে তার প্রশস্ততা। নদীর পাড়ে অবৈধভাবে দখল পূর্বক স্থাপনা নির্মান চলছে, পাশাপাশী চলছে নদীর পাড় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পানি প্রবাহের পাড় হতে ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত বালি, মাটি ও ময়লা আর্বজনা ফেলে দখল পূর্বক স্থাপনা নির্মান।

আর এই অবৈধ স্থাপনা নির্মান চলাকালে সংশ্লিষ্ঠ প্রশাসন ও কর্তা ব্যক্তিরা থাকেন নিরব দর্শকের ভুমিকায়। নদী ভরাটের দখলকৃত জমিতে স্থাপনা নির্মান করে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের মোটা অংকের উৎকোচ দিয়ে ডিসিআর করে তার বৈধতা প্রাপ্তি হন। ডিসিআর কাটা সম্পত্তি আইনত অন্যত্র হস্তান্তর, বিক্রয় ও ভাড়া দেয়া নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও খুলনার বড় বাজারের স্থানীয় অনেক প্রভাশালী ব্যক্তিরা এ কাজটি করেন নির্দিধায়। তাদের এ কাজে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন জেলা প্রশাসনের সম্পত্তি শাখার কতিপয় ব্যক্তি। ভৈরব নদীর পাড় দখল ও ডিসিআর দিয়ে তিনি বনে গেছেন শত কোটি টাকার মালিক। বিগত জেলা প্রশাসকের এক সভায় বিআইডব্লিউটিএ এর কর্মকর্তারা সরাসরি অভিযোগ করে তার অপতৎপরতা থামাতে পারেনি। নদীর পাড় দখল ও নদী ভরাটে ঐ কর্মকর্তার সাথে রয়েছে দখলদারদের গভীর সখ্যতা। মাঝে মধ্যে নোটিশ দান ও ঢাক ডোল পিটিয়ে নদীর দ’ুপাড়ে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের উদ্দ্যোগ নেয়া হলেও পরে সেটা আর কার্যকর হয়না। আর এই অসাধু কর্মকর্তাদের দৌড়াত্বেই ভৈরব ও রুপসা নদী দখল ও দুষণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না ।

বিআইডব্লিটিএ এর একটি সুত্র জানায়, লবণচরা থেকে মজুদখালী পর্যন্ত রূপসা ও ভৈরব নদীর দুই তীরে পাঁচ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। বুড়িগঙ্গার মত করুণ পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে খুলনা ভৈরব নদ। আর অর্থ পিচাশদের মলমুত্র ইতিমধ্যে নদীর পানিকে বিষিয়ে তুলেছে। তবে মানুষের মতো চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাতে না পারলেও ভৈরব ও রূপসা নদী যে সারাক্ষণ কেঁদেই চলেছে তা দেখলেই বুঝা যায়। যদিও তাদের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পারলেও অবৈধ অর্থ পকেটস্থ করে তারা ঠুটো জগন্নাথ হয়ে আছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন সচেতন নাগরিক সমাজ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা টাউন প্রোটেকশন প্রজেক্টের কোন অগ্রগতি নেই। খেয়াল রাখেননি এ অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মেয়র এমপিরাও। সরকার প্রধানও গুরুত্ব দেননি বিভাগীয় শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী ভৈরব ও রুপসা নদী রক্ষায়। এ নিয়ে খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি ও পরিবেশবাদীরা বারবার তাগাদা দিলেও তার কোন সুফল দেখতে পায়নি এ অঞ্চলের মানুষ ।

সূত্রমতে, খুলনা মহানগরীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা রূপসা ও ভৈরব নদীর পানি ব্যাপক দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। নদীর তীরে অবস্থিত ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প-কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, কঠিন বর্জ্য, ঝুলন্ত পায়খানায় নির্গত মানব বর্জ্য, শত শত ড্রেন বেয়ে আসা ময়লা আবর্জনা বিষিয়ে তুলছে এ দু’টি নদীর পানি। এছাড়া অবৈধভাবে খাল ও নদী দখলের প্রতিযোগিতায় প্রতিনিয়ত সংকুচিত হয়ে আসছে ভৈরব ও রুপসা নদী এবং এর বিভিন্ন শাখা খাল। ভুমিদস্যুদের দখলে অনেক খাল এখন আর খাল নেই। যে খালগুলো আছে তাও নামে খাল, দেখতে ড্রেন এর মত। এ অঞ্চলের পরিবেশবিদদের আশংকা নদী দূষণ ও দখলের প্রতিরোধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে রূপসা ও ভৈরবের পরিণতি হবে ঢাকার বুড়িগঙ্গার ন্যায়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর তিন দিক নদী দ্বারা বেষ্টিত। নগরীর পাশে রয়েছে রূপসা, ভৈরব, ময়ূর ও কাজীবাছা নদী। ভৈরব ও রূপসার দুই তীরে ফিস্ প্রসেসিংসহ ৫৩টি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে ৪০টির। এসব প্রতিষ্ঠানের রাসায়নিক বর্জ্য রপসা ও ভৈরব নদীর পানিতে মিশছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জ্য শোধন করে তা নদীতে ফেলার নিয়ম থাকলেও খরচ বাঁচাতে অনেক প্রতিষ্ঠান সে নিয়ম মানছে না। এ ছাড়াও নগরীর দৌলতপুর-খালিশপুর এলাকায় পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নামে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-এর তিনটি তেলের ডিপো ধোয়া-মোছার পর সেই তেলযুক্ত পানি সরাসরি চলে যাচ্ছে ভৈরব নদে। পরিবেশবিদদের মতে ভেঁসে থাকা তেলের কারণে সূর্যের আলো নদীর পানির নিচের স্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। ফলে মাছ ও জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘিœত হওয়ার পাশাপাশি মৎস্য পোনার নার্সারী গ্রাউন্ড ধংস হচ্ছে।

এছাড়া ভৈরব ও রূপসা নদীর দুই তীরে রয়েছে ছোট বড় প্রায় ২০টি পাটকল। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্জ্যও মিশে যাচ্ছে নদীর পানিতে। খুলনা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, খুলনা পাওয়ার, বার্জমাউন্টটেড প্লান্ট, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, জুট প্রেস হাউজ, দৌলতপুর বাজার, ইস্পাহানী ঘাট, চন্দ্রপুরী জুট প্রেস, দেয়ারা বাজার খাল দখল পূর্বক দোকানপাট নির্মান, ফুলতলা বাজার, বিসিক এলাকা, লবন ফ্যাক্টরী, সার লোড-আনলোড ও ম্যাচ ফ্যাক্টরীর রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে ফেলার অভিযোগ রয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী নদী দূষণের জন্য আরেকটি কারণ হলো সিটি কর্পোরেশনের শত শত ড্রেনের পানি কোন ধরনের শোধন ছাড়াই সরাসরি নদীতে গড়িয়ে পড়া। এছাড়া নদীর তীরে রয়েছে অসংখ্য ঝুলন্ত পায়খানা। যেভাবে দূষিত পানি, বর্জ্য ও রাসায়নিক দ্রব্য নদীতে পড়ছে তাতে পানি আর বেশিদিন ব্যবহারের উপযোগী থাকবে না এমন আশংকা পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার। ঐ কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি একটি বেসরকারি সংস্থা অভয়নগর থেকে মংলা পর্যন্ত নদীর দু’পাড়ে পানি দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা তৈরি করছে। সহসাই তালিকাভুক্ত ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্কীকরণ নোটিশ দেয়া হলেও নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশ স্বাধীনের পর থেকে খুলনায় নদী ও খাল দখলের চলছে মহোৎসব। রূপসা ও ভৈরবের দীর্ঘ ২২ কিলোমিটার তীর ভূমির অধিকাংশ স্থান অবৈধ দখলদারদের কবলে। হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক কয়েকটি কারখানা, পাথর ভাঙ্গা প্রতিষ্ঠান, তেল ডিপো, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, লবন ফ্যাক্টরী, জুট প্রেস হাউজসহ বেশ কিছু দোকানপাট, বস্তি বাড়ি গড়ে উঠছে নদীর তীর দখল করে। খুলনার সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার ‘বড় বাজার’ এর একটি বড় অংশ নদী দখল করে আছে ব্যবসায়ীরা। বিআইডব্লিউটিএ ইতোপূর্বে একাধিক নদী দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে। ঐ তালিকা অনুযায়ী রূপসা ও ভৈরব নদীর তীরে কমপক্ষে ৫ শতাধিক অবৈধ দখলদার রয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রমতে, নদীর দু’তীরে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারের সর্বোচ্চ জলরেখা থেকে ৫০ গজ উপর পর্যন্ত জমি বিআইডব্লিটিএ’র। এসব জমিতে অবৈধ্য স্থাপনা গড়তে হলে তাদের বিআইডব্লিটিএ’র লাইসেন্স করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে নগরীর লবণচরা থেকে মজুদখালী পর্যন্ত রূপসা ও ভৈরব নদীর দুই তীরে পাঁচ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠে। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ যখন অবৈধ স্থাপনা ও দখলদ্বারদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করে, তখন স্থাপনার প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক দখলদারগন সিটি করপোরেশন অথবা জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দকৃত কাগজপত্র প্রদশন করে। ফলে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া হয় ব্যাহত। এভাবে নদীর তীর ভূমির মালিকানা নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ, জেলা প্রশাসন ও কেসিসি রশি টানাটানিতে লাভবান হচ্ছে অবৈধ দখলদাররা,

অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব, প্রকৃতি হারাচ্ছে স্বকীয়তা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকা, আধাপাকা ও কাঁচা স্থাপনা। ময়ূর নদী দখল করে পাকা ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। কাজিবাছা ও ময়ূর নদীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধ দখল ও নদীতে নানা বর্জ্য ফেলে নদীকে করছে সংকুচিত এবং পানি হচ্ছে দূষিত। এছাড়া ভৈরব নদীর গভীরতা হ্রাস পেয়েছে। গভীরতা হ্রাস পাওয়ায় নদীতে পলি ও বর্জ্য দ্বারা অব্যাহতভাবে ভরাট হচ্ছে। কাজীবাছা নদী দখল করে মাছের ঘের, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা নির্মাণ এবং শুকনা মৌসুমে ধান চাষ করা হয়। জানা যায়, বিভিন্ন সময় অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারী সংস্থা দীপ্ত আলোর প্রধান নির্বাহী হাসানুর রহমান বলেন, ১৯৯৭ সালের প্রণীত পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে বলা হয়, প্রতিটি শিল্প কারখানার জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বাধ্যতামূলক। পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো কারখানায় বিদ্যুৎ এবং গ্যাস-সংযোগ দেওয়া যাবে না। কিন্তু কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রূপসা, ভৈরব ও ময়ূরের তীরে শত শত কারখানা গড়ে উঠেছে। নদীর পানিতে প্রতি লিটারে ৪ মিলিগ্রামের বেশি অক্সিজেন থাকার কথা। কিন্তু তা বাস্তবে নেই। এ ছাড়া নদীতে মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক সিসার পরিমাণও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলছে। ইনভারমেন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ই,টি,পি)’র ছাড়পত্র ছাড়াই নদীর দু’পাড়ে গড়ে ওঠা ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান । তবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের ই,টি,পি থাকলেও খরচ বাড়ার ভয়ে তা ব্যবহার করে না প্রতিষ্ঠান গুলো। এ বিষয় দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তা ব্যক্তিরা অজ্ঞাত কারণে বরাবরই নীরব থাকেন। তিনি নদী দূষণ ও দখল রোধে ঢাক-ঢোল না পিটিয়ে ঝটিকা অভিযানের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআইডব্লিটিএ ও জেলা প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান।

This post has already been read 3214 times!

Check Also

ভেটেরিনারি ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ভ্যাব) এর বিক্ষোভ সমাবেশ

ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামলীগের বিদায়ের তিন মাস অতিক্রান্ত হলেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে …