রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪

খুলনার এফআর জুট মিল দ্রুত চালু করার দাবি শ্রমিকদের

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা): অগ্নিকান্ডে শত কোটি টাকার ক্ষতিগ্রস্থ খুলনার এফ আর জুট মিলটি দ্রুত চালুর দাবি শ্রমিকদের। সম্পুর্ণ রপ্তানিমুখী এ জুট মিলটি দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৪২ মেট্রিকটন সূতা। খুলনা বাইপাসে এ শিল্পটি স্থাপিত হওয়ায় প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার নারী পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি জনমানুষ শুণ্য এ অঞ্চলে প্রাণ চাঞ্চল্যের পাশাপাশাশি অবকাঠামো ও বিভিন্ন ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। শতভাগ রপ্তানি নির্ভর এ জুট মিলটি প্রতিষ্ঠা করেন দেশের কাঁচাপাট রপ্তানি শিল্পে অবদান রাখায় বিভিন্ন অর্থ বছরে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদক প্রাপ্ত সিআইপি আলহাজ্ব ফজলুর রহমান শরীফ। এ শিল্পোদ্যোক্তা রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের অর্থায়নে এফআর জুট মিলটি চালু করেন। মিলটির উৎপাদন শুরু হওয়ায় ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন ৩টি শিফটে শ্রমিকরা কাজ করে। শ্রমিকদের সুরক্ষায় মিল কর্তৃপক্ষ পরিবহন, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়।

গত মঙ্গলবার (২৭মার্চ) দুপুর আনুমানিক পৌনে ৩টায় খানজাহান আলী থানাধীন খুলনা-যশোর বাইপাস সড়কে বিকেএসপি অদূরে অবস্থিত মিলটিতে এ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট এবং বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর একটি ইউনিটসহ মোট ৮টি ইউনিট প্রায় সোয়া ৩ ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুণ নিয়ন্ত্রণে আনে। অগ্নিকান্ডে গুদিমগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ড্যাম্পিং ডাউনের কাজ করছিলেন। ভায়াবহ এ অগ্নিকান্ডে হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনায় মিলটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় একশত কোটি টাকা ।

মিল শ্রমিকরা জানায়, সিআইপি আলহাজ্ব শরীফ ফজলুর রহমানের মালিকানাধীন এফআর জুটমিলে মঙ্গলবার (২৭মার্চ) দুপুরের শিফটে কাজ করছিলেন তারা। মিলের ইউনিট-২ (নবনির্মিত), বর্তমানে ব্যবহৃত পাটের গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন পার্শ্ববর্তী অন্যান্য গোডাউনে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকরা আগুন নিয়ন্ত্রণে নিজেদের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে কাজ শুরু করে। এরপর ফায়ার সার্ভিসকে সংবাদ দেয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট ও বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর একটি ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। টহলরত র‌্যাবের একটি টিম ও খানজাহান আলী থানার পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে যায়। এদিকে আগুনের তীব্রতায় মিলের অধিকাংশ পাট গোডাউনের টিনের ছাউনী এবং দেওয়াল ধসে পড়ে।

মিলের মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগের সহকারি কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জানান, অগ্নিকান্ডের দিন সকালে মিলের ভেতরে নতুন করে ৬ ট্রাক পাট মিলের ৩, ৪ ও ৫নং গোডাউনে রাখা হয়েছে সেগুলো ও আগুণে পুড়ে গেছে। এছাড়া নতুন নির্মিত গোডাউনে মিলের ইউনিট-২ গোডাউনটি বর্তমানে মিলের ৫/৬ মাসের উৎপাদিত ফিনিশিং গুডস (উৎপাদিত পণ্য) রফতানীর জন্য প্রস্তুত রাখা ছিলো। তিনি আরো বলেন, ৬ মাসের উৎপাদিত সূতার স্পেল ও টোন যা সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। তবে মিল কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে খানজাহান আলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরীতে উল্লেখ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শ্রমিক জানায়, মিলে প্রতি শিফটে প্রায় ৭শ শ্রমিক কাজ করে। দুপুরের শিফটে শ্রমিকরা কাজ করছিল।

অগ্নিকান্ডের দিন ঘটনাস্থলে আগুন নিয়ন্ত্রণের নেতৃত্বে থাকা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনা সদর দপ্তরের সহকারি পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘পৌনে ৩টার দিকে আগুন লেগেছে। সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিক নিকটবর্তী খানজাহান আলী ফায়ার স্টেশনের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রনের কাজ শুরু করে। তবে আগুনের ভয়াবহতা দেখে আরো ৬টি ইউনিট পাঠানো হয়। সর্বমোট ৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রনে কাজ করে। এখানকার চারটি গোডাউনে আগুন ছড়িয়ে গেছে। তবে ফায়ার সার্ভিসের দ্রুত পদক্ষেপের কারণে আশপাশের ফ্যাক্টরী ও অন্যান্য গোডাউন রক্ষা করতে পেরেছি। আগুনের উৎসটা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। এছাড়া আগুনের উৎসটা খুঁজে বের করে তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তীতে আমরা বলতে পারবো। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো বলা সম্ভব হচ্ছে না তবে মিলের ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এ ব্যাপারে মিলের ব্যবস্থাপক জানান, ‘আগুন নিয়ন্ত্রনে এসেছে ঐদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে। তবে এখনও ৫টি ইউনিট ড্যাম্পিং ডাউনের কাজ করছে। বাকী দু’টি ইউনিট ফেরত পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে নৌ-বাহিনীর ফায়ার ইউনিটের সাথে থাকা দায়িত্বরত পেটি অফিসার (পিও/আর) আবু হায়াত মো. সোহেল বলেন, ‘সংবাদ পেয়ে আমাদের একটি ইউনিট এবং দু’টি সাহায্যকারী ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রনে কাজ করেছে। এ অগ্নিকান্ডের ফলে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কর্মচারীরা বেকার হয়ে পড়ছেন। শ্রমিকদের দাবী অবিলম্বে মিলে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের কর্মপরিবেশ তৈরিতে মিল সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলো অগ্নিকান্ডের ক্ষতিপুরণ পূর্বক মিলটি দ্রুত চালুর পদক্ষেপ গ্রহণে সকলের প্রতি আহবান জানান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এফআর জুট মিলস লিমিটেডের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক করপোরেট শাখায় মোট ১০০ কোটি টাকা ঋণ আছে। এর মধ্যে প্লেজ লোন ৭০ কোটি টাকা এবং হাইপো লোন রয়েছে ৩০ কোটি টাকা। এছাড়াও মিল প্রজেক্টে ব্যাংকের ঋণ বিনিয়োগ রয়েছে। সোনালী ব্যাংক করপোরেট শাখার সূত্র জানায়, ব্যাংকের রেকর্ড অনুযায়ী মিলটিতে আগুন লাগার আগ পর্যন্ত গুদামে পাট ছিল ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫০১ মণ এবং মিলের উৎপাদিত রপ্তানিযোগ্য পাটপণ্য-সূতা (সিআরটি) মজুত ছিল ১ হাজার ৮২৬ মেট্রিক টন, যার ব্যাংক মূল্য (অগ্রিম) ৬৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং বর্তমান বাজার মূল্য ৮৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। মিলটির দৈনিক উৎপাদন মতা প্রায় ৪০ থেকে ৪২ মেট্রিকটন টুয়াইন সূতা। আর এ উৎপাদিত সূতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রপ্তানি শিল্পে বিশেষ অবদান রাখায় বেশ কয়েক বছর বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের ( সিআইপি) মর্যাদার পদকে ভূষিত হয়েছেন ।

আলহাজ্ব ফজলুর রহমান শরীফের মালীকানাধীন প্রতিষ্ঠান এফআর জুট মিল অগ্নিকান্ডে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এফআর জুট মিলটি যাতে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় উৎপাদনে যেতে পারে তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জোর দাবী করেন। অপরদিকে, এফআর জুট মিলের নামে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে ভবন, মেশিনারিজ এবং পাটসহ সর্বমোট ১৫৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকার বীমা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু পাটের বিপরীতেই রয়েছে ৮৬ কোটি ৫২ লাখ টাকার বীমা। আগুনের খবর পেয়ে গত বুধবারই ঢাকা থেকে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। একই সঙ্গে সার্ভে প্রতিষ্ঠান এশিয়ান, আটলান্টিক ও জনতার পক্ষ থেকেও তিনজন সার্ভেয়ার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (কেমস) মো. কবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, সার্ভে প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট এবং তাদের পক্ষ থেকে সরেজমিন তদন্ত কার্যক্রম দ্রুত শেষ করে ক্ষতি নিরপন পূর্বক প্রতিবেদন পাওয়ার পরই মিলটির বীমা দাবী পরিশোধ করা হবে। যাতে দ্রুত রপ্তানিযোগ্য এফআর জুট মিলটি চালু করা সম্ভব হয় ।

এ বিষয়ে খাঁনজাহান আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. লিয়াকত আলী জানান, এফআর জুট মিলে দৃশ্যত চারটি গুদামের পাট সম্পর্ণ ভুস্মিত হয়েছে। তবে, পার্ট পার্ট হয়ে পাট গুদামের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। তিনি জানান, আগুন লাগার কারণ উদঘাটনে থানার পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান তিনি নিজেই। বাকি দুই সদস্য হলেন এসআই মো. শওকত আলী ও এসআই বিধান চন্দ্র সানা। তারা আগুনের সূত্রপাত এবং ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করে দ্রুত উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট জমা দিতে পারবেন বলে জানান।

অপরদিকে এফআর জুট মিলের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পৃথক পৃথক তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি অগ্নিকান্ডর ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নিরপন, ব্যাংক ঋন, ইন্স্যুরেন্স বীমাদাবীসহ সার্বিক বিষয় তদন্ত করতেই এ কমিটি। ইতিমধ্যে কমিটির সদস্যরা অগ্নিকান্ডের ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন পূর্বক তদন্ত কাজ শুরু করেছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান আমরা দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দিবো যাতে রপ্তানিমুখি বেসরকারি এ পাটকলটি দ্রুত উৎপাদনে যেতে পারে ।

This post has already been read 5627 times!

Check Also

ঢাকায় পলিথিন শপিং ব্যাগের বিকল্প পণ্য সামগ্রীর মেলা উদ্বোধন

নিজস্ব প্রতিবেদক: পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান …