নিজস্ব প্রতিবেদক: পোলট্রি শিল্পকে শক্তিশালী ও টেকসই অবস্থানে নিয়ে যেতে হলে নিরাপদ মাংস ও ডিম উৎপাদনের বিকল্প নেই, সেই সাথে নিরাপদ রাখতে হবে পরিবেশকে। দেশের জিডিপি’র গ্রোথ যেভাবে বাড়ছে তাতে করে এ শিল্পের তৈরি পণ্যের চাহিদা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। ভবিষ্যত সুস্থ ও নিরাপদ জাতি গঠনের জন্য পোলট্রি শিল্পে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের বিকল্প নেই। সঠিক জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। আমাদের অনেক চিন্তাভাবনা করে এগুতে হবে। শুধুমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, গুণগত মান উন্নত করার বিষয়ে আমাদের বিশেষ নজর রাখতে হবে।
শনিবার (২১ এপ্রিল) রাজধানীর অভিজাত একটি হোটেলে ওয়াল্ডর্স পোলট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন -বাংলাদেশ শাখা কর্তৃক আয়োজিত “Food and Environment Safety in Commercial Poultry Production” শীর্ষক কারিগরি সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সেমিনারের শুরুতে ওয়াল্ডর্স পোলট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন -বাংলাদেশ শাখা’র সভাপতি শামসুল আরেফীন খালেদ বলেন, দেশের পোলট্রি শিল্পে বর্তমান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান প্রায় ৬০ লাখ, ২০২১ সনের মধ্যে এটিকে আমরা ১ কোটিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। দেশের দারিদ্র বিমোচন ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবনতা কমাতে পারে এ শিল্প। এ শিল্পের মাধ্যমে দেশের অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। তাই পোলট্রি শিল্পকে টেকসই অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, বর্তমানে পোলট্রি শিল্পে মাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটিকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের অত্যন্ত সতর্কভাবে এগুতে হবে। পোলট্রি ফার্মে যাতে রোগ-বালাই না হয় সেজন্য শক্তভাবে জীব নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। আমরা বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য খাই, মরে যাওয়ার জন্য নয়। সেজন্য পোলট্রি পণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে হবে যাতে মানুষ ও পরিবেশের কোন ক্ষতি না হয়। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমেই আমাদের সমস্যার সমাধান করতে হবে। এসবের জন্য আমাদের দরকার পর্যাপ্ত জ্ঞানের। কারণ, জ্ঞানের কোন বিকল্প নেই।
শামসুল আরেফীন বলেন, কয়েক বছর ধরে এ শিল্পের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি হচ্ছে। এখন একটু স্থির হওয়া দরকার। কারণ না জেনে বুঝে এ শিল্পে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকির হার অনেক বেড়ে যায়। আমাদের চিন্তাভাবনা করে, জেনেবুঝে এ শিল্পে বিনিয়োগ করা দরকার। নিরাপদ পোলট্রি পণ্য উৎপাদনের জন্য অবৈধ ফিডমিল একটি বড় সমস্যা। অবশ্যই রেজিস্ট্রেশনবিহীন অবৈধ ফিডমিলগুলো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
দেশে এ মুহূর্তে প্রান্তিক খামারিরা সবচেয়ে কস্টে আছে। পোলট্রি শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে তাদেরকে আমরা আগ্রাহ্য করতে পারিনা। ওয়াপসা-বিবি’র পক্ষ থেকে এসব খামারিদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে, সংগঠনের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা আরো বাড়ানো হবে বলে তিনি জানান এক প্রশ্নের জবাবে।
সেমিনারে “Risk assessment and management of food and environment safety in poultry production in Bangladesh” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্য শুধু উৎপাদন করলেই চলবেনা, বাজারজাত থেকে রান্না এবং খাওয়া প্রতিটা বিষয়ে আমাদেরকে স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ থাকার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। মুরগি ও ডিম যতই নিরাপদ উৎপাদন করা হোক বাজার যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না হয় সেটি অনিরাপদ হয়ে উঠে। শুধু নিরাপদ খাদ্য চাই বললেই চলবেনা, নিরাপদ পদ্ধতিও অনুসরন করতে হবে আমাদের প্রতিটি পর্যায়ে।
তিনি বলেন, সময় এসেছে বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে নিরাপদ খাদ্য বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যাতে ছোটবেলা থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে এ ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে উঠে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দায়িত্ব রয়েছে এ ব্যাপারে। তারা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিতে পারে কোন কোন খামার নিরাপদ এবং প্রয়োজনে ‘নিরাপদ পোলট্রি পণ্য’ নামক কিছু আউটলেট স্থাপন করতে পারে। কসাইখানাগুলোতে মোবাইল কোর্ট বসানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সত্যিকার অর্থে ভালো নিয়ম চর্চা করলে নিরাপদ পোলট্রি পণ্য উৎপাদন কঠিন কোন বিষয় নয়। এছাড়াও পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়টিতে আমাদের অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে।
সেমিনারে “Good husbandary practices in poultry production to ensure environment and food safety” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদের পোলট্রি পালন বিভাগের অধ্যাপক ড. এস.ডি চৌধুরী বলেন, মানুষ এবং প্রাণিতে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সারাবিশ্বেই বর্তমানে একটি চিন্তার বিষয়। সেজন্য আমাদের প্রথমে জানতে হবে খাদ্যে কীভাবে মাইক্রোবায়াল প্যাথোজেন প্রবেশ ও চলাফেরা করে, জীবন্ত মুরগি ও ডিম কোন কোন মাধ্যমে দুষিত হয়। এগুলো জানতে পারলে আমাদের সমাধানের উপায় বের করতে সহজ হবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের ফিডের অনেক বস্তাতেই ফিডে ব্যবহৃত উপাদানের কম্পোজিশন ঠিকভাবে লেখা হয়না। কিন্তু ফিডের বস্তায় সামগ্রিক তথ্যই থাকা উচিত। এছাড়াও আমাদের দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদন করার সুযোগ রয়েছে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এ সময় তিনি Animal Welfare Society ও National Poultry Development Society গঠনের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন।
সেমিনারে “Prudent use of antimicrobials poultry” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. প্রিয় মোহন দাস। তিনি বলেন, ডব্লিউএইচও -এর তথ্যমতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রেসক্রিপশনবিহীন এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরিমাণ বেশি এবং বাংলাদের তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ওষুধের দোকানগুলোতে যত্রতত্রভাবে এন্টিবায়োটিক বিক্রয় করা হয়। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর ৬৯টি দেশ পোলট্রিতে এন্টিবায়োটিক সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে আমাদেরও ধীরে ধীরে সে পথে এগুতে হবে। পোলট্রি ফার্মগুলোতে বায়োসিকিউরিটি সর্বোচ্চ মেইনটেইন করতে হবে। নিরাপদ পোলট্রি পণ্য উৎপাদনের জন্য এসবের বিকল্প।
এছাড়াও সেমিনারে “New information on the importance of bio security at poultry farms” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের জওহরলাল নেহেরু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগীয় প্রধান ড. জে.এল. ভেগাদ; “Alternatives to antimicrobial growth promotors” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন Mr. Hannes Meyns, DVM, Vetworks; “Prevention of microbial contamination in poultry supply chain” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সুকুমার সাহা; “Quality assurance and control of poultry feed to ensure food safety” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন Mr. K. -J. KUHLMANN, Trouw Nutrition, Asia Pacific, Bangkok, Thailand; “Quality management systems for processed poultry and food safety” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সায়েম উদ্দিন আহমেদ।
উল্লেখ্য, সেমিনারটি মূলত দুটি পর্বে ভাগ করা হয়। প্রথম পর্বে বিশেষজ্ঞগণের প্রবন্ধ উপস্থাপন, দ্বিতীয় পর্বে আগত অতিথিদের প্রশ্নোত্তর পর্ব, ক্রেস্ট বিতরণ করা হয় ও বিএলআরআই’র বিজ্ঞানী ড. গিয়াসউদ্দিনের সঞ্চালনায় প্যানেল ডিসকাশন। শেষে সেমিনারের ধন্যবাদ বক্তৃতা করেন ওয়াল্ডর্স পোলট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন -বাংলাদেশ শাখা’র সভাপতি শামসুল আরেফীন খালেদ, সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব হাসান এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং সেমিনারের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম।