ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা): খুলনাঞ্চলে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন মওসুমের শুরুতেই চিংড়ি ঘেরে মড়ক দেখা দিচ্ছে। চলতি উৎপাদন মওসুমের শুরুতেই জেলার কয়রা, ডুমুরিয়া ও পাইকগাছা উপজেলার অধিকাংশ চিংড়ি ঘেরে ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে মাছের মড়ক নামক এ রোগ। চাষীরা মড়ক নামক এ রোগের কারণ হিসেবে এটাকে ভাইরাস সংক্রমন বললেও মৎস্য অফিস মরা চিংড়িতে কোন রোগ বালাইয়ের চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছেন না। অন্যদিকে স্থানীয় এনজিও’র দাবি পানি ও খাদ্যই চিংড়ির ব্যাপক ভিত্তিক মড়কের জন্য প্রধানত দায়ী। তবে কোনো পদ্ধতিতেই রোধ করা যাচ্ছে না বাগদা চিংড়ির এ মড়ক। জলবায়ু পরিবর্তনে অনাবৃষ্টি ও প্রচ- তাপদাহ চিংড়ির উপযোগী লবন পানির স্বাভাবিক পরিবেশকে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করায় এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ। এমন অবস্থায় চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহতের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের ভবিষ্যত নিয়েও নানাবিধ আশংকা তৈরী হয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন লোনা পানির জনপদের অধিকাংশ চাষীরা।
কৃষি অফিস জানায়, সুন্দরবন উপকূলীয় পাইকগাছা উপজেলায় মোট কৃষি জমির পরিমান ৩০ হাজার হেক্টর। যার মধ্যে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতেই আবাদ হয় লবণ পানির চিংড়ির। মৎস্য অফিস জানায়, এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার চিংড়ি ঘের রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা সংকটে গত দু’বছর উৎপাদন ভাল হয়নি। গতবার মৎস্য অধিদপ্তর চিংড়ি উৎপাদন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৬ হাজার মেট্রিক টন।
তবে গতবারের ন্যায় এবারো মওসুমের শুরুতেই ব্যাপক হারে চিংড়ির মড়কে একদিকে যেমন আশংকা তৈরী হয়েছে লক্ষমাত্রা অর্জিত না হওয়ার, অন্যদিকে শুরুতে পোনার দাম ও জমির হারি বৃদ্ধি থেকে শুরু করে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করায় আন্তর্জাাতিক বাজারে দেশের চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় এবং দাম ভাল না থাকায় আগামীতে চিংড়ি চাষে নেমে আসতে পারে মহাবিপর্যয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনটাই মনে করছেন চিংড়ি সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ।
প্রসঙ্গত ৮০’র দশক থেকে সুন্দরবন উপকূলীয় কৃষি অধ্যুষিত এ উপজেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শুরু হয় লবন পানির চিংড়ি চাষ। শুরুতেই উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির দাম ভাল থাকায় মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে উপজেলার দুই তৃতীয়াংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে চিংড়ির চাষাবাদ। সোনার ধান, সোনালী আঁশ, সবুজ সবজি আর শষ্যের পরিবর্তে দিগন্ত জোড়া মাঠের সব দিকেই বিস্তার লাভ করে রুপালী পানি।
ফসলের জন্য আর দীর্ঘ অপেক্ষা নয়,সকাল-সন্ধ্যা ঝাঁঝালো গন্ধের চিকচিকে পানির নিচ থেকে উঠতে থাকে সাদা সোনা বাগদা। কিছু দিনের মধ্যে পাইকগাছাকে চিংড়ি উৎপাদনের জন্য বিশেষায়িত করা হয় “সাদা সোনার রাজ্য” হিসেবে। অল্প সময়ের ব্যবধানে কোটিপতি বনে যান চিংড়ি চাষের সাথে সম্পৃক্তদের অনেকেই। তবে মূল জমির মালিকদের অবস্থা চলে যায় আরো তলানিতে। জীবিকার প্রধান মাধ্যম কৃষি শষ্যও আসে না চাহিদানুযায়ী জমির হারিও পায়না। এক সময় জীবিকার ভিন্ন উপায় ও ঋণের দায় মেটাতে ঘেরের জমিটুকুও বাধ্য হয়ে তুলে দেয় ঘের মালিকদের কাছেই।
তবে ১ থেকে দেড় দশকের মধ্যে ১৯৯৫ সালের পর থেকে চিংড়ি ঘেরে শুরু হয় “ভাইরাস” বা মড়ক রোগ সংক্রমন। ধীরে ধীরে তা বিস্তার লাভ করায় পুরোপুরি লাভের মুখে থাকা চিংড়ি শিল্পে নেমে আসে আকস্মিক ধ্বস। এভাবে সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের অনেকেই লাভের আশায় বছরের পর বছর ধার-দেনা করে চাষাবাদ টিকিয়ে রাখে। সফলতা না আসায় এক সময় চাপ সইতে না পেরে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন। মাঝের দু’এক বছর কিছুটা ভাল হওয়ায় ফের কোমর বেঁধে মাঠে নামেন চাষীরা। তবে মাত্র এক বছর পর মৌসুমের শুরুতেই চিংড়ি ঘেরে আবারো মড়ক অব্যাহত থাকায় নতুন করে বন্ধের উপক্রম হয়েছে সম্ভাবনাময় এ শিল্প।
চিংড়ি চাষী নোয়াকাটির জাহাঙ্গীর আলম, কাশিমনগরের শেখ রবিউল ইসলাম, নজরুল শেখ, জাহাঙ্গীর শেখ, প্রতাপকাটির বজলু জানান, এবছর মওসুমের শুরুতেই তাদের ঘেরে দেখা দিয়েছে চিংড়িতে মড়ক। এখন পর্যন্ত অনেকে দু/এক কেজি মাছও বিক্রি করতে পারেননি তারা। অনেক ঘেরে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় অবমুক্ত’র সকল মাছই মরে সাবার হয়ে গেছে।
ব্যাপক হারে অব্যাহত চিংড়ি মড়ক আসলে কি ভাইরাস সংক্রমণ? নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব? এ নিয়ে চিংড়ি চাষী, মৎস্য অধিদপ্তর ও চিংড়ির উপর মাঠ পর্যায়ে কাজ করা এনজিওগুলোও পরষ্পর বিরোধী কারণ দাবি করছে। চাষীরা এটাকে ভাইরাস সংক্রমণ বললেও মৎস্য অফিস মৃত চিংড়িতে খুঁজে পাচ্ছেন না কোন সংক্রমণ চিহ্ন। আর এনজিও গুলোর দাবি, পানি ও খাদ্য সমস্যাই প্রধানভাবে চিংড়ির ব্যাপকহারে মড়কের জন্য দায়ী।
এ প্রসঙ্গে চিংড়ি চাষে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান নিউ সানের এ্যাকুয়াকালচার প্রোগ্রামের কো-অর্ডিনেটর সুকুমার অধিকারী বলেন, চিংড়ি চাষে মড়ক রোধ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে মাটি ও পানি পরীক্ষা এবং তার সঠিক পরামর্শ প্রদানই তাদের লক্ষ্য। এ লক্ষে তারা নিয়মিত চাষীদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ে উঠন বৈঠক করছেন। এ উপায়ে সফলতা এসেছে বলেও দাবি এ এনজিও কর্তার। তিনি বলেন, মাটি ও পানি দূষণ এবং চাষীদের অজ্ঞতাই চিংড়ির ব্যাপকহারে মড়কের জন্য প্রধানভাবে দায়ী।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা পবিত্র কুমার মন্ডল জানান, মড়ক আক্রান্ত ঘেরের চিংড়িতে এখন পর্যন্ত তারা কোন জীবাণু বা সংক্রমণের চিহ্ন খুঁজে পাননি। তবে চিংড়ির এ ব্যাপক ভিত্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে না পারলেও মহস্য কর্মকর্তা, জলবায়ু পরিবর্তনে অনাবৃষ্টি ও প্রচ- দাবদাহে চিংড়ির লবন পানির উপযুক্ত পরিবেশ বাঁধাগ্রস্থ ও খাদ্য দূষণে মাছের মড়ক লাগতে পারে বলে মনে করেন।
এদিকে চিংড়ির মড়ক রোধে বিভিন্ন কোম্পানি বাহারি সব প্রচারে বাজারজাত করছে নানাবিধ প্রতিষেধক বা ঔষধ। অনেকে আবার পরিবেশ বান্ধবের ধুয়ো তুলে নিজেদেরকে চিংড়ি বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করলেও মূলত তাদের কারো কোন পরামর্শেই চিংড়ির মড়ক রোধ না হওয়ায় মূলত দিশেহারা হয়ে পড়েছেন প্রান্তিক চাষিরা।