সোমবার , নভেম্বর ২৫ ২০২৪

ফল চাষে সম্ভাবনায় উপকূলীয় অঞ্চলের বসতবাড়ি

মৃত্যুঞ্জয় রায় : এ দেশের প্রায় ২৮% মানুষ উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করে। এসব মানুষদের অধিকাংশই দরিদ্র। পেশায় প্রধানত কৃষক, জেলে ও শ্রমিক। জমি থাকলেও সেসব জমিতে লবণাক্তার প্রভাবে সারা বছর বহুমুখী ফসল চাষ করা কঠিন। প্রধান ফসল আমন ধান ছাড়া অন্য ফসল দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো হয় না। লবণাক্ততা ও নিচু জমির কারণে ফলচাষ করা আরো কঠিন। তাই ফল উৎপাদনের প্রধান সুযোগ বা উৎস হলো হলো এ অঞ্চলের বসতবাড়ির আঙ্গিনাসমূহ। উপকূলীয় অঞ্চলে বসতবাড়ির মোট সংখ্যা প্রায় ৬৮ লাখ ৫০ হাজার। তাই ফল উৎপাদন করে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য বসতবাড়ির বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে ফলচাষের কোনো বিকল্প নেই।

উপকূলীয় অঞ্চলের ফল
উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ুতে এখন অনেক ফলই ভালো হচ্ছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ফলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি, লতাচাপালী, ভোলার চর ফ্যাশন ইত্যাদি স্থানে এখন প্রচুর পরিমাণে তরমুজের চাষ হচ্ছে। এ অঞ্চলের বসতবাড়িতে কি কি ফল ভালো হয় তা এসব অঞ্চলের বসতবাড়িগুলো ঘুরে একটু জরিপ চালালেই বুঝা যায়। এর জন্য খুব বেশি গবেষণার দরকার হয় না। তারপরও নতুন ফল বা নতুন জাতের ফল চাষ সম্প্রসারণে অবশ্যই স্থানোপযোগী বিশেষ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। সম্প্রতি মো. ওহিউল ইসলাম ও তাঁর সাথীরা ভোলা, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার বসতবাড়িসমূহের ওপর এক গবেষণা কর্ম সম্পাদন করে তার চমৎকার ফলাফল তুলে ধরেছেন তাঁদের গবেষণাপত্রে। তাঁরা এ তিনটি জেলার বসতবাড়িসমূহে মোট ৩২ প্রজাতির ফলগাছ দেখতে পেয়েছেন। এসব ফলগাছসমূহ হলো নারিকেল, সুপারি, বিলাতিগাব, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জাম্বুরা, তাল, আমড়া, তেঁতুল, বরই/কুল, জামরুল, কামরাঙা, লেবু, খেজুর, কালোজাম, ডেউয়া, চালতা, লিচু, জলপাই, আমলকি, আতা, কাউফল, বেল, সফেদা, ডালিম, শরিফা, গাব, কমলা, মাল্টা, কদবেল ও গোলাপজাম। দ্বীপসমূহের বসতবাড়িতে ফলগাছ কম রয়েছে। যেমন সন্দীপের বসতবাড়িসমূহে ১৯ প্রজাতির ফলগাছ রয়েছে। দ্বীপসমূহে নারিকেলগাছের প্রাধান্য বেশি। এ তালিকার বাইরেও কিছু ফল উপকূলীয় অঞ্চলের বসতবাড়িসমূহে চাষ হচ্ছে বা চাষ করা যেতে পারে, যেমন- পেঁপে, স্ট্রবেরি, কলা, অরবরই বা নোয়াল, বিলিম্বি, জংলিবাদাম, পানিফল, আমরুল, বৈঁচি, লুকলুকি, বাঙ্গি, মরমা ইত্যাদি।

এ অঞ্চলে সুন্দরবনের কিছু গাছ আছে যেগুলোর ফল খাওয়া যায়। এমনকি বনজ সেসব ফল থেকে আচার তৈরি করা যায়। সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা, বাগেরহাটের মংলা ও রামপালের অনেক বসতবাড়িতেও দেখেছি সুন্দরবনের কিছু গাছ। সেসব গাছে ফলও ধরছে। বিশেষ করে কেওড়া ও গোলপাতা গাছ। এ দুটি গাছের ফল খাওয়া যায়। সুন্দরবনের আর একটি বুনোফল মামাকলা। এ গাছও বসতবাড়ির জঙ্গলে হয়।

গবেষকবৃন্দ এ ৩টি জেলার ৯৮% বাড়িতেই নারিকেলগাছ ও ৮০% বাড়িতে বিলাতি গাবগাছ দেখতে পেয়েছেন, ৯৭% বাড়িতে সুপারিগাছ আছে। ভোলায় গড়ে প্রতিটি বাড়িতে ৫১৬টি সুপারিগাছ ও ১১৫টি বিলাতি গাব গাছ রয়েছে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বসতবাড়িতে হাইব্রিড খাটো জাতের নারিকেলগাছ লাগানোর সুযোগ আছে। অনেক বসতবাড়িতে সবচেয়ে বেশি আছে বিলাতি গাবগাছ, বরগুনা ও পটুয়াখালীতে গড়ে প্রতিটি বসতবাড়িতে বিলাতি গাব গাছ রয়েছে যথাক্রমে ৩৬২টি ও ১৬০টি। বিস্ময়কর হলেও সত্য ৯৭.৩৩% বাড়িতে তাঁরা আমগাছ দেখতে পেয়েছেন। উপকূলীয় অঞ্চল আমচাষের জন্য উপযোগী নয়, এমন ধারণাই এতকাল ছিল। বিশেষ করে জলমগ্নতা, জোয়ারভাটার প্লাবন, লবণাক্ততা, আমের মুকুল আসার সময় গরম আবহাওয়া, অধিক ঝড়বাতাস, আমের পোকা ইত্যাদি কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে অতীতে আম উৎপাদন ভালো হতো না। কিন্তু এখন কিছু কিছু জাতের আম বিশেষ প্রযুক্তি মেনে চাষ করে সাফল্য পাওয়া গেছে। সাতক্ষীরার আম এখন ইউরোপের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে। সেখানকার গোবিন্দভোগ, বোম্বাই, আম্রপালি, লতাবোম্বাই, নীলাম্বরী ইত্যাদি জাতগুলো বেশ ভালো ফলন দিচ্ছে। উপকূলের বসতবাড়িসমূহে ইতোমধ্যে আম্রপালি জাতটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ও ভালো ফল দিচ্ছে। বারি আম ৪ জাতটিও এ অঞ্চলে সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। প্রায় ৯০% ও ৯২% বাড়িতে যথাক্রমে জাম্বুরা ও পেয়ারাগাছ রয়েছে, আমড়া আছে ৭২% বাড়িতে। এ তিনটি জেলার ৪২% বাড়িতে লিচুগাছ থাকলেও ফল ভালো হয় না। থাই পেয়ারা চাষের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে পুকুরপাড়ে থাই পেয়ারা, পেঁপে, ডোয়ার্ফ নারিকেল ইত্যাদি চাষ করা যায়। সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক ফল সফেদা আছে মাত্র ৩০% ও কদবেল আছে ১২% বাড়িতে। এ দুটি ফলকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বসতবাড়িতে চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।

This post has already been read 4294 times!

Check Also

মুড়িকাটা পেয়াজ পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে ফরিদপুরের কৃষক

আসাদুল্লাহ (বরিশাল) : ফরিদপুরে প্রতি বছর আগাম জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ করা হয়। এবারও ফরিদপুরে …