ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা): দক্ষিণাঞ্চলে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওয়া সত্বেও খুলনায় চালের বাজার দরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি চালে তিন টাকা থেকে পাঁচ-ছয় টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে গেছে। পাইকারী আড়তে বস্তা প্রতি ৫০ থেকে ১শ কিংবা ১শ ২৫ টাকা পর্যন্ত মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। সবচে দাম বেড়েছে ভারত থেকে আমদানী করা চালের। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
দেশি মোটা চালের দাম পাইকারী ৫০ কেজি ওজনের বস্তা প্রতি ১শ টাকা দাম বেড়ে ১৭শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজি প্রতি বেড়েছে দু’ টাকা বেড়ে ৩৪ টাকায় দাড়িয়েছে। খুচরা পর্যায়ে যা ৩৭ থেকে ৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে, ভারতীয় স্বর্ণা মোটা চালের দাম বস্তা প্রতি এক থেকে দেড়শ টাকা বেড়ে দু’ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজি প্রতি পাইকারী দাম ৩৭ টাকা থেকে বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। খুচরা দোকানীরা যা ৪৫ থেকে ৪৬ টাকায় বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, দেশি মিনিকেট ২৫ কেজি ওজনের বস্তায় ৫০ টাকা দাম বাড়লেও বস্তাপ্রতি ইন্ডিয়ান মিনিকেটের দাম বেড়েছে ১শ ২৫ টাকা। পাইকারী কেজি প্রতি ৫ টাকা বেড়ে যা ৫০ টাকা এবং দেশি মিনিকেট কেজিতে দু’টাকা দাম বেড়ে ৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুদি দোকানী এবং হাট-বাজারের খুচরা বিক্রেতারা যা ৫৫ এবং ৫৮ টাকা মূল্যে বিক্রি করছেন।
এছাড়া, দেশি ইরি আতপ প্রতি বস্তায় ১শ টাকা বেড়ে ১৩শ ৫০ টাকা, বাংলামতি সেদ্দ বস্তা প্রতি ১শ টাকা বেড়ে ১৬শ ৫০ টাকা, ২৮ বালাম প্রতি বস্তায় ১শ ৫০ টাকা বেড়ে ১৯শ থেকে ২ হাজার টাকা, বটিয়াঘাটার জলমার ভাইটেল ১শ টাকা বেড়ে ২৫শ টাকা বস্তা দরে বিক্রি হচ্ছে। পাইকারী কেজি প্রতি এসব চালের দাম দু’টাকা, তিন টাকা অথবা চার টাকা হার বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে যা আরও তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানের মুদি দোকানিরা দাম বৃদ্ধির কথা বলে কখনও-কখনও আরো বেশি মূল্যে বিক্রির চেষ্টা করছেন। চলমান পরিস্থিতিকে পুঁজি করে কোথাও-কোথাও তারা ক্রেতাদের পকেট কাটছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাজেটে ভারত থেকে চাল আমদানীতে ২৮ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ হয়েছে। যে কারণে দামও বেড়ে গেছে। ইন্ডিয়ান চালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব দেশি চালের বাজার দরে সংক্রমিত হয়েছে। রাইস মিল মালিকরা আমদানী করা চালের মূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে দেশি চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। খুলনা বড় বাজারের পাইকারী আড়ৎদারদের মধ্যকার একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছেন।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে খুলনা জেলা চাল কল মালিক সমিতি’র সভাপতি মোস্তফা কামাল বলেছেন, বাজেট ঘোষনার পর ৮শ ৩০ থেকে ৫০ টাকা মণ দরের ধান ৯শ থেকে ৯শ ১০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। যে কারণে উৎপাদিত চাল কেজি প্রতি গড়ে এক টাকা বেশি দামে আড়তে সরবরাহ হচ্ছে। তবে প্রায় একই মানের চাল নোয়াপাড়া ও যশোরের মজুমদার, পরশসহ কয়েকটি রাইস মিল আরও এক থেকে দেড় টাকা বেশি মূল্যে বিক্রি করছে। গেল বোরো মৌসুমে ধানের পর্যাপ্ত ফলন হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ভারত থেকে অস্বাভাবিক পরিমাণে চাল আমদানি হয়েছে। আমদানী কম করলেও চলতো।
গত মে মাসে বোরো মৌসুমের সমাপ্তি ঘটেছে। শুরু হয়েছে ধান বাজারজাত কার্যক্রম। জেলার নয় উপজেলাসহ দৌলতপুর ও লবণচরা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫১ হাজার ৮শ ২৩ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিলো। ২ লাখ ১৮ হাজর ৯শ ৬১ মেট্রিকটন চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিলো। কিন্তু আবাদ এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল লতিফ বলেছেন, ৫৮ হাজার ৫শ ৮০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। যেখান থেকে ২ লাখ ৫৬ হাজার ১শ ৮১ মেট্রিকটন চাল উৎপাদন হয়েছে।
নগরীর বড় বাজারে ছোট-বড় মিলিয়ে ১শ এক’টি পাইকারী চালের আড়ৎ রয়েছে। খুলনার চাল কল মালিকদের পাশাপাশি কুষ্টিয়া, নাটোরের গুরুদাশপুর, শেরপুর, দিনাজপুর, নওগাঁ, পাবনার ঈশ্বরদিসহ উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার রাইস মিল থেকে এসব আড়তে চাল সরবরাহ হয়ে থাকে। পাশাপাশি যোগান থাকে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা চালের। যদিও এ বছর শুধু ভারত থেকে আমদানি করা চাল সরবরাহ হচ্ছে। বাড়তি মূল্যের কারণে আমদানিকারকরা মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড থেকে চাল আমদানি করছেন না বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, আড়ত সমূহে পর্যাপ্ত চালের সরবরাহ রয়েছে। রাইস মিল গুলোতেও ধানের যোগান পর্যাপ্ত পরিমাণে। তবুও চালের দাম বাড়ছে। যদিও চাল কল মালিক, কিংবা আড়ৎদারদের মধ্যকার কয়েকটি সূত্র এর পেছনে কোনো ধরনের কারসাজীর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
খুলনা ধান-চাল বণিক সমিতি’র সভাপতি মুনীর আহমেদ বলেছেন, শুল্ক মুক্তভাবে বিগত সময়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানী হতো। কিন্তু ২০১৭ সালের শুরুর দিকে সরকার প্রথম ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করে। যা পরবর্তী দু’-১০ দিনের মধ্যে ২৮ শতাংশে দাড়ায়। সে সময় দাম বেড়েছিলো। এরপর ওই বছরের শেষের দিকে সরকার আমদানী শুল্ক কমিয়ে দু’ শতাংশ নির্ধারণ করলে চালের বাজার দর সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটে ২৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক পূণঃ নির্ধারণ করায় ভারতীয় চালের দাম বেড়েছে। যার প্রভাব দেশি চালের বাজার দরের উপর পড়েছে। ইন্ডিয়ান চালের দাম কমলে দেশি চালের দামও কমে যাবে।