মৃত্যুঞ্জয় রায় : রাঙামাটির কাপ্তাই লেক দিয়ে একটা মার্মা গ্রাম অংচাজাই কার্বারি পাড়া থেকে ফেরার পথে দুপুরে খাওয়ার আয়োজন হলো কর্ণফুলীর তীরে চাংপাং রেস্টুরেন্টে। লেকের মধ্যে একটা দ্বীপ-পাহাড়ের চূড়ায় রেস্তোরাঁটা। সেগুন বনের মধ্যে বেশ নিরিবিলি-নির্জন জোলো একটা পরিবেশ। পাহাড় চূড়ায় উঠে মনটা অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরে যায়। কিন্তু খাবার টেবিলে যখন খেতে বসলাম, সঙ্গী সুপ্রিয় ত্রিপুরা বললো, দাদা আজ বাঁশ খাওয়াব। মানে কি? কাউকে বাঁশ দেয়া আর বাঁশ খাওয়ানো তো কোনো ভালো কিছু হতে পারে না। বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। টেবিলে ঠিকই বাঁশ চলে এলো। সুপ্রিয় বললো, এই খাবারের নাম বুদিয়া- বাঁশভর্তা। আর একটি খাবার এলো, কচি বাঁশের কোঁড়ল দিয়ে পুঁইশাক রান্না করা হয়েছে। মিতিঙ্গা বাঁশের কোড়ল আংটির মতো চাক চাক করে কেটে পুঁইশাকের পাতা দিয়ে রান্না করা হয়েছে। এরপর এলো বাঁশ-মুরগি ক্যাবাং। আধফালি বাঁশের মধ্যে মুরগির টুকরোগুলো রাঁধা। সবই ইথনিক ফুড- আদিবাসী খাবার। সঙ্গী মিজান বললো, খেয়ে দেখুন, মজা পাবেন। এই প্রথম বাঁশ খাবো, সত্যি সত্যি বাঁশ খাবো। জাহিদ বললো, দিনটা তো ঐতিহাসিক হতে চলেছে রে সুপ্রিয়। তবে সত্যি সত্যি তামাশার মধ্যে কিন্তু ওটা খেয়েই ফেললাম। মন্দ লাগলো না। এরপর থেকেই লেগে পড়লাম খাদ্য হিসেবে বাঁশের কোঁড়লের খোঁজ খবরে। সুপ্রিয় জানালো, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিটি আদিবাসীদেরই প্রিয় একটা খাদ্য হলো বাঁশের কোঁড়ল। যেকোন অতিথি আপ্যায়নে এটি একটি বিশেষ খাবার। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এ অঞ্চলে বাঁশের কোঁড়ল পাওয়া গেলেও বর্ষাকালটাই আসলে সবচেয়ে ভালো সময়। এ সময় গজানো বাঁশের কোঁড়লের কোনো তুলনা হয়না।
বাঁশের কোঁড়ল শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই নয়, সিলেটেও সমান জনপ্রিয়। তবে বিশ্বে বাঁশের কোঁড়ল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় জাপানে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতিবছর বাঁশখাদক লোকদের কাছে বাঁশের কোঁড়লের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৫০ হাজার টন। বিশ্ব বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ বাঁশের কোঁড়লের ক্রেতা জাপান। আর সবচেয়ে বেশি বাঁশের কোঁড়ল উৎপন্ন হয় চীনে। চীন প্রতিবছর বিশ্বের ৩৭টি দেশে গড়ে ১৩৭ হাজার টন টিনজাত বা প্যাকেটজাত বাঁশের কোঁড়ল রপ্তানি করে থাকে। কোরিয়া, জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর, জার্মানী, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইডেন প্রভৃতি দেশে বাঁশের কোঁড়লের প্রচুর চাহিদা ও বাজার রয়েছে। এসব দেশ ছাড়া ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও বাঁশের কোঁড়ল জনপ্রিয় খাদ্য।
আমাদের দেশে সমতল অঞ্চলে বিভিন্ন মৌসুমে প্রচুর সবজি ফলে। তাই এসব এলাকার লোকেরা বাঁশের দিকে কোনো আগ্রহ দেখান না। কিন্তু পার্বত্য এলাকায় তেমন কোনো সবজি হয়না, জুমে কিছু সবজি হয়। তাও চাহিদার তুলনায় খুবই কম। তারপরও বর্ষাকালে সেসব জুমে প্রায় কোনো সবজি থাকে না। তাই ওসব অঞ্চলের মানুষেরা বাঁশের কোঁড়লকে একটি অন্যতম সবজি হিসেবে রান্না করে খায়। তবে এটা শুধু পাহাড়ি অঞ্চলেই নয়, সমতলের লোকেরাও সবজি হিসেবে রান্না করে খেতে পারেন। কেননা, বাঁশের কোঁড়ল বেশ পুষ্টিসমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর।
চীনারা বাঁশের কোড়লকে বলেন ‘স্বাস্থ্যকর খাবারের রাজা।’ তাজা বাঁশের কোঁড়লে ৮৮-৯৩% পানি, ১.৫-৪% প্রোটিন, ০.২৫-০.৯৫% চর্বি, ০.৭৮-৫.৮৬% চিনি, ০.৬০-১.৩৪% সেলুলোজ এবং ১.১% খনিজ পদার্থ আছে। ভিটামিনও আছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে যে বাঁশের কোঁড়ল দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, উচ্চ রক্তচাপ কমায় ও ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়। কোষ্ঠ্যকাঠিন্য, হাঁপানী, ডায়াবেটিস, তীব্র জ্বর, মৃগি রোগে মূর্ছা যাওয়া ইত্যাদি নিরাময়েও যথেষ্ট অবদান রাখে। তাই যেকোনো সবজির সাথে তুলনা করলে বাঁশের কোঁড়ল কোনোভাবেই হেলাফেলার নয়।
বাঁশের কোঁড়ল বস্তুটা আসলে কি? বাঁশের মোথা থেকে মাটি ফুঁড়ে শিঙের মতো যে কচি কান্ড গজায়, ওটাই বাঁশের কোঁড়ল বা কোড়ক নামে পরিচিত। ইংরেজীতে বলে ব্যাম্বু শ্যুট। এ থেকেই পরে বাঁশ হয়। কিন্তু যত কোঁড়ল গজায় তত বাঁশ হয়না। অনেক কোঁড়ল গজানোর পরও নষ্ট হয়। তাই এসব বাড়তি কোঁড়ল নষ্ট না করে বাঁশের জন্য কয়েকটা কোঁড়ল রেখে বাকিগুলো কেটে সবজি হিসেবে খেলে বা বিক্রি করলে তাতে বাঁশ ঝাড়ের কোনো ক্ষতি হয়না। আমাদের দেশে সব বাঁশের কোঁড়লই সিদ্ধ করে ও রান্না করে খাওয়া যায়। তবে মুলী, ফারুয়া, বরাক, মিতিঙ্গা, প্যাঁচা ও ওরা বাঁশের কোঁড়ল অত্যন্ত সুস্বাদু।
সাধারণত বৃষ্টি শুরু হলে মোথা থেকে কোঁড়ল বের হতে থাকে। কোঁড়ল ৬ থেকে ১০ ইঞ্চি লম্বা হলে তা ধারালো চাকু বা দা দিয়ে কেটে সংগ্রহ করতে হয়। তবে কোঁড়ল কাটার সময় খেয়াল রাখা উচিত কাটার কারণে বাঁশ ঝাড়ের মুথা ও অন্য কোঁড়ল যেন ক্ষতিগ্রস্ত বা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। এরূপ কোঁড়ল সংগ্রহের পর গরম পানিতে তা ৪৫ মিনিট সিদ্ধ করে কোঁড়লের বাইরের খোসা চাকু দিয়ে ছাড়াতে হয়। এরপর কচি মাংসল অংশ ছোট ছোট টুকরো করে কেটে পানিতে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে এবং তাতেও নরম না হলে আবার পানিতে সিদ্ধ করে সে পানি ফেলে দিয়ে সবজি, মাছ বা মাংসের সাথে মসলা দিয়ে রান্না করে খাওয়া যায়। তবে রান্না ছাড়া সালাদ, আচার, স্যুপ ইত্যাদি তৈরি করেও বাঁশের কোঁড়ল খাওয়া যায়। ভিয়েতনামে ব্যাম্বু চিকেন স্যুপ ও ব্যাম্বু-পর্ক স্ট্যু অত্যন্ত জনপ্রিয় দুটি খাবার। এ দেশের পাহাড়গুলোতে বাঁশ চাষের অফুরন্ত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। বাঁশকে বলা হয় গরিবের কাঠ। তাই বলে বাঁশের কোঁড়লকে গরিবের খাদ্য ভাবার কোনো কারণ নেই। কেননা, রাঙামাটির বনরূপা বাজারেই দেখলাম এক কেজি বাঁশের কোঁড়ল বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে। বিদেশে না জানি আরও কত দাম! তাই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে বাঁশের কোঁড়ল রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ আছে। তবে সেজন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও উন্নত প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ।