বৃহস্পতিবার , নভেম্বর ২১ ২০২৪

স্মৃতিময় ভারত ভ্রমণ: একদল পবিপ্রবিয়ান কৃষিবিদদের স্বপ্ন পূরণ (২য় পর্ব)

মানালীর রোথাং পাস

নাজমুল হাসান অন্তর : আগ্রা ভ্রমণ শেষে সকালে বাসে উঠে দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা। দিল্লি পৌছালাম বিকাল ৩টা নাগাদ। হোটেলের লোক আমাদের অনেক দূর থেকে এগিয়ে নিয়ে আসছে। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে আর বাইরে বেশি ঘোরাফেরা করিনি। ওই দিন দিল্লিতে রাম রহিমের সমর্থকদের সাথে সরকারের সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি রাতেই শান্ত হয়। সকালে উঠে নাস্তা করে দিল্লী ঘুরতে বের হলাম।

প্রথমেই গেলাম ইন্দ্রিরা গান্ধী মেমোরিয়াল। যেতেই চোখে পরলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সড়ক। বিদেশের মাটিতে আমার দেশের মহান মানুষের নামে সড়ক চোখে পরতেই আনন্দে চোখের কোণায় জ্বল চলে আসে। ইন্দ্রিরা গান্ধী মেমোরিয়ালেও চোখে পরলো শেখ মুজিবর রহমানের ছবি বড় করে লাগানো ইন্দ্রিরা গান্ধীর পাশে। এ যেন আমার অহংকার, দেশের অহংকার। তারপর গেলাম পার্লামেন্ট ভবনের সামনে।

পেছনে কুতুব মিনার, সামনে আমরা পবিপ্রবিয়ান

এরপর গেলাম কুতুব মিনার। পুরানো সব স্থাপনা আর চোখ ধাধাঁনো সৌন্দর্য। সুউচ্চ মিনার দিল্লীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। কুতুব মিনার ঘুরে গেলাম লোটাস টেম্পল। দেখতে যেন এক পদ্ম ফুল। এটি আসলে একটি প্রার্থনার যায়গা। জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সবাই একসাথে প্রার্থনা করতে পারে। তবে অধিকাংশই যায় এর সৌন্দর্য দেখতে। তারপর আমরা গেলাম রাজঘাট। যেখানে ভারতীয় সকল বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের সমাধি। ঢুকতেই প্রথমে বামে চোখে পরে মহাত্মা গান্ধীর সমাধি। বাকি জায়গাগুলো একটু ঘুরে তাড়াতাড়ি শপিং এ চলে যাই যে যার মত। শপিং শেষে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে যাই। পরের দিন সকালে দিল্লীর আশে পাশের বাকি জায়গাগুলো ঘুরে শেষ হয় আমাদের দিল্লী পর্ব।

সন্ধ্যায় রওনা দিবো মানালীর উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যার একটু আগে মানালীর উদ্দেশ্যে আমাদের বাস ছাড়লো। বাস ছুটে চললো তার নিজের গতিতে। ভারতীয় রাস্তার প্রশংসা না করলেই নয়। চলন্ত গাড়িতে বসে চা খেয়ে নিলাম। ঘণ্টা পাঁচেক সমতল রাস্তায় চলার পর হঠাৎ গাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় উঠে গেল। বোঝার বাকি ছিল না যে, আমরা হিমাচল প্রদেশে ঢুকে গেছি। কি ভয়ংকর রাস্তা তা না দেখলে বোঝা যাবে না। ড্রাইভার যে কত দক্ষ তা তার চালনাই বলে দেয়। পাহাড় কেটে কেটে আঁকাবাঁকা রাস্তা করা। গাড়ি ভালো গতিতেই চলতে ছিলো। অনেকেই এর মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পরে কারণ, আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলায় আমরা অভ্যস্ত ছিলাম না। হাল্কা ঠাণ্ডা লাগছিলো। সকাল ৭ টার দিকে আমরা মানলী বাস স্টেশনে এসে নামি। নেমেই চোখে পরে সাদা মেঘরাশি। আমাদের ছুয়ে দিয়ে যায় শীতের আমেজ। পাহাড়ি গাড়ি আমাদের দিয়ে আসে হোটেলে। হোটেলে গিয়ে সবাই ঘুম। বিকালে বের হই মানালীর পাহাড়ি রাস্তায় হাটতে।

সন্ধ্যায় মানালী মার্কেটে যাই ঘুরে দেখার জন্য তখন অনেকেই শপিং করে নেয়। একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট এ মাটন চাওমিন খাই পুরা চাইনিজ স্টাইলে। রাতে রুমে ফিরে আড্ডা মাস্তিতে কেটে যায় রাতের অনেকটা সময়। বাকি সময়টা ঘুমিয়ে কাটাই। সকালে উঠেই নাস্তা সেরে নেমে পরি কুল্লু পাহাড় জয়ে। পাহাড়ের রাস্তায় হাটা যে কত কষ্টের তা বোঝাই যাচ্ছিলো না। পাহাড়ের ঢালে আপেল বাগান সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। গাছে যেন সবই আপেল, পাতা আর দেখা যায় না। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গাছ থেকে আপেল পেরে খেয়ে নিলাম অনেকেই। হাটতে হাটতে প্রায় ২ ঘণ্টা পর উঠে গেলাম পাহাড়ের চূড়ায়। নিষেধাজ্ঞার কারণে এরপর আর যাওয়া যাবে না। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আবার নিচে নামার পালা। নামাটা অনেকটা সহজ কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নামার সময় এক আপেল বাগান কর্মী আমাদের সৌজন্যে আপেল উপহার দিলেন অনেকগুলো।  তিনি আমাদের পানি খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিলেন এবং অনেক দূর এগিয়ে দিয়ে গেলেন। আসলেই পাহাড়ের মানুষগুলো সমতলের থেকে অনেকটাই আন্তরিক।

পাহাড় থেকে হোটেলে ফিরতে প্রায় বেলা ৩ টা বেজে গেছিলো। দুপুরের খাবার শেষে বাকি সময়টায় ওখানের আশপাশটা ঘুরে দেখি। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুম। সকালে বের হবো বিশ্বের সর্বোচ্চতার হাইওয়ে রোথাং পাস দেখার জন্য। গাড়ি আগের দিনই ঠিক করে রাখছিলাম। সকালে তারা যথা সময় হোটেলের সামনে এসে হাজির। আমরা সকালের নাস্তা সেরে গাড়িতে উঠি। গাড়ি পাহাড়ের রাস্তা পাড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠছিল।

মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো যে, এই মনে হয় আমার শেষ যাত্রা। তারপরও আলাদা আবেগ কাজ করছিলো। এর মধ্যে আমরা ঠাণ্ডা উপশমের জন্য আলাদা জ্যাকেট ভাড়া নিয়েছিলাম। ওখানের তাপমাত্রা  অনেকটা কম যেটা আমাদের শীতের কাপড় সামাল দিতে পারতো না। ঘুরতে ঘুরতে গাড়ি রোথাং পাসে। নেমে চারদিক তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো আমরা অন্য কোন গ্রহে। প্রকৃতির অপরুপ লীলাভূমি। মেঘগুচ্ছ অনেক নিচে দেখা যাচ্ছিলো। চোখকে ফিরানো যাচ্ছিলো না। সবার মধ্যেই আলাদা উত্তেজনা আমরা কোথায়? মানালী নাকি হিমালয়? প্রকৃতি কতটা সুন্দর তা মানালীর রোথাং পাস আমাদের দেখিয়েছে। হঠাৎ করেই মেঘ আমাদের চারদিক ঘিরে ফেলে। পাশেরজনকে দেখা যাচ্ছিলো না মেঘের ঘনত্বে।

তাপমাত্রা তখন মাইনাস অনেকটা। শুরু হয় বৃষ্টি। হাত পা অবশ হয়ে আসছিলো ঠাণ্ডায়। কফি নিলাম তাও মুহুর্তে কোল্ড ড্রিংক হয়ে গেলো। এ অবস্থায় সারভাইভ করাটা আসলেই কঠিন। তবে কিছু সময় পর বৃষ্টি কমে গেলো। আমরা আশেপাশের জায়গা ঘুরে আবার গাড়িতে উঠে গেলাম। গাড়ি নিচের দিকে চললো। গাড়ি নামার সময় ভয়টা আরো বেশি কাজ করতে ছিলো। একটু মিসটেক হলেই কয়েক হাজার ফিট নিচে। যাই হোক অনেকটা ভয়তে নিচে নামলাম। এরপর আরো কয়েকটা যায়গা ঘুরে সন্ধ্যার আগে আগে হোটেলে পৌছাই। রাতের মানালী ঘুরে দেখে বাকিটা সময় হোটেলে আড্ডা দিয়ে ঘুম। পরের দিন সকালে আসে পাসের বাকি জায়গা গুলো ঘুরে দুপুরের খাবার খেয়ে আমাদের সবকিছু গুছিয়ে নেই। সন্ধ্যায় সিমলা উদ্দেশ্যে বাসে উঠি।

সকালে বাস শিমলা পৌছায়। হোটেলে গিয়ে সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে সিমলা ঘুরতে বেরিয়ে পরি। শিমলার রাস্তায় হাটা আরো কঠিন। আমরা সিমলার জিরো পয়েন্ট, স্কান্ডেল পয়েন্ট, গির্জা আরো কয়েক টা যায়গা খুব দ্রুত ঘুরে নেই। স্কান্ডেল পয়েন্ট, গির্জাতে থ্রি ইডিয়ট মুভির শুটিং হয়েছে। তাড়াতাড়ি ঘোরা শেষ করে হোটেলে যাই। বিকাল ৪ টায় ট্রেন উঠি কোলকাতার উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আকাবাকা ট্রেন লাইন। ট্রেন আস্তে আস্তে যাচ্ছে আর আমরা উপভোগ করছিলাম পাহাড়ি সৌন্দর্য। এভাবে করে রাত ১০ টার দিকে কোলকাতা পৌছাই।

আমাদের ট্যুরের ইতিমধ্যেই বিদায় ঘণ্টা বেজে আসছিলো। ট্রেনে উঠেই সবাই ঘুম। এত দিনের জার্নিতে সবাই কিছু না কিছু ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলো।

৩৪ ঘণ্টা পর ট্রেন ২ তারিখ সকালে কলকাতার হাওড়া এসে পৌছায়। ততক্ষণে কোরবানি ঈদের নামাজ পরে লোকজন ফিরছিলো। জীবনের প্রথম ঈদ বিদেশের মাটিতে। রেল স্টেশন থেকে সোজা হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পরি কোরবানি ঈদের আমেজ নিতে। পাঞ্জাবী, টুপি পরে বাংলাদেশের মত বেড়িয়ে পরি। তবে ওখানের কোরবানি অনেকটা আমাদের থেকে আলাদা। কোনো আমেজ নাই। আমরা দুপুরে খাওয়ার জন্য গরুর মাংস খুজছিলাম কিন্তু কোথাও মাংস তো দূরের কথা দুপুরে ভাত পর্যন্ত খেতে না পেরে ফাস্টফুড দিয়ে দুপুরের খাবার চালিয়ে দেই। এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা। বিকালে টুকটাক কেনাকাটা করে পরের দিন দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা। হরিদাশপুর বর্ডার ক্রস করে বেনাপোলে। তখন বিকাল ৩ টা কি ৪ টা। মনের মধ্যে আলাদা প্রশান্তি। দীর্ঘ ১৮ দিন শেষে আমরা দেশের মাটিতে। অনেক মজা করেছি, আনন্দে কাটিয়েছি কিন্তু মনের মধ্যে কেমন যেন খালি খালি লাগছিলো দেশের শূন্যতা।  তখনই মনে হচ্ছিলো মাইকেল মধুসূদন দত্ত কেন বিদেশের মাটি ছেড়ে দেশের টানে ফিরে আসছিলো। তবে আলাদা অভিজ্ঞতা, আলাদা ভালো লাগা ছিলো ভারতের ওই ১৮ দিন।

জীবনে অনেক কিছু শিখে আসলাম। ধন্য মোরা ধন্য। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আমাদের গাইড স্যার ড. এ. এস. এম. ইকবাল হোসাইন স্যার ও  ড. শাহ মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম স্যারকে।

বিশেষ ধন্যবাদ রিফাত, নাজমুল, শেখ নাজমুল, মীর ইব্রাহিম, নাঈম, এশা, দীপা, সানজিদা, ইতি, এস এম রিফাত, ফয়সাল, প্রমি, নিভা, নিশা, নিশু, সান্তা, সাজ, বিশাল, ইমরান, নাঈম, হলি, উইনি, শুভ, কল্যান, ফিরোজ, কেয়া, সাকিব, নেন্সি, আশিক ভাই, আয়েশা সহ সবাইকে।

লেখক: এম এস ছাত্র, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

This post has already been read 5547 times!

Check Also

বইমেলায় আসছে দেশসেরা ভ্রমণ লেখকদের বই ‘ট্রাভেলার’

এগ্রিনিউজ২৪.কম: দেশে যেন ভ্রমণের জোয়ার শুরু হয়েছে। তরুণদের পাশাপাশি সববয়সী মানুষ দেশের এ স্থান থেকে …