ডা. বিপ্লব কুমার প্রামাণিক: কথিত আছে রোম সম্রাজ্যের সূর্য কখনও অস্তমিত হবে না। কিন্তু অস্তমিত হয়েছে। পতন হয়েছে ইতিহাসের কিংবদন্তীর। দুর্দান্ত প্রতাপের সেই ইতিহাস গোটা রোম জুড়ে। কিছুটা হয়ত দেখা যাবে, অনেকটাই দেখা যাবে না, মাটির নিচে হয়ত চাপা পড়ে রয়েছে কতশত বীরত্ব আর শোক গাঁথা। তবে পঞ্চইন্দ্রিয় সজাগ করে সেই ইতিহাসের পথে হাঁটা দিলে কিছুটা হলেও ছোঁয়া যাবে সেই কিংবদন্তী, যা হাজার হাজার বছর আমাদের মোহমুগ্ধ করে রেখেছে।
রোমের গল্প বলে শেষ করা যাবে না- কোথায় শুরু করে কোথায় শেষ করব? রোমের পথে পথে, দালানে পাথরে, চার্চ আর কাথিড্রালে, দুর্গ, পরিখা আর সুরম্য অট্টালিকার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে- রাজনীতি, ধর্ম, সাম্রাজ্য, দর্শন আর ভাস্কর্য ও স্থাপত্য কলার এক অনুপম কবিতা।
আমরা এখন যাকে মোড় বা স্কয়ার বলি- ইতালিয়ান ভাষায় তাকে বলা হয় পিয়াজ্জা। এগুলোই ছিল প্রাচীন রোমের আত্মা। পিয়াজ্জা গুলো ছিল মিটিং, গ্রীটিং আর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার কমন স্পেস। এরকম কয়েকটি দর্শনীয় জায়গা হল- পিয়াজ্জা ভেনিজিয়া, পিয়াজ্জা ডেল স্পাগনা, পিয়াজ্জা সান্টা মারিয়া, পিয়াজ্জা ডেল পোপোলো, পিয়াজ্জা নাভোনা আর পিয়াজ্জা সান পিয়েট্রো (যা ভ্যাটিক্যান স্টেট নামে পরিচিত, সময় পেলে আলাদা করে লেখার ইচ্ছা আছে)। পিয়াজ্জার গল্প গুলো এত বড় আর বিশাল যে, তা বলার জন্য ইতিহাসবিদ কিংবা নিদেনপক্ষে প্রফেশনাল ট্যুর গাইড দরকার। যাদের রোমের পথে পথে দেখে আমি হতবাক হয়ে গেছি, যারা অবলীলায় হাজার বছরের ইতিহাস দিন ক্ষনসহ বলে যাচ্ছে। আমি এক সাধারণ পর্যটক মাত্র, আমার জন্য সাধারন চোখে দেখা জনপ্রিয় গল্প বলাই ভালেঅ।
গ্ল্যাডিয়েটর মুভিতে রাসেল ক্রোর অভিনয় আমাদের সকলের ভীষণ প্রিয়। গ্ল্যাডিয়েটররা যেখানে তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করত, প্রানপাত করে এলিটদের বিনোদিত করত- সেই জায়গাটার নাম কোলোসিয়াম। দুনিয়ায় সব থেকে বড় ফ্লেভিয়ান যুগের এম্ফি থিয়েটার। এটা কত বড় আর কত নিষ্ঠুর- তা অবাক করার মত! প্রথম শতকে এটি নির্মিত হয়- ৭২ থেকে ৮০ এডি মোট দশ বছরে প্রায় ৫০,০০০ ইহুদি দাসের শ্রমে। এটার উচ্চতা আমাদের এখনকার গড়পড়তা ১২ তলা বিল্ডিং-এর মত।
ভাবা যায়- সেই প্রথম দশকে একসাথে ৫০-৮০ হাজার দর্শক একসাথে বসতে পারত! দর্শক গ্যালারীতে শ্রেনী বিভাজন ছিল- রাজন্যদের, রাজকুমার, রাজকুমারী আর মাননীয় সিনেটরদের আলাদা আসন আর কক্ষ ছিল- ঠিক যেমন আমাদের ভি আই পি বক্স। সাধারনরা বসত সাধারন গ্যালারীতে। আমজনতা বিনা পয়সায় খেলা দেখতে পারত, কখনো কখনো জুটত বিনে পয়সায় খাবার। ৯০টির মত প্রবেশ পথ ছিল। মাঝখানে বিশাল গোলাকার কাঠের তৈরী মঞ্চ। কাঠের মঞ্চের নীচেই ছিল আন্ডার গ্রাউন্ড ৩৬টি কক্ষ যেখানে হিংস্র প্রাণি আর গ্ল্যাডিয়েটররা তৈরী থাকত যুদ্ধের জন্য।
তৈরির পর অন্তত শ’পাচেক বছর ধরে চলেছে এই নির্মম খেলা। প্রানপাত করেছে ৪ থেকে ৫ লাখ গ্ল্যাডিয়েটর আর লাখ দশেক নিরীহ প্রাণী। গ্ল্যাডিয়েটররা ছিল মূলত দাস, দাগী অপরাধী অথবা যুদ্ধবন্দি। কেউ কেউ বীরত্ব প্রদর্শন এর জন্য গ্ল্যাডিয়েটর হয়েছিল বলেও জানা যায়। জয়ী গ্ল্যাডিয়েটররা সম্মানের অধিকারী ছিল।
শুধুই যে প্রানী আর গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধই হত তা নয়- এখানে আয়োজন করা হত অভিষেক অনুষ্ঠান, যুদ্ধ জয় উৎযাপন, নানা রকম খেলা ধুলা- কোন কোন অনুষ্ঠান টানা ১০০ দিন ধরেও চলত।
বেরিয়ে আসার সময় রাসেল ক্রোর চেহারা ভেসে উঠল। গ্ল্যাডিয়েটর বলতে আমি তাকেই চিনি। মানুষের হাতে মানুষের এই নির্মম পতন দেখে বুকের কোনায় ব্যথা অনুভব করি, আবার আশায় বুক বাঁধি এই ভেবে যে,মানুষ তার পতনের উপর দাড়িয়েই নির্মাণ করেছে আজকের সভ্যতা। মানবিক সমাজ।