বৃহস্পতিবার , নভেম্বর ২১ ২০২৪

সাদা নাকি লাল ডিম; নয় কোন হিমশিম!

মো. খোরশেদ আলম জুয়েল : বাজারে সাধারণত দু’ রঙের ডিম পাওয়া যায়। সাদা এবং বাদামি বা লাল ডিম। হাল্কা নীলাভ বা সবুজাভ ডিমও পাওয়া যায় তবে সেটি তুলনামূলক কম। তামাটে কিংবা বাদামি বর্ণের চেয়ে সাদা মনের মানুষ, ফর্সা গায়ের রঙের মানুষের প্রতি বেশিরভাগেরই আগ্রহ অনেক। বর্ণ বৈষম্য কিংবা বর্ণ প্রথায় দুনিয়াব্যাপী সাদা রঙের আধিপত্য থাকলেও ডিমের বেলায় বিষয়টি আবার উল্টো। ডিম রাজ্যে বাদামি, তামাটে কিংবা লালদের আধিপত্য সাদা’র চেয়েও শক্তিশালী। হতে পারে মানুষের তৈরি বর্ণ বৈষম্যের প্রতি ডিম মহাশয়ের মাধ্যমে প্রকৃতির এটি একটি চ্যালেঞ্জ! তবে ভুলটা শেষমেষ মানুষেই করে; প্রকৃতি নয়। শুধু পাত্র-পাত্রীর গায়ের রঙ নয় ডিমের রঙ নিয়ে আমাদের আমাদের সমাজে এক ধরনের মিথ (Myth) প্রচলিত আছে। তবে পাত্রী পাত্রীর জন্য অনেক অভিভাবকরা ধবধবে ফর্সা খুঁজলেও ডিমের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাতিক্রম; ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অধিকাংশের কাছেই ফর্সা ধবধবে সাদা নয়, বাদামি ডিম (প্রচলিত ভাষায় লাল ডিম) বেশি জনপ্রিয়। কারণ বাদামি ডিম নাকি খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ বেশি। ধারণাটি কী আসলেই সঠিক; নাকি কেবলই মিথ আসুন জেনে নিই সে সম্পর্কে।

সাদা কিংবা বাদামি ডিমের ভালো মন্দ বিষয়ে জানার আগে আমাদের জানা উচিত রঙের পার্থক্য কেন হয়। আসলে ডিমের রঙের বিষয়টি সম্পূর্ণই নির্ভর করে এর জ্বীনগত বৈশিষ্টের ওপর। শুধু ডিম কেন যেকোন প্রাণির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, গায়ের রঙ আকার আকৃতি সব কিছুর সাথে জীনের এক সুনিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এই যেমন ধরুন ফর্সা মা বাবার সন্তান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফর্সা হবে আর কালোর ক্ষেত্রে কালো। ব্যতিক্রম যে একদমই না তা বলা যাবেনা, তবে সেটি পরিমাণে কম। মুরগীর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম। সাধারণভাবে সাদা মুরগী সাদা ডিম আর লাল মুরগী বাদামী বা লাল ডিম পাড়ে। সাধারণত কমার্শিয়াল লেয়ার বা বাণিজ্যিকভাবে পালিত মুরগীর ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন হয়। আবার দেশি মুরগির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আবার ভিন্ন। দেশি মুরগী লাল কালো ধলো যাইহোকনা কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাদা ডিমই পাড়ে। তবে হ্যাঁ, কালো মুরগী কিন্তু কালো ডিম পাড়ে না। বাজারে যেসব ডিম পাওয়া যায় তার সিংহভাগই ফার্মের বা কমার্শিয়াল লেয়ার মুরগীর। আর ওসব ডিমের লাল সাদার বিষয়টি সম্পূর্ণই মুরগীর গায়ের কিংবা পালকের রঙের ওপর নির্ভরশীল। এটি জীন বা জাতগত বৈশিষ্ট্য এবং এ কারণেই ডিমগুলোর রঙ পাল্টে যায়।

অনেকের ধারণা লাল ডিমের কুসুম বেশি লাল এবং সাদা ডিমের কুসুম অপেক্ষাকৃত কম লাল। সাধারণ ভোক্তারা একটু গাঢ় রঙের কুসুম সমৃদ্ধ ডিম খেতেই পছন্দ করেন। কারণ সেটি অপেক্ষাকৃত সুস্বাদু। তবে ডিমের কুসুমের রঙ গাঢ় হবে, না হাল্কা হবে সেটি নির্ভর করে ক্যারোটিন নামক এক পদার্থের উপস্থিতির ওপর। মুরগীর গায়ের রঙ যাইহোকনা কেন তাকে অধিক ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ালে তার ডিমের কুসুমের রঙ বেশি গাঢ় হবে। এমনকি ভোক্তা চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে অনেক কোম্পানি মুরগীর ফিডের সাথে ক্যারোটিন যোগ করেন। যাতে ডিমের কুসুমের রঙ একটু গাঢ় হয়। তবে এক্ষেত্রে উল্লেখিত ক্যারোটিনের নিউট্রিশনাল ভ্যালু নেই বললেই চলে। একটি ডিমের পুষ্টিগুণ নির্ভর করে আসলে মুরগী কী ধরনের পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খায় তার ওপর। রঙটা আসলে এখানে মুখ্য বিষয় নয়।

আবার ডিমের খোসার ক্ষেত্রেও অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, বাদামি ডিমের খোসার পুরুত্ব বেশি। আসলে কথাটি একদমই ঠিকনা। বিশেষজ্ঞদের মতে হাঁস-মুরগির ডিমের খোসা বা গায়ের রঙের ক্ষেত্রে সূর্যালোক একটি বড় ফ্যাক্টর। সাধারণত গৃহপালিত হাঁস কিংবা মুরগীর ডিমের কুসুমের রঙ একটু গাঢ় থাকে। কথাটা খুব আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, যেসব হাঁস-মুরগি রোদে বেশি সময় থাকে সেসব হাঁস-মুরগির ডিমে ভিটামিন-এ ও ডি বেশি থাকে। বাংলাদেশের গৃহস্থালীর হাঁস-মুরগিতে প্রচুর ভিটামিন এ, ডি থাকে। ফলে এসব হাঁস বা মুরগীর কুসুমের রঙ ও বেশ গাঢ় হয়। পোলট্রি ফার্মের মুরগীগুলো আলো-বাতাস এবং ঘাস-পাতা কম পায় বলে এসব মুরগীর কুসুমের রঙ অপেক্ষাকৃত হাল্কা হয়। তারমানে কিন্তু এই নয় ফার্মের ডিমে ভিটামিন এ, ডি পাওয়া যায় না। বরং বাণিজ্যিক ফার্মগুলোতে মুরগীর খাবারের সাথে এক্সট্রা ভিটামিন এ ও ডি যোগ করা হয় যাতে ডিমের সবগুলো পুষ্টিগুণের ভারসাম্য থাকে। ডিমের খোসা কিংবা কুসুমের রঙ এক্ষেত্রে কোন ফ্যাক্টর নয়।

কর্নেল ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিজ্ঞানের ভিজিটিং ফ্যালো ট্রোয়ের মতে, বাদামি ডিম এবং সাদা ডিমের পুষ্টিগত কোন পার্থক্য নেই। বাদামি ডিমে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড একটু বেশি রয়েছে। তবে সেই একটু বেশির পরিমাণ এতই নগণ্য যে সেটি হিসেবের বাইরে রাখলেই চলে। ফলে আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন সাদা আর বাদামি ডিম দুটোই সমান পুষ্টিগুণ ধারণ করে। আবার ভিন্নমত যে একেবারেই নেই তা নয়। কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে, কোলেস্টেরল এবং ক্যালরি বিবেচনায় সাদা ডিমের তুলনায় বাদামি ডিম বেশি ভালো।

এতো গেল পুষ্টিমান নিয়ে মত ও দ্বিমত। কিন্তু স্বাদ? বাদামি ও সাদা ডিমের স্বাদ কি ভিন্ন হয়? এখানেও মানসিক পছন্দের কিছু বিষয় কাজ করে। এই যেমন ধরুন ধনে পাতা দিলে তরকারির স্বাদ বাড়ে এমনটি যেমন অনেকেই মানেন আবার দেশে এমন অনেক অঞ্চলের লোক রয়েছে যারা ধনেপাতার ব্যবহার সহ্যই করতে পারেন না। আসলে ডিমের স্বাদ নির্ভর করে মুরগির খাদ্যাভ্যাসের ওপর। প্রাকৃতিক খাবারে অভ্যস্ত মুরগীর ডিমের এক রকম স্বাদ আবার মিল ফ্যাক্টরির তৈরি খাবারে অভ্যস্ত মুরগীর ডিমের আরেক রকম স্বাদ। শুধু মুরগী কেন প্রাকৃতিক খাবারে অভ্যস্ত যেকোনো পাখির ডিমের স্বাদ ও গন্ধ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ডিমের চেয়ে ভালো হবে এটিই স্বাভাবিক। বিষয়টি কেবল স্বাদ ও গন্ধের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পুষ্টিগুণের বিবেচনায় কোন পার্থক্য নেই। বরং ফার্মের ডিমের সাইজ দেশি ডিমের সাইজের তুলনায় বেশ বড় এবং দামে কম হওয়ায় তুলনামূলক অধিক পুষ্টি পাওয়া যায়। ডিমের খোসার রঙ কোন বিষয় নয় তা সে লাল নীল সাদা যে রঙেরই হোক। মুরগীর খাবারটাই এখানে আসল ফ্যাক্টর। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি সাদা এবং বাদামি পালকওয়ালা মুরগীকে একই রকম খাবার খাওয়ানো হয় তাহলে তাদের ডিমের রঙ ভিন্ন হবে কিন্তু স্বাদ ও গন্ধের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না।

শুধু পুষ্টিমান এবং স্বাদই নয় ডিমের খোসার পুরুত্বের ক্ষেত্রেও লাল এবং সাদা ডিমের কোন পার্থক্য নেই। এটি নির্ভর করে ডিমপাড়া মুরগীর বয়সের ওপর। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী মুরগীর ডিমের খোসার পুরুত্ব একটু বেশি ও শক্ত হবে এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুত্ব অপেক্ষাকৃত হাল্কা হবে।

এখন খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে এতই যখন সমানে সমান; তবে সাদা ডিমের চেয়ে বাদামি ডিমের দাম বেশি কেন? খুব সহজ করে বলতে গেলে সাদা ডিমের তুলনায় বাদামী ডিমের উৎপাদন খরচ বেশি। কারণ লাল পালকের লেয়ার মুরগী সাদা পালকের মুরগীর তুলনায় বেশি খাদ্য খায়। এদের ডিম উৎপাদন ক্ষমতাও সাদা মুরগীর তুলনায় দুই চার শতাংশ কম। প্রশ্ন আসতে পারে খামারিরা তাহলে বাদামি বা লাল লেয়ার মুরগী কেন বেশি পালন করেন? এক কথায় উত্তর হলো- ভোক্তা চাহিদা বেশি। তাছাড়া এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি।

সবাই যে বাদামি ডিম পছন্দ করেন তাও নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়। অনেকেই আবার বাদামি ডিম এড়িয়ে চলেন কারণ তাদের ধারণা সাদা ডিমের চেয়ে বাদামি ডিমে ব্লাড স্পট বেশি থাকে। এ কথা সত্য মোটামুটি ২৫-৩০ ভাগ বাদামী ডিমেই পিগমেন্ট স্পট বা প্রোটিন স্পট বেশি থাকে। আসল ঘটনা হলো প্রোটিন স্পট আর ব্লাড স্পট এক জিনিস নয় এবং সেগুলো খাওয়া সম্পূর্ণই নিরাপদ।

মোটকথা হলো ডিমের গায়ের রঙ যাইহোক স্বাদ ও পুষ্টিমানের ক্ষেত্রে এদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। রঙ যাইহোক ১টি ডিমে ১২-১৪% প্রোটিন, ১০-১২% স্নেহ ও ১০% খনিজ পদার্থ বিদ্যমান থাকে। ডিমের খোসার ওজন সম্পূর্ণ ডিমের ১১% হয়ে থাকে। ডিমের সাদা অংশের তুলনায় কুসুমের পুষ্টিমূল্য বেশি। গায়ের রঙ দিয়ে যেমন মানুষের কোয়ালিটি বিবেচনা করা ঠিক নয়; তেমনি ডিমের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমভাবে প্রযোজ্য।

This post has already been read 5097 times!

Check Also

ডিমের মূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় সমস্যা- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

পাবনা সংবাদদাতা: ডিমের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় সমস্যা উল্লেখ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা …