শনিবার , ডিসেম্বর ২১ ২০২৪

কিডনিসহ নানা রোগে দুর্লভ গাছ ‘কিডনি টি প্লান্ট’

মৃত্যুঞ্জয় রায় : ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার মলাজানি গ্রামে এক গারো আদিবাসী বাড়ির সীমানায় একটা ঘন সবুজ ঝোপের মধ্যে মুকুট উচিয়ে এক থোপা সাদা ফুলের মঞ্জরি দেখে গাছটিকে চেনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু প্রথম দর্শনেই তাকে অচেনা মনে হলো। বাড়ির কর্তা নিকুঞ্জ ম্রোংকে জিজ্ঞেস করেও এ গাছের কোনো নাম পেলাম না। তবে তিনি জানালেন, বছর সাতেক আগে ওয়ার্ল্ড ভিশনের জনৈক কর্মকর্তা বিমল বাবু জাপান থেকে তাকে এ গাছের চারা এনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এ গাছের পাতা প্রস্রাবের যতো অসুখ আছে তা ভালো করবে। এমন দরকারি একটা গাছ উপহার পেয়ে তিনি তার বাড়ির আঙিনাতেই গাছটি লাগিয়ে যত্ন শুরু করেন। দেখতে দেখতে গাছ বড় হয়ে বেশ খানিকটা জায়গা ঝোপ করে ফেলে। নিকুঞ্জ ম্রোং তলপেটে ব্যথা বা প্রস্রাবের জ্বালা যন্ত্রণা হলে সেই গাছের পাতা তুলে জলে সেদ্ধ করে ছেঁকে সেই জলটা ঠান্ডা করে খান। তাতে এসব সমস্যা দূর হয়ে যায়। এ গাছের বিদ্যে তার এ পর্যন্তই জানা। বলেন, ঔ গ্রামে শুধু তার বাড়িইে এ গাছটি আছে। তিনি আর কোথাও এ গাছ দেখেননি। সত্যি বলতে কি, আমিও দেখিনি।

ঢাকায় ফিরে গাছটির তত্ত্ব তালাশ শুরু করি। সারা বিশ্বে এ গাছটি যে এতো গুরুত্বপূর্ণ দরকারি একটা গাছ তা জানা ছিল না। নিকুঞ্জ ম্রোং এর কথাই সত্যি। প্রস্রাবের অসুখটা হয় কিডনীর সমস্যা থেকে। এ গাছ সেই সমস্যা দূর করতে পারে বলেই তার ইংরেজী নাম Kidney Tea Plant, অন্য নাম Java tea ও Cats Whiskers. হলো বেড়ালের মোচের মতো এ ফুলের লম্বা সরু পুরুষ কেশরগুলো। সেজন্য কিনা জানিনা, এ গাছের বাংলা নাম করা হয়েছে হুলাবনকিকার। এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Orthosiphon aristatus, পরিবার Labiatae or lamiaceae. বিড়ালমোচী নামও রাখা যেত। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে জাভা টি ঔষধি পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ অঞ্চল থেকে জাভা টি আমেরিকা, জার্মানীসহ ইউরোপের অনেক দেশে রপ্তানি করা হয়। ইন্দোনেশিয়া এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান জাভা টি রপ্তানিকারক দেশ।

উৎপত্তি ও বিস্তার
এ গাছের আদিনিবাস আফ্রিকা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি গাছ। তবে কেউ কেউ শখ করে ফুলগাছ হিসেবে এ গাছ লাগায়। এ দেশে দুর্লভ, সচরাচর চোখে পড়ে না। তবে এ দেশের উদ্ভিদ সম্পদের তালিকায় গাছটির অস্তিত্ব আছে। তার মানে দেশের কোথাও না কোথাও এ গাছটি রয়েছে। শুধু এ দেশেই নয়, দক্ষিণ চীন থেকে শুরু করে সমগ্র ভারতবর্ষ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ট্রপিক্যাল কুইন্সল্যান্ডেও এ গাছ আছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এ গাছের বাণিজ্যিক উৎপাদক। ইন্দোনেশিয়া এ গাছ থেকে তৈরি বিভিন্ন ঔষধ ও পানীয় সামগ্রী উৎপাদন করে বিভিন্ন দেশে তা রপ্তানি করে। বিশেষ করে এ গাছের পাতা থেকে প্রস্তুতকৃত এক ধরনের চা সারা বিশ্বে ‘জাভা টি’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে যার ঔষধি গুণ থাকায় অনেকের কাছে সমাদৃত হচ্ছে। এমনকি আমেরিকার বাজারেও জাভা টি’র প্যাকেট পাওয়া যায়। ইউরোপের বাজারেও এর চাহিদা আছে। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা ও জাভায় এর চাষ হয়। সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে বনেজঙ্গলে ও বনের কিনার ধরে এ গাছ জন্মে। তবে রাস্তার ধারে ও পতিত জমিতেও এ গাছ দেখা যায়। চীন, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন, পাপুয়া নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে এ গাছ আছে বলে জানা গেছে।

রাসায়নিক উপাদান
এ গাছের পাতায় এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান আছে যা বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে, কিছু রোগ নিরাময়ও করে। পাতায় সাইনেসেটিন সহ আরও কিছু ফ্লাভিনয়েড রয়েছে, এ ছাড়া আছে স্যাপোনিন, গ্লাইকোসাইড (অর্থোসিফোনিন), কিছু এসেনশিয়াল তেল, ক্যাফেইক এসিড ও উচ্চ মাত্রার পটাসিয়াম।

ঔষধি গুণ
কিডনির বিভিন্ন সমস্যা এ গাছ দূর করতে সাহায্য করে বলেই এ গাছের লৌকিক নাম ‘কিডনি প্লান্ট’। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের অধিবাসীদের বিশ্বাস, এ গাছের পাতা কিডনির পাথর (সর্বোচ্চ ৫ সেন্টিমিটার আকারের) পর্যন্ত অপসারণ করে দিতে পারে। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলেও তা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কিডনির সংক্রমণ, মূত্রথলির সংক্রমণ, মূত্রনালির সংক্রমণ, মূত্রথলির পাথর ইত্যাদি নিরাময়ে এ গাছ ব্যবহার করা হয়। মূত্রঘটিত বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে এক গ্লাস পানিতে সিকি মুঠো পাতা জ্বাল দিয়ে আধা কাপ থাকতে নামিয়ে তা ঠান্ডা করে দিনে দুবার খেতে হবে। এতে উপকার হবে। মূত্রথলির পাথর অপসারণে ৯০ গ্রাম হুলাবনকিকার পাতা এক লিটার পানিতে জ্বাল দিয়ে পানি অর্ধেক হলে তা নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে। তারপর সেই পানি ছেঁকে দিনে একবার খেতে হবে।

এ গাছ কিডনি ও মূত্রথলির নানা সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এজন্য এ গাছের এক নাম কিডনি টি প্লান্ট। প্রসাবের নানারকম সমস্যায় এ গাছ বেশ কার্যকরী। বিশেষ করে প্রসাবের প্রবাহ ঠিক রাখতে এ গাছ ব্যবহার করা যায়। শুধু কাঁচা পাতাই নয়, এর শুষ্ক পাতারও ঔষধি গুণ রয়েছে। এর পাতা থেকে তৈরি বিভিন্ন বড়ি বা ট্যাবলেট, ক্যাপস্যুল, চা ইত্যাদি বাজারে বিক্রি হয় যার ঔষধি মূল্য রয়েছে।

এছাড়াও শ্বাসজনিত সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, গেঁটেবাত, স্নায়ুরোগ, দাঁতের সমস্যা, চর্মরোগ, ওজন হ্রাস সমস্যা ইত্যাদিতে এ গাছ কার্যকর। কিডনির সংক্রমণ, কিডনির পাথর ও মূত্রস্বল্পতা নিরাময়ে এ গাছের পাতা ব্যবহার করা হয়। এ গাছের পাতার রসের ব্যাকটেরিয়া জীবাণু ধ্বংসের ক্ষমতা আছে বলে জানা গেছে।
কমে যেতে পারে।

চাষাবাদ
সাধারণত এ দেশে এ গাছ কেউ লাগায় না, বনেজঙ্গলে আপনা আপনি জন্মে। গাছ রোদেলা জায়গায় ভালো বাড়ে। তবে কিছুটা ছায়া জায়গাতেও চাষ করা যায়। সুনিষ্কাশিত প্রচুর জৈব সার দিয়ে চাষ করলে গাছ দ্রুত বাড়ে ও বেশি পাতা পাওয়া যায়। শুষ্ক জায়গার চেয়ে কিছুটা ভেজা জায়গা হলে গাছ ভালো বাড়ে। নিরপেক্ষ থেকে কিছুটা ক্ষারীয় মাটিতে ভালো জন্মে, তবে মাটি কিছুটা অম্লীয় হলেও গাছের ক্ষতি হয় না। গাছ খরা সইতে পারে। বয়স্ক ডালের ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার অংশ কেটে শাখা কলম করে এর চারা তৈরি করা যায়। ডালের অংশটুকু এমনভাবে নিতে হবে যে অংশে কিছু গিঁট থাকবে। বেড তৈরি করে বা পলিব্যাগে এর চারা তৈরি করা যায়। বেড বা পলিব্যাগে কাটা ডালের টুকরো এমনভাবে পুঁতে দিতে হবে যাতে মাটির উপরে ডালের অন্তত একটি গিঁট থাকে। সেখান থেকে পাতা ছাড়বে। মাটির নিচের গিঁট থেকে শিকড় গজাবে। ছায়া জায়গায় চারা তৈরি করতে হয়। জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে চাইলে ১ থেকে ২ মিটার চওড়া করে নালা রেখে জমিতে বেড তৈরি করতে হবে। বেড তৈরির সময় মাটির সাথে প্রতি বর্গমিটারে ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি কেঁচোসার বা ২ কেজি গোবর সার মিশিয়ে দিতে হবে। সেখানে কাটিং বা শাখা কেটে তার টুকরো লাগাতে হবে সরাসরি। সেক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব দিতে হবে ৬০ সেন্টিমিটার ও কাটিং থেকে কাটিং বা চারা থেকে চারার দূরত্ব দিতে হবে ৪০ সেন্টিমিটার। লাগানোর সময় মাটিতে রস বা ‘জো’ অবস্থা থাকতে হবে। কাটিং বা চারা লাগানোর পর তার গোড়ায় ঝাঝরি দিয়ে অল্প পানি সেচ দিতে হবে। কোন কোন দেশে একটি গর্তে ৪-৬টি কাটিংও লাগানো হয়। এতে দ্রুত বেশি গাছ ও ঝোপ হয় যা থেকে বেশি পরিমাণে পাতা পাওয়া যায়। বছরের যেকোনো সময় কাটিং বা চারা লাগানো যায়। তবে বর্ষার শুরুতে লাগালে কাটিং বা চারা কম মারা যায় ও বাড়ে ভালো। নার্সারিতে চারা তৈরি করে লাগাতে হলে ৪৫ দিন বয়সের চারা জমিতে রোপণ করতে হবে।

পাতা সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ফলন
গাছ লাগানোর সাধারণত ৮ থেকে ১০ সপ্তাহ পর গাছে ফুল আসে। ফুল আসা শুরু হলে গাছ থেকে পাতা তোলা শুরু করা যায়। প্রতি ২-৩ সপ্তাহ পরপর পাতা তোলা হয়। সাধারণত ৪-১০টি পাতাসহ ডালের আগা সংগ্রহ করা হয়। হাত দিয়ে পাতা সংগ্রহ করতে হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে প্রতি হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১৫০০ কেজি শুষ্ক পাতার ফলন পাওয়া যায়। পাতার পরিমাণ অল্প হলে রোদে শুকিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু পাতার পরিমাণ বেশি হলে কৃত্রিমভাবে ড্রায়ারে শুকানো হয়। ভালো মানের পাতা বা চা পেতে হলে পাতাকে প্রথমে বাতাসে শুকিয়ে নরম করা হয়, এরপর ড্রায়ারে ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় শুকানো হয়। ভালোভাবে শুষ্ক পাতার রঙ সবুজ থাকে, কিন্তু বেশি তাপ দিলে বাদামি বা কালচে হয়ে যায়। ধাতব পাত্রে শুকালেও রঙ কালচে হয়। শুষ্ক পাতার আর্দ্রতা থাকে ১৪%। শুষ্ক পাতা কৌটা বা পলিব্যাগে প্যাকেট করে সংরক্ষণ ও বিক্রি করা যায়।

This post has already been read 13627 times!

Check Also

খামারীদের টাকা নিয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নয়-ছয়ের অভিযোগ!

মো. মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর সংবাদদাতা) : চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ ও উত্তরে ১৬০ জন খামারীর প্রত্যেকের …