রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪

নিত্য রোগের মহৌষধ জার্মানী লতা

মৃত্যুঞ্জয় রায় : ছোটোবেলায় হঠাৎ কোথাও কেটে রক্তপড়া শুরু হলে ঠাকুমা কোথা থেকে দুটো পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসতেন। পাতা দুটো বাম হাতের তালুতে রেখে ডান হতের আঙুল দিয়ে কচলে সেই পাতা বাটা রস সহ কাটা জায়গায় লাগিয়ে দিতেন। কি আশ্চর্য! মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যেতো। আর কাটা জায়গাটাও জোড়া লেগে যেতো। বাড়ির বেড়ায় বেড়ে ওঠা একটা লতানো গাছ। হৃৎপিন্ডের মতো আকৃতির তার সেই পাতা। ছোটোবেলায় আমরা সে গাছকে চিনতাম জার্মানী লতা নামে। পরে বড়ো হয়ে বই পড়ে ওর নাম পেলাম আসাম লতা। জার্মানী লতা হোক আর আসাম লতাই হোক, গাছটা যে ধন্বন্তরী তা সেই ছোটোবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলাম। আসাম লতার আরও অনেক নাম রয়েছে। যেমন- জার্মানী লতা (যশোর), রিফুজি লতা বা লিবুজী লতা (নোয়াখালী), বয়না লতা (বগুড়া), জাপাই নুয়ে (মারমা), কেলাথি (ত্রিপুরা), চিনা লতা (চাক), ওয়াই লতা (মুরং) ইত্যাদি। এ গাছের ইংরেজী নাম Climbing hemp, bitter vine, mile-a-minute vine,climbing hempvine, climbing hempweed, Heartleaf hempvine, louse-plaster ইত্যাদি। বসতবাড়ির জঙ্গল থেকে বনাঞ্চল- এ দেশের প্রায় সর্বত্র এ গাছের দেখা পাওয়া যায়। বনজ ও ফলগাছ বেয়ে এ লতা বেড়ে ওঠে ও কখনো কখনো গাছকে পুরো ঢেকে ফেলে। তাই ওসব গাছের জন্য আসাম লতা আগাছা। তবে এর ভেষজ গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে হাতের কাছে থাকা এ গাছ ব্যবহার করে কিছু প্রাথমিক ও সাধারণ চিকিৎসা করা যায়।

উদ্ভিদতাত্ত্বিক বর্ণনা
জার্মানী লতা এস্টারেসী পরিবারের গরশধহরধ গণের একটি উদ্ভিদ। সারা বিশ্বে এ গণের ৪২৫ টি প্রজাতির গাছ রয়েছে (King and Robinson, 1987). এই গণের বেশ কয়েক প্রজাতির গাছ এ দেশে দেখা যায়। এসব গাছের মধ্যে ৩টি প্রজাতির গাছ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো হলো- Mikania cordifolia(L. f.) Willd (রিফুজি লতা), Mikania scandens (L.) Willd. (জার্মানী লতা), Mikania scandens (L.) Willd. (আসাম লতা)। এশিয়ার অনেক দেশে ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে আর একটি প্রজাতির গাছ দেখা যায় (Tripathi et al., 2012), M. micrantha এটি হলো প্রজাতি।

উৎপত্তি ও বিস্তার
জার্মানী লতা, আসাম লতা ইত্যাদি গাছের উৎপত্তি মধ্য আমেরিকা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার অনেক দেশে জার্মানী লতার গাছ রয়েছে। দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশসমূহ, ক্যারিবীয় অঞ্চলেও এ গাছ আছে। বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন, শ্রীলংকা, চীন, মাদাগাস্কার, মরিশাস, মালাউ, কানাডা, মেক্সিকো, বাহামা, গুয়াম, পাপুয়া নিউগিনি, নিউ ক্যালেডোনিয়া প্রভৃতি দেশে এ গাছ দেখা যায়।

মাটি ও জলবায়ু
জার্মানী লতা উষ্ণ ও অবউষ্ণ অঞ্চলের উদ্ভিদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত এ গাছ জন্মাতে দেখা যায়। আর্দ্র অঞ্চল যেখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫০০ মিলিমিটারের বেশি সেখানে এ গাছ বেশি জন্মে। স্যাঁতসেঁতে ও আর্দ্র ভূমিতে এ গাছ ভালো জন্মে। শুষ্ক এলাকার মাটিতে এ গাছ খুব কম দেখা যায়। পতিত ও অব্যবহৃত জমি, রাস্তার ধার, খাল-নদী তীরবর্তী এলাকা, বনমুখের এলাকা, নতুন লাগানো বনাঞ্চল, পাহাড়ের পাদদেশ প্রভৃতি স্থানে এ গাছ বেশি দেখা যায়। আংশিক ছায়া জায়গায় এ গাছ জন্মাতে পারে, কিন্তু ঘন ছায়া সহ্য করতে পারে না। প্রবল বাতাস এ গাছের বীজ দূরবর্তী স্থানে ছড়াতে সাহায্য করে। যেকোনো মাটিতে এ গাছ জন্মাতে পারে। উর্বর মাটিতে এদের বৃদ্ধি বেশি হয়। এ গাছ সেসব অঞ্চলে ভালো জন্মে যেখানে দিনের তাপমাত্রা ২২ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। তবে এ গাছ ১৩ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তাপমাত্রা সইতে পারে। গাছ জন্মানোর জন্য উপযুক্ত মাটির অ¤øমান বা পিএইচ ৪.৫-৫.৫। অর্থাৎ কিছুটা অম্লীয় মাটিতে এ গাছ ভালো জন্মে।

রাসায়নিক উপাদান
পাতায় রিডিউচিং সুগার, ফ্লাভিনয়েড, স্যাপোনিন, অ্যালকালয়েড, ট্যানিন, ফ্লোবেটানিনস, স্টেরয়েড, কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড, এমিনোএসিড ইত্যাদি রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। পাতায় যেসব এসেনশিয়াল অয়েল রয়েছে সেগুলো হলো এ-পাইনিন (২০%), জার্মাক্রিন ডি (১৯.৮%), বিটা-পাইনিন (৮.৭%) ও আলফা-থুজিন (৭.১%)।

ব্যবহার
জার্মানী লতার প্রধান ব্যবহার আচ্ছাদন ফসল হিসেবে ভূমিক্ষয় রোধ করার জন্য। এ ছাড়া এর পাতা কোনো কোনো দেশে স্যুপ রান্নায় সবজি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গোখাদ্য হিসেবেও এর পাতা চমৎকার। ভেষজ গাছ হিসেবে বিভন্ন দেশে এর লোকজ ব্যবহার রয়েছে। যেমন দক্ষিণ নাইজেরিয়ায় এ গাছের পাতার ক্বাথ কফ ও চোখের ক্ষত সারাতে ব্যবহৃত হয়। পূর্ব আফ্রিকায় সর্প দংশন ও বিছার কামড়ের চিকিৎসায় এ গাছ ব্যবহার করা হয়। মালয়েশিয়ায় বনে কাজ করার সময় গা চুলকানো থেকে বাঁচার জন্য এর পাতার রস গায়ে মাখা হয়।

ভেষজ গুণ
আমেরিকা ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই এসব গাছের ভেষজ গুরুত্ব ও ব্যবহার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতে এসব গাছ বহু লোক লোক চিকিৎসায় ব্যবহার করে উপকার পান, বিশেষ করে কাটা ক্ষত, রক্তপড়া বন্ধ ও গ্যাস্ট্রিক আলসারের চিকিৎসায়। ভারতের অরুণাচল রাজ্যের পল্লী অঞ্চলের অনেকে এ গাছ ডায়রিয়া সারাতে ও কাটা জায়গা থেকে রক্তপড়া বন্ধ করতে ব্যবহার করেন। মাদাগাস্কারে এ গাছের পাতা থেকে এক ধরনের ঠাণ্ডা চা তৈরি করে তা গায়ে মাখেন দাদ, চুলকানি ও খোসপাঁচড়া সারাতে.। ভারতে গ্রামের অনেকে এ গাছের কচি পাতা ব্যবহার করেন বিভিন্ন পোকার কামড়ের বিষাক্ত জ্বালা থেকে মুক্তি পাওয়া ও ডায়াবেটিস রোধের জন্য। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে এ গাছ যকৃতের সুরক্ষা দিতে পারে । বহু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এ গাছের ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া বিনাশী গুণ আছে। জার্মানী লতার গাছ থেকে এক ধরনের চা তৈরি করে খেলে তা পাকস্থলীর প্রদাহ দূর করে। ম্যালেরিয়া জ্বর সারানোর জন্য এর পাতা অন্য আরও কিছু গাছের পাতার সাথে সিদ্ধ করে টনিক তৈরি করে খাওয়া হয়। একজিমা সারাতে এর পাতা ব্যবহার করা হয়। এর কাণ্ড বা লতা আদার সাথে ছেঁচে রস করে বা সবজির সাথে খেলে পাকস্থলীর প্রদাহ, মাথাব্যথা ও ঠাণ্ডা লাগা চলে যায়। এর পাতার রক্ত জমাট বাধার ক্ষমতা আছে। সেজন্য কোথাও কেটে গেলে রক্তপড়া বন্ধ করতে এর পাতার রস লাগানো হয়। সর্পদংশন ও সিফিলিস রোগের চিকিৎসায় এ গাছ ব্যবহার করা হয়। ঘা ও চুলকানি সারাতেও পাতার রস কাজ করে। বসন্ত ও হামে এর পাতার রস পানিতে মিশিয়ে গা ধুইয়ে দিলে উপকার হয়। রোগ চিকিৎসায় এ গাছের পাতা ও পাতার রস ব্যবহার করা হয়। নিচে জার্মানী লতা বা আসাম লতার ভেষজ গুণ ও ব্যবহার সম্পর্কে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো-

কাটা স্থানের রক্তপড়া বন্ধ করে
হঠাৎ কোথাও কেটে গেলে বা ছিঁড়ে গেলে সেখান থেকে রক্ত পড়তে থাকে। দ্রুত সে রক্তপড়া বন্ধ করতে জার্মানী লতার পাতা ছিঁড়ে বেটে বা ছেঁচে সেখানে মলমের মতো লাগিয়ে দিলে রক্তপড়া আশ্চর্যজনকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

ক্ষুধামান্দ্য দূর করে
অরুচি বা ক্ষুধামান্দ্য হলে এর পাতা পানিতে জ্বাল দিয়ে ছেঁকে চায়ের মতো খেলে এই অসুবিধেটা চলে যায়, ক্ষুধার উদ্রেক করে।

বমি বন্ধ করে
এ গাছের তিনটি হলদে বা বুড়ো পাতা পানিতে জ্বাল দিয়ে চায়ের মতো বানিয়ে তাতে চিনি মিশিয়ে খেলে বমি করা বন্ধ হয়।

চুলকানি ও হাম উপশম করে
চুলকানি ও হামে ত্বক থাকা থাকা হলে এ গাছ থেতলে বা ছেঁচে পানিতে মিশিয়ে সেই পানি দিয়ে গোসল করলে উপকার হয়।

আমাশয় সারায়
রোজ তিনবার পাতার রস খেলে আমাশয় সেরে যায়। আমাশয় সারা না পর্যন্ত ওটা খেয়ে যেতে হবে। পেটের অন্য কোনো সমস্যা থাকলে তাতেও এটা কাজ করে।

গ্যাস্ট্রিক আলসারের উপশম করে
পাতার রস করে খেলে তা গ্যাস্ট্রিক আলসারেরও উপশম করে।

বংশবৃদ্ধি
প্রধানত বীজ দ্বারা এ গাছের বংশবৃদ্ধি ঘটে। বাতাস, পশুপাখির পশম ও পালক, বৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে বীজ স্থানান্তরিত হয়। রোদেলা জায়গায় বীজের অংকুরোদগম ভালো হয়। বীজ ছাড়া এর কাণ্ডের বা লতার অংশ কেটে কোথাও পড়লে সেখানেও গাছ জন্মাতে পার্।ে অনেক সময় প্রবল ঝড়-বাতাসেও এর লতা ছিঁড়ে যায় ও ছেঁড়া টুকরো বৃষ্টির পানিতে ভেসে দূরবর্তী স্থানে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে মাটিতে ঠাঁই পেলে তা থেকে শিকড় গজিয়ে নতুন গাছের জন্ম হয়।

চাষাবাদ
রোদযুক্ত স্থানে গাছ ভালো জন্মে। তবে আংশিক ছায়াতেও এ গাছ জন্মে। প্রচুর জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উর্বর মাটি ও আর্দ্র পরিবেশ জার্মানী লতার বৃদ্ধির জন্য উত্তম। এ গাছ চাষের কোনো দরকার হয় না। বরং একবার কোথাও জন্মালে তা ধ্বংস করাই কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য এ গাছকে বিশ্বের অন্যতম একটি খারাপ আগাছা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব স্থানে লোকের চলাচল কম, পরিত্যক্ত জায়গা সেসব স্থানে ইচ্ছে মতো গাছ বাড়তে থাকে ও অবলম্বন করা গাছ বা স্থানকে দ্রুত ঢেকে ফেলে। চা, কফি, রাবার, নারিকেল, পাম অয়েল, কাজুবাদাম, কলা, আখ ইত্যাদি বাগানে এ গাছ বেশি জন্মে থাকে। অবশ্যই এসব স্থানে এ গাছ আগাছা হিসেবে ক্ষতি করে। এ গাছ ঐসব গাছের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। গাছ খুব দ্রুত বাড়ে, ২৪ ঘণ্টায় তরুণ গাছ প্রায় ৮০ মিলিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।

This post has already been read 10717 times!

Check Also

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার আক্রমণ: ফলনের ক্ষতি ও করণীয়

ড. মো. মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে ধান প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিত এবং এর উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির …