মো. খোরশেদ আলম জুয়েল : শত্রু মূলত দুই ধরনের। এক. প্রকাশ্য শত্রু এবং দুই. অপ্রকাশ্য শত্রু। প্রকাশ্য শত্রুকে চেনা গেলেও অপ্রকাশ্য শত্রুকে চেনা বড় কঠিন। মানুষের মতো জীব জন্তু, পশু-পাখি, গাছ-গাছালিরও এমন শত্রু রয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বিকাশমান শিল্প পোলট্রিতেও এমন শত্রু রয়েছে যে কীনা নীরবে ক্ষতি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আসুন জেনে নেই শত্রুটি কে?
শত্রুটির নাম H9N2 ভাইরাস যা এক প্রকার এভিয়ান ফ্লু। ভাইরাসটি লো প্যাথোজেনিক টাইপের হলেও এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঠাণ্ডা মাথায় (নীরবে) ক্ষতি করে যাচ্ছে দেশের পোলট্রি শিল্পকে। ভাইরাসটি আক্রমণের H5N1ফ্লু’র মতো হঠাৎ করে একসাথে সব মুরগি মারা না গেলেও ডিমের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ফলে ডিমের উৎপাদন খরচ যেমন বেড়ে যায় তেমনি বেড়ে যায় একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ। ফলে খামারিদের লোকসান হয় নিশ্চিতভাবে। অনেক আগে থেকেই ভাইরাসটি নীরবে ক্ষতি করে আসলেও গুরুত্ব দেয়া হয়নি তেমন একটা। ফলে আশকারা পেয়ে বেড়ে চলেছে এটির তাণ্ডবের মাত্রা। পোলট্রিতে এতদিন এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের হাই-প্যাথজোনিক (H5N1) ভাইরাস চিন্তার কারণ হলেও লো-প্যাথজোনিক (H9N2) ভাইরাস বর্তমানে পোলট্রি শিল্পে নতুন হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
H9N2 ভাইরাস কি?
এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এর ৩টি ধরণ বা প্রকৃতি (টাইপ) আছে। এগুলো হচ্ছে, ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পোল্ট্রিতে যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে আছে সেটি ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত। ‘বি’ এবং ‘সি’ শ্রেণীটি কেবলই মানুষে পাওয়া যায়। এ ভাইরাসের দুটো গুরুত্বপূর্ণ এন্টিজেন হচ্ছে হেমাগ্লুটিনিন (Haemagglutinin) এবং নিউরামিনিডেজ (Neuraminidase)। শব্দের আদি অক্ষর ‘H’ এবং ‘N’ দিয়ে এ দুটো এন্টিজেন পরিচিত। H এন্টিজেন পোষক কোষের সংগে ভাইরাসটিকে সংযুক্ত করে। অপরদিকে N এন্টিজেন আক্রান্ত পোষক কোষ থেকে ভাইরাসটিকে অবমুক্ত করে। H এন্টিজেনের প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে এটিকে ১৬টি সাব-টাইপে ভাগ করা হয়েছে। যেমন H1 ………….H16। আবার এন এন্টিজেনের উপর ভিত্তি করে একে ৯টি সাব-টাইপে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন N1 ………..N9।
ক্ষমতার মাপকাঠিতে H9N2 ভাইরাসটিকে Low pathogenic (LPAI) গোত্রে রাখা হয়েছে। LPAI এর ক্ষেত্রে রোগের মারাত্মকতা তেমন প্রকাশ পাওয়া না গেলেও কখনোই কম গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যায় না। কারণ বিবর্তনের (mutution) ধারায় এটাই হাই প্যাথেজোনিক (HPAI) হয়ে আর্বির্ভূত হয়ে থাকে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত রয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশেই।
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
ন্যাশনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরি ফর এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা’র পরিচালক ডা. মো. গিয়াস উদ্দিন –এর গবেষণাপত্র থেকে জানা, বাংলাদেশে ভাইরাসটি মূলত ২০০৭ সনের ১৫ মার্চ সনাক্ত হয়। এশিয়া মহাদেশের ভাইরাসটি প্রথম সনাক্ত হয় ১৯৮৫ সনে হংকং –এর গৃহপালিত হাঁসে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬৬ সনে। ভাইরাসটি বাংলাদেশ ২০০৯ সন পর্যন্ত এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা সাবটাইপ হিসেবে উদীয়মান ছিল। দুর্বল জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, অপরিচ্ছন্ন কাঁচাবাজার এবং অনিয়ন্ত্রিত এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার ভাইরাসটিকে বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে বলে জানা যায়।
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব ভেটেরিনারি সায়েন্সের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে বার্ড-ফ্লু সংক্রমণের আরও আগে থেকেই উক্ত লো-প্যাথজনিক ভাইরাসের উপস্থিতি ছিল বলে ধারনা করছি।
অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম –এর করা ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা এবং টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর এলাকায় করা গবেষণায় দেখা যায়, এ জীবাণুর কারণে মোট প্রায় ১৬২টি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।
ক্ষয়ক্ষতি কেমন হচ্ছে?
কয়েক মাস আগেও খামারিদের লোকসান ডিমের টানা দরপতনে যেমন হয়েছে, H9N2 ভাইরাসের আক্রমণেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ, এমনিতেই ডিমের ন্যায্য মূল্য পাওয়া যাচিছলো না, তেমনি ভাইরাসটি আক্রমণের ফলে অনেক খামারির ডিমের উৎপাদন খরচ আরো বেড়ে যায়। ফলে দুদিক দিয়েই লোকসানে ছিলেন অনেকদিন।
ন্যাশনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরি ফর এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা’র পরিচালক ডা. মো. গিয়াস উদ্দিন –এর গবেষণাপত্রে দেখা যায়, ২০১১ থেকে অদ্যবধি ব্রিডার ও কমার্শিয়াল লেয়ার, সোনালি এবং ব্রয়লারে H9N2 ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে। হেনস-হাউসড (এইচ.এইচ) প্রোডাকশন ১২৯ থেকে ৯২টিতে নেমে এসেছে। একদিন বয়সী বাচ্চার উৎপাদন কমে গেছে প্রায় ২৯ শতাংশ এবং এর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত। ৩২ টাকার স্থলে একদিন বয়সী ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ দাড়িয়েছে প্রায় ৪২ টাকা। দেশের বাণিজ্যিক লেয়ার শিল্পে বছরে ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে।
অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম –এর গবেষণাপত্রে দেখা যায়, H9N2 আক্রমণে লেয়ার মুরগির ডিম উৎপাদন কমে গেছে প্রায় ১০-৫৫ শতাংশ। তারমানে, ডিমের উৎপাদন খরচ সেসব ফার্মে ১০-৫৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এছাড়াও রোগটিতে মৃত্যুর হার ০.৬-৫.৯% এবং ক্লিনিকাল প্রাদুর্ভাব সময়কাল ৯-৩০ দিন বলে উক্ত গবেষণাপত্রে পাওয়া যায়।
তাহলে উপায়?
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের প্রফেসর ড. প্রিয় মোহন দাস বলেন- এ ভাইরাসের কারণে দেশের পোলট্রি শিল্পের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আমরা মাঠ পর্যায়ে অনেক জায়গায় এর অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। প্রাথমিকভাবে এটিকে নির্মুলের জন্য ভ্যাকসিনের বিকল্প নেই, সেই সাথে খামারের জৈব নিরাত্তা বিষয়টিও কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। তাই সরকারের উচিত, যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি দেয়া।
ডা. মো. গিয়াস উদ্দিন এবং অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম এর গবেষণাপত্রেও আপদকালীন সমস্যা মোকাবেলায় ভ্যাকসিন ব্যবহারের পাশাপাশি এবং খামারের জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্যকর কাঁচাবাজার, উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকেও ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে সরকারের কাছে।
ইতিকথা
মানুষের মতো প্রতিটা প্রাণির ক্ষেত্রেই রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তবে, রোগ হলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ চিকিৎসা দরকার। তবে রোগের ওষুধই যদি সরবরাহ না থাকে তবে নিরাময় সম্ভব নয়। পোলট্রিতে H9N2 ভাইরাসের সংক্রমণ এবং সেটির নিরাময় বিষয়টিও অনেকটা সে রকম। H9N2 ভাইরাসের ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি এখনো মেলেনি। কিছুদিন আগে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব আশ্বাস দিয়েছেন ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতির ব্যাপারে। তবে একইসঙ্গে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে লোকাল স্ট্রেইন দিয়ে ভ্যাকসিন নিজেরাই তৈরির তাগিদও দিয়েছেন তিনি। যদিও বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ চোরাই পথে ভ্যাকসিন আমদানি করে ব্যবহার করছে বলে খবর পাওয়া যায়। যদি তা সত্যিই হয়ে থাকে তবে, সেক্টরের জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দেশের প্রায় ৭০ ভাগ খামারের সঠিক জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনুপস্থিত। অথচ পোলট্রি ফার্মের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি। দেশের কাঁচাবাজারগুলো ৯৫ শতাংশ মুরগি বিক্রি করা হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। শিল্পের বিস্তার ঘটলেও সঠিক জীব নিরাপত্তা অনুশীলন না করা, অব্যবস্থাপনা, কারিগরি জ্ঞানের অভাব ইত্যাদি কারণে নিত্যনতুন ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটছে। সুতরাং সেখান থেকে রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থেকে যায়। প্রান্তিক খামারিদের জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
বিগত এক দশকে বাংলাদেশের পোলট্রি শিল্প ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু সময় সময় বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে শিল্পটিকে হোচট খেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। আশা করি, উদ্ভূত সমস্যাও কেটে যাবে অতি শীঘ্রই। এজন্য দরকার দায়িত্বশীলদের দ্রুত পদক্ষেপ।