ড. মোহাম্মদ মাইনউদ্দিন মোল্লা১, ড. মো. মিয়ারুদ্দিন২, ড. মো. আইয়ুব হোসেন৩ এবং ড. তপন কুমার পাল৪ : স্টার্চ একটি কার্বোহাইড্রেট যা আমাদের দৈনন্দিন প্রতিটি খাবারে কম বেশি বিদ্যমান। আমাদের ডায়েটের মধ্যে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। স্টার্চের অণুগুলো গ্লাইকোসাইডিক বন্ধনের মাধ্যমে একটি বৃহাদাকার গ্লুকোজ একক গঠন করে। ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্লাণ্টে স্টার্চ গঠিত হয় এবং শাীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার (ফিজিওলিজিক্যাল ফাংশন) মাধ্যমে এরা (প্লান্ট) উৎপাদিত স্টার্চকে গ্লুকোজ হিসেবে সংরক্ষণ রাখে এবং পরবর্তীতে প্লাণ্ট তাদের বৃদ্ধি ও পুনরুৎপাদনে ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশ বর্তমানে আলু, কাসাভা ও ভুট্টা থেকে স্টার্চ আহরণ শুরু করেছে, যদিও এদেশে ভুট্টা থেকে স্টার্চ আহরণ বাণিজ্যিকভাবে তেমন প্রসার ঘটেনি। বাংলাদেশে বর্তমানে আলুর উৎপাদন বেড়ে চলছে। যেখানে ২০১৫-১৬ সালে এর উৎপাদন ছিল ৯৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৯ মেট্টিক টন সেখানে ২০১6-১7 সনে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে ১ কোটি ২১ লাখ ৫ হাজার ৯ শ’ ৫৭ মেট্টিক টন হয়েছে যা বিগত বছরের তূলনায় 7.90% বৃদ্ধি পেয়েছে (কৃষি পরিসংখ্যান, ২০১৮)। তাছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর নিরলস প্রচেষ্টাতে শুধু আলুরই ৭৯টি জাত অবমুক্ত হয়েছে যার সবগুলো জাতই Agro-ecological zone অনুযায়ী দেশের কোন না কোন অঞ্চলে চাষাবাদ হচ্ছে। ফলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে ৩০ লক্ষাধিক মেট্রিক টন আলুর উৎপাদন অধিক রয়েছে।
সবজি হিসেবেই মূলত আলুর প্রধান ব্যবহার। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই সবজি হিসেবে -এর ব্যবহার রয়েছে। সবজি হিসেবে এর ব্যবহার ছাড়াও উৎপাদনের অতিরিক্ত আলু স্টার্চ আহরণে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশ প্রতি বছরই বিদেশ হতে স্টার্চ আমদানি করে থাকে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ৬-১০ কোটির অধিক টাকার স্টার্চ আমদানি করে থাকে (জাতিসংঘের পণ্যদ্রব্য বাণিজ্যিক পরিসংখ্যান, ২০০৮)। কাজেই দেশের উৎপাদিত আলু থেকে স্টার্চ আহরণ করা গেলে বিদেশ থেকে স্টার্চ আমদানি যেমন হ্রাস পাবে তেমনি দেশীয় চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি আলুর ব্যবহারও বৃদ্ধি পাবে। ফলে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হবে এবং আলু চাষে তাদের উৎসাহও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে স্টার্চ আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানসমুহ
বাংলাদেশে ফ্ল্যামিনগো এগ্রো টেক কোম্পানি লি., জয়পুরহাট; রহমান ক্যামিক্যালস লি., নারায়গ্ঞ্জ ও হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, প্রাণ গ্রুপ, হবিগঞ্জ স্টার্চ উৎপাদন করলেও বর্তমানে ফ্ল্যামিনগো এগ্রো টেক কোম্পানি লি. উৎপাদন বন্ধ করে পোল্যান্ড থেকে সরাসরি স্টার্চ আমদানি করছে। প্রাণ কোম্পানি আলু ও কাসাভা থেকে স্টার্চ আহরণ অব্যাহত রেখেছে। কোম্পানিটি (প্রাণ) বৃহত্তর রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চলে Contact growers এর মাধ্যমে লেডি রোসেটা (বারি আলু-২৮), কারেজ (বারি আলু-২৯) এবং গ্রানোলার (বারি আলু-১৩) জাতের আলু উৎপাদন করে থাকে। উৎপাদিত আলু সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে সংগ্রহ করে থাকে। আলুর মৌসুমে নতুন আলু উঠায় Cold storage এর অবশিষ্ট পুরাতন আলু অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে (2.০০-3.০০ টাকা) সংগ্রহ করে থাকে। সংগৃহীত আলু ৩-৪০ সে. তাপমাত্রায় এবং ৯০-৯৫% আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করে থাকে (স্টার্চ আহরণের পূর্ব পর্যন্ত)। অন্যান্য মৌসুমে আলুর দাম বেশি থাকে বিধায় কেবল উৎপাদন মৌসুমেই Cold storage এর অবশিষ্ট পুরাতন আলু হতে স্টার্চ আহরণ করে থাকে যেখানে Recovery starch এর পরিমাণ ১২%। আলু হতে স্টার্চ আহরণে কেজি প্রতি ৮০-৮৫ টাকা খরচ পড়ে যেখানে প্রতি কেজি স্টার্চ ১১০-১২০ টাকায় বিক্রয় করা হয়।
বাংলাদেশে কাসাভার কোন মূক্তায়িত জাত না থাকায় কোম্পানিটি বিদেশী জাত (আফ্রিকান এবং ভিয়েতনামী) Contact growers এর মাধ্যমে হবিগঞ্জ, সিলেট, টাংগাইল (মধুপুর) এবং খাগড়াছড়ি পাবর্ত্য জেলায় (রামগড়) এটি উৎপাদন করে থাকে। কোম্পানিটি সাধারণত অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাসে উৎপাদিত কাসাভা ৭-৮ টাকা মুল্যে কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করে থাকে। সংগৃহীত কাসাভার সংরক্ষণকাল খুবই কম (১-২ দিন) হওয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে Crushing ও স্টার্চ আহরণে ব্যবহার করা হয়। Crushing হতে শুরু করে স্টার্চ আহরণ ও প্যাকেজিং পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি Software নিয়ন্ত্রিত Automatic machine এর সাহায্যে সম্পন্ন করা হয়। কাসাভা হতে Recovery starch এর পরিমাণ ২৬-২৮%। এটি (কাসাভা) হতে স্টার্চ আহরণে কেজি প্রতি ৩৬-৩৮ টাকা খরচ পড়ে যেখানে প্রতি কেজি স্টার্চ ৫৫-৬০ টাকায় এবং কখনো কখনো তা ৬৮-৭২ টাকায়ও বিক্রয় করা হয়। কাসাভা থেকে আহরিত স্টার্চ Sticï হওয়ায় মূলত টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহারকারীরা এটি ক্রয় করে থাকে। স্টার্চের সাথে Protein, Fat এবং Sugar এর মিশ্রণ বেশি থাকলে রং লালচে হয়ে যায় বিধায় ধবধবে সাদা স্টার্চ আহরণের জন্য Disc separator এর সাহায্যে স্টার্চ হতে Protein, Fat এবং Sugar এর মিশ্রণ পৃথক করা হয়।
স্টার্চের ব্যবহার
বেকারী পণ্য (নুডলস, বিস্কুট, ক্যান্ডি, চিপস, পটেটো ক্রেকারস) এবং তরল গ্লুকোজ তৈরিতে স্টার্চ ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া টেক্সটাইল শিল্পে (বস্ত্র ফিনিশিং), ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে (ক্যাপসুলের কোটিংয়ে, সিরাপ তৈরিতে এবং এন্টিবায়োটিক তৈরিতে), পেপার শিল্পে (পেপারের মসৃনতায়), রাসায়নিক শিল্পে (গ্লু তৈরিতে) এবং লন্ড্রিতে কাপড় ধোলাইয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়।
স্টার্চ আহরণের পর পাল্পের (উচ্ছিস্টাংশের) ব্যবহার
স্টার্চ আহরণের পর উচ্ছিস্টাংশ পাল্প জৈব কম্পোস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। উৎপাদিত কম্পোস্ট কৃষিতে ব্যবহৃত হয়।
যে সব দেশ হতে স্টার্চ আমদানি করা হয়
বর্তমানে স্টার্চ আহরণকারী প্রতিষ্ঠানসমুহ নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদেই নিজস্ব দক্ষ লোকবল ও আধুনিক প্রযুক্তি (Software নিয়ন্ত্রিত Automatic machine) ব্যবহার করে স্টার্চ উৎপাদনে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ কোম্পানি আহরিত স্টার্চ নিজস্ব বেকারী পণ্য (নুডলস, বিস্কুট, ক্যান্ডি, চিপস, পটেটো ক্রেকারস) এবং তরল গ্লুকোজ তৈরিতে স্টার্চ ব্যবহার করে থাকে। রপ্তানি করতে না পারলেও নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে দেশের অভ্যন্তরে টেক্সটাইল শিল্পে এবং এসিআই কোম্পানিসহ অন্যান্য কোম্পানির নিকট বিক্রয় করে থাকে। আবার কখনো কখনো আহরিত স্টার্চ নিজেদের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হলে ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করে থাকে।
স্টার্চ আহরণে সমস্যা
কোম্পানিগুলো সাধারণত লেডি লোসেটা (বারি আলু-২৮), কারেজ (বারি আলু-২৯) এবং গ্রানুলার (বারি আলু-১৩) জাতসমুহ হতে স্টার্চ আহরণ করে থাকে যাতে Recovery starch এর পরিমাণ পাওয়া যায় ১০-১২%। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর নিরলস প্রচেষ্টাতে এ পর্যন্ত আলুরই ৭৯টি জাত অবমুক্ত হয়েছে যার সবগুলো জাতের Recovery starch এর পরিমাণ এখনো অজ্ঞাত। তাছাড়া স্টার্চ আহরণ খরচ কমাতে কোম্পানিগুলো আলু উত্তোলনের মৌসুমে নতুন আলু সংগ্রহের পরিবর্তে পুরাতন আলু সংগ্রহ ও স্টার্চ আহরণে ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত আলুর স্টার্চ রুপান্তরিত হয়ে Sugar, Protein এবং Fat এ পরিণত হয়। ফলে Recovery starch এর পরিমান কমে যায়। তাছাড়া স্টার্চের রং ধবধবে সাদার পরিবর্তে লালচে রংও ধারন করে যা Real chips সহ অন্যান্য বেকারী পণ্য উৎপাদনেও বিঘ্ন ঘটায়। আর কাসাভার বেলায় যদিও এতে Recovery starch এর পরিমান বেশী (২৬-২৮%) কিন্তু এর জীবনকাল অধিক হওয়ায় মাঠ হতে সংগ্রহ করতে দীর্ঘ সময় (৭-১০ মাস) লেগে যায় ।
স্টার্চ আহরণে উজ্জ্বল সম্ভাবনা ও করণীয়
হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, প্রাণ গ্রুপ ছাড়াও হবিগঞ্জে ভুট্টা এবং নারায়ণগঞ্জে আলু হতে স্টার্চ আহরণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কারখানা গড়ে উঠেছে। আলু হতে স্টার্চ আহরণের পাশাপাশি কাসাভা হতে স্টার্চ আহরণে কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বেড়েছে। এর কারণ হিসাবে বলা যায়, বর্তমানে কাসাভাতে Recovery starch এর পরিমাণ আলুর তুলনায় ১২-১৪% বেশি এবং এর উৎপাদন খরচও কম। তাছাড়া পাহাড় অঞ্চলে যে সমস্ত অনাবাদী জমি আছে সে সমস্ত জমিতে অল্প খরচে এটি চাষ করা যায়।
যেহেতু খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে গুণগত মানের দিক দিয়ে আলুর স্টার্চ কাসাভার স্টার্চের চেয়ে অধিক উত্তম কাজেই আলু হতে স্টার্চ আহরণে অধিক মনোযোগ দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত জাতগুলোর Recovery starch এর পরিমাণ (%) ও Dry matter (%) নির্নয় করা যেতে পারে। Recovery starch এর পরিমাণ (%) সন্তোষজনক (২০%-এর বেশি) না হলে-
১. ২০% এর বেশি Recovery starch পাওয়া যায় এ রকম Dry matter সমৃদ্ধ আলুর জাত উদ্ভাবন করা যেতে পারে।
২. মাঠ হতে আলু সংগ্রহের সঠিক সময় (Proper harvesting time) নির্নয় করা যেতে পারে যা অধিক স্টার্চ আহরণে ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. Storage করার কতদিনের মধ্যে আলু হতে স্টার্চ আহরণ করলে অধিক স্টার্চ আহরন করা যাবে তার জন্য Storage periods এবং Recovery starch এর সম্পর্কের উপর গবেষণা নেয়া যেতে পারে।
৪. কোম্পানি কর্তৃক নির্বাচিত Contact growers দের আলুর উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, রোগ বালাই (Especially black hurt disease) ও তাদের দমন ব্যবস্থাপনা, সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৫. স্বল্প সময়ে অর্থাৎ বছরে দুই (২) বার চাষ করা যায় এমন কাসাভার জাত উদ্ভাবন করা যেতে পারে।
৬. ভারতীয় কাসাভা জাত জয়া ও হারশা এদেশে স্বল্প সময়ে (৬ মাসের মধ্যে) চাষাবাদের উপযোগী করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
স্টার্চ আহরণ শিল্পের প্রসারের মাধ্যমেই এদেশে উৎপাদিত অতিরিক্ত আলু ব্যবহারের আওতায় আনা সম্ভব। দেশের স্টার্চ আহরণকারী কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমকে আরো জোরদারকরণের মাধ্যমে এর বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে স্টার্চ আহরণ বিষয়ে গবেষণা সংক্রান্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সাথে কাজের সম্পর্ক তৈরী হলে এ শিল্পের আরো দ্রুত প্রসার ঘটতে পারে। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক টাইগার হিসাবে খ্যাত চীনও তাদের দেশে গড়ে উঠা কোম্পানিগুলো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই অগ্রসর হচ্ছে।
লেখক: ১. ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ২. মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ৩. মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এফএমপিই বিভাগ, ৪. পরিচালক, কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০১