ঢাকা: বিগত প্রায় ২১ মাস যাবৎ লাগাতারভাবে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দামের নিম্নগতি, ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দর পতনে খামারিদের দূর্গতি এবং পোল্ট্রি শিল্পে বিরাজমান অচলবস্থার অবসান ঘটাতে করণীয় বিষয়ে আলোচনার লক্ষ্যে রবিবার (২৩ ডিসেম্বর) তারিখ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিরেশ রঞ্জন ভৌমিক। উক্ত বৈঠকে দেশীয় খামারিদের সুরক্ষা এবং ডিমান্ড ও সাপ্লাইচেইনে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিরেশ রঞ্জন ভৌমিক।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, পোল্ট্রি শিল্প দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। সে কারণে সরকার এ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করছে। লোকবলের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পোল্ট্রিসহ সার্বিকভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে পোল্ট্রিখাত সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো এগিয়ে এলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিদ্যমান সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিনি আরো বলেন, ডিম ও মুরগির মাংসের নায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে প্রকৃত চাহিদা নিরূপন করতে হবে। ডিমান্ডের চেয়ে সাপ্লাই বেশি হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে খামারিদের লোকসানে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) একদিন বয়সী বাচ্চার প্রকৃত চাহিদা কত সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে এবং প্রাণিসম্পদ অফিসে জমা দিবে। উক্ত প্রতিবেদন এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিজস্ব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে একটি যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে যেখানে প্রয়োজনীয় করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রকিবুর রহমান টুটুল বলেন, মুরগির মাংস ও ডিমের কনজাম্পশন যতটা বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল বাস্তবে তেমনটি হয়নি। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ব্রিডার্স ও হ্যাচারিগুলো তাদের উৎপাদন বাড়িয়েছিলো। কিন্তু চাহিদা না বাড়ায় ব্রিডার ফার্ম বা হ্যাচারিগুলোই শুধু নয় বরং সামগ্রিকভাবে পোল্ট্রি শিল্প লোকসানের মুখে পড়েছে। অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। অসংখ্য শিক্ষিত বেকার যুবক যারা পোল্ট্রি শিল্পকে কর্মসংস্থানের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলো তারা আবারও বেকার হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থার উত্তোরনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহযোগিতা চান জনাব টুটুল।
গ্রান্ডপ্যারেন্ট স্টক (জিপি) ফার্ম থেকে কোনো অনিবন্ধিত হ্যাচারি বা পিএস ফার্ম যেনো বাচ্চা সংগ্রহ করতে না পারে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনার দাবি জানান তিনি। দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পকে, বিশেষ করে ব্রিডার্স ইন্ডাষ্ট্রিকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে যে কোনো ধরনের সরকারি উদ্যোগকে বিএবি স্বাগত জানাবে বলেও জানান ব্রিডার্স সভাপতি।
বি.এ.বি’র সাধারণ সম্পাদক আসিফুর রহমান বলেন, কিছু নেতিবাচক প্রচারণার কারণে ব্রয়লার মুরগির মাংস সম্পর্কে ভোক্তাদের মাঝে বিভ্রান্তি বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েক বছর আগের তথ্যগুলোও রহস্যজনকভাবে ঘুরে ফিরে আসছে। এ প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সিনিয়র কর্মকর্তাগণ জানান, পোল্ট্রি ফিডে ট্যানারির বর্জ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের জনৈক শিক্ষক যে গবেষণাটি পরিচালনা করেছিলেন সে সম্পর্কে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিলো। তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর গবেষণায় যে ধরনের ফিডের নমুনা ব্যবহার করা হয়েছিলো সেগুলো প্রতিষ্ঠিত কোনো কর্মাশিয়াল ফিড মিল থেকে সংগ্রহ করা হয়নি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এ ধরনের ভিত্তিহীন প্রচারণার ফলে ভোক্তার মাঝে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং বিএবি যৌথভাবে কাজ করবে।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার বলেন, ডিম ও ব্রয়লার মুরগির নায্য দাম না পাওয়ার কারণে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে পোল্ট্রি শিল্প। দাম বাড়লে পোল্ট্রি খামারি ও উদ্যোক্তাদের উপর নানামুখী চাপ তৈরি হয় কিন্তু দাম কমে গেলে কেউই আর খোঁজ রাখেন না। বিগত প্রায় ২১ মাস যাবৎ উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে একদিন বয়সী বাচ্চা। এত দীর্ঘ সময় একটানা দরপতনের ঘটনা এর আগে কখনও হয়নি। শাহরিয়ার বলেন, দেশে কী পরিমাণ জিপি ও পিএস আমদানি হচ্ছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে নেই।
তিনি আরো বলেন, শোনা যাচ্ছে অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও একশ্রেণীর ব্যবসায়ী অবৈধ প্রক্রিয়ায় চীন ও ভারত থেকে ব্রিড আমদানি করছে। একথা যদি সত্য হয় তবে তা পোল্ট্রি শিল্পের জন্য একটি অশনিসংকেত। পোল্ট্রি উন্নয়ন নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ এবং অবৈধ আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেন তিনি। প্রাণিসম্পদে নিবন্ধিত খামারগুলোর অধিকাংশই ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনে এখনও নিবন্ধিত হয়নি। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছেনা। ছোট-বড় সব ধরনের ব্রিডার ফার্ম ও হ্যাচারিগুলোর জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে নিবন্ধনের পাশাপাশি ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনেও নিবন্ধিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত বলে মনে করে সাবেক সভাপতি।
বৈঠকে জানানো হয়, লো-প্যাথজেনিক ভাইরাসের প্রতিষেধক ভ্যাকসিন অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে সরকার। অবৈধ ফিড প্রস্তুতকারকদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। তাছাড়া ফিড মিলগুলো চাহিদার অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানি করছে কিনা সেটিও সরেজমিনে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ব্রিডার্স নেতৃবৃন্দকে জানানো হয়, নীতিমালা বহির্ভূত কোনো দেশ থেকে ব্রিড আমদানির সুযোগ নেই। এমনটি হলে ব্যবস্থা নেবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।