ডা. সাইফুল ইসলাম সোহেল: দেশে চলছে নির্বাচনি আমেজ। এই নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ তাদের নেতা নির্বাচন করবে। যারা পরবর্তী সময়ে এই মানুষের নেতৃত্ব দিবে। যাদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হবে দেশ। ধারণা করা হয়, এই নেতৃত্ব ও আধিপত্যের গুণ মানুষের মাঝে স্বাভাবিকভাবেই জন্ম নেয়। তবে মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণী প্রজাতিরা নেতা নির্বাচন করে কী?
অধিকাংশ গবেষকরা প্রমাণ করেছেন প্রাণীরা সাধারণত চারটি শাসনক্ষেত্রের ভেতর তাদের নেতা নির্বাচন করে। এগুলো হচ্ছে- আন্দোলন, খাদ্য অধিগ্রহণ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মিমাংসা, গ্রুপের ভেতর মিথস্ক্রিয়া বা মারামারি। অনেক গবেষকের মতে, মানুষ ও কিছু কিছু প্রাণীদের নেতা নির্বাচনের মাঝে অনেক মিল রয়েছে।
নেতা নির্বাচন ও বসবাসের জন্য সিংহ ও মানুষের মাঝে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সাধারণত বাচ্চা উৎপাদনের জন্য পুরুষ ও স্ত্রী উভয় সিংহই সমভাবে কাজ করে। বাচ্চা পালনের জন্যও উভয়েই সমান শ্রম দেয়। শিকারের ক্ষেত্রেও দলবদ্ধভাবে কাজ করে। শিকার করা খাবারকে ন্যায়সঙ্গতভাবে সবার মাঝে ভাগ করে দেয়।
সব প্রাণিরা কিন্তু একইভাবে নেতা নির্বাচন করে না। শিম্পাঞ্জী ও হায়েনার নেতা নির্বাচন সিংহের পদ্ধতি থেকে অনেক ভিন্ন। এরা সাধারণত দলের মধ্যকার শক্তিশালী প্রাণিটিকেই নেতা হিসেবে নির্বাচন করে। এই নেতার সবচেয়ে বড় যে ক্ষমতা থাকবে তা হচ্ছে দলের অন্যান্য সদস্যদের বিপদে সঠিকভাবে পরিচালিত করার ক্ষমতা ও তাদের সম্পত্তি রক্ষার ক্ষমতা। এখানে সম্পত্তি বলতে আবাসস্থল ও শিকারকৃত খাবার রক্ষার ক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে।
অনেক প্রাণী আবার তাদের মধ্যকার সবচেয়ে বয়স্ক প্রাণিকেই নেতা নির্বাচন করে। এ কাজের জন্য হাতি অন্যতম। এদের দলে যে প্রাণীটির বয়স বেশি, অভিজ্ঞ সেটিকেই নেতা নির্বাচন করে থাকে।
কিছু কিছু প্রাণী, যেমন- স্পটেড হায়েনার নেতা নির্বাচন কৌশল ভাবলে অবাক হতে হয়। অনেক দেশে যেমন মানুষের নেতা নির্বাচিত হয় উত্তরাধিকারসূত্রে। এই হায়েনাদের নেতাও অনুরূপভাবে নির্বাচিত হয়। মানুষের নেতা বংশানুক্রমে নির্বাচিত হলে, তাদের মাঝে ন্যায়-নীতির ঘাটতি হওয়া যেমন অতি স্বাভাবিক, তেমনই স্পটেড হায়েনার ক্ষেত্রেও সম্পত্তির বন্টন ন্যায়সঙ্গত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
প্রাণিদের নেতা নির্বাচনের সময় আমাদের মতো ব্যালট পেপার থাকে না ঠিকই। কিন্তু তারা সমষ্টিগতভাবে একটা সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে থাকে। বসন্তের শেষে কিংবা গ্রীষ্মের শুরুতে মৌমাছিরা তাদের কলোনির আকার অনেক বড় করে থাকে। অতপর রাণী মৌমাছি অর্ধেক কর্মী মৌমাছিকে নিয়ে নতুন স্থানের সন্ধানে বেরিয়ে যায়। এরপর কন্যা রাণী অর্থাৎ বাকি অর্ধেকে যে রাণী থাকে তারাও নতুন জায়গার সন্ধানে বের হয়। তখন বিভিন্ন দিক ছুটতে থাকা মৌমাছি বিভিন্ন রকম স্থানের সন্ধান পায়। অতপর সেগুলোর মাঝে কয়েকটা ছোট ছোট দল তৈরি হয়। তারপর এই দলগুলোর সংগৃহীত তথ্যগুলো একত্রিত করেই বাসা তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
মৌমাছির এই ঘটনাটি আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য Tonkean macaques (ইন্দোনেশিয়ার এক ধরনের ফল পছন্দকারি বানর) এর ফলমূল সংগ্রহের কৌশল আলোচনা করা যাক। ফলমূল সংগ্রহের জন্য এই বানরগুলো দলবদ্ধভাবে চলতে থাকে। এদের মধ্যে একটি বানর যেকোনো একদিকে কিছুদূর যায়। যদি সে মনে করে সেদিকে অধিক ফল পাওয়া যাবে তবে, সে সেখানে দাঁড়িয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনের বানরগুলোর দিকে তাকায়। তখন অধিকাংশ বানরগুলো তার দিকে চলতে থাকে অর্থাৎ ভোট দিয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক বানরটিই নেতা বনে যায়। তবে এই নেতৃত্ব তেমন স্থায়ী হয় না। এক্ষেত্রে কিছু বানর নেতার দিকে নাও যেতে পারে। কিন্তু নেতাসহ বাকি বানরগুলো সংখ্যালঘু বানরগুলোর দিকে আর ফিরে তাকাবে না। এক সময় সংখ্যালঘুরাও নেতার দিকে চলতে থাকবে। অন্যথায় দল থেকে হারিয়ে যেতে পারে।
নেতা নির্বাচন করা ও তাকে মেনে চলার গুণ প্রাণিদের বেলায় অনেক বেশি বিস্ময়করপূর্ণ। এই গুণ হয়তো মানুষেও তেমন পাওয়া যাবে না। আমাদের অতি পরিচিত প্রাণী ভেড়ার নেতাকে অনুসরণ করার গুণ অনেক বিস্ময়করপূর্ণ। যখন নেতা ভেড়া কসাইখানায় প্রবেশ করে বাকিরাও পিছনে পিছনে প্রবেশ করতে থাকে! তাই রাস্তায় ভেড়ার পাল দেখলে গাড়ি চালকদের সাবধান থাকা উচিত। কারণ নেতা রাস্তা অতিক্রম করতে ধরলে বাকিরাও পেছনে পেছনে চলতে থাকবে। মনে রাখবেন, আপনার গাড়ির দিকে তাকানোর সময় ভেড়ার নাই।
সাধারণত বিভিন্ন প্রাণী বিভিন্ন উপায়ে নেতা নির্বাচন করে থাকে। এই নির্বাচনে অধিকতর শক্তিশালী, আকারে বড়, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রাণিটাই হয়তো নেতা হতে পারে। তবে নেতা যেই হোক, তাকে মেনে চলার শিক্ষা মানুষ প্রাণিদের কাছ থেকেই গ্রহণ করতে পারে।
তথ্যসূত্র : ভয়েস অফ আমেরিকা, বিবিসি, শিপ১০১ডট ইনফো, অধিকার ডট নিউজ।