বিজ্ঞানী ড. কে.এম খালেকুজ্জামান :মসলা হিসেবে লবঙ্গ সকলের পরিচিত। এর ইংরেজি নাম Clove এবং এর বোটানিকাল নাম: Syzygium aromaticum । ‘লবঙ্গ’ গাছের ফুলের কুড়িকে শুকিয়ে তৈরি করা হয়। ‘লবঙ্গ’ কে লং বলেও ডাকা হয়। লবঙ্গের সুগন্ধের মূল কারণ “ইউজেনল” (Eugenol) নামের যৌগ। এটি লবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত তেলের মূল উপাদান, এবং এই তেলের প্রায় ৭২-৯০% অংশ জুড়ে ইউজেনল বিদ্যমান। এই যৌগটির জীবাণুনাশক এবং বেদনানাশক গুণ রয়েছে। লবঙ্গের তেলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অ্যাসিটাইল ইউজেনল, বেটা-ক্যারোফাইলিন, ভ্যানিলিন, ক্র্যাটেগলিক অ্যাসিড, ট্যানিন, গ্যালোট্যানিক অ্যাসিড, মিথাইল স্যালিসাইলেট, ফ্ল্যাভানয়েড, ইউজেনিন, র্যাম্নেটিন, ইউজেনটিন, ট্রি-টেরপেনয়েড, ক্লিনোলিক অ্যাসিড, স্টিগ্মাস্টেরল, সেস্কুইটার্পিন। USDA এর রেফারেন্স অনুসারে ১০০ গ্রাম লবঙ্গে ৬৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৬ গ্রাম প্রোটিন, ১৩ গ্রাম টোটাল লিপিড, ২ গ্রাম সুগার, ২৭৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি ও ৩৩ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার থাকে। খনিজের মধ্যে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক -কমবেশি সবই আছে। আর ভিটামিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বি-৬, বি-১২, সি, এ, ই, ডি, কে, থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ফোলেট রয়েছে। এইসব যৌগের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য আছে।
প্রতিদিন সকালে ও রাতে ২-৩টি লং বা লবঙ্গ চিবিয়ে খেলে যেসব রোগে উপকার পাওয়া যায়=
১. দাঁতের ব্যথা কমায়: লবঙ্গ দাঁতের ব্যথা দূর করে। মাড়ির ক্ষয় নিরাময় করে। লবঙ্গতে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান শরীরে প্রবেশ করার পর এমন কিছু বিক্রিয়া করে যে নিমেষে দাঁতের যন্ত্রণা কমে যায়। প্রায় সব টুথপেস্টের কমন উপকরণ এই লবঙ্গ।
২. বমি বমি ভাব দূর করে: ট্রেনে বা বাসে যাওয়ার সময় যদি মাথা ঘুরতে থাকে ও বমি এসে যায়, তাহলে মুখে একটি লবঙ্গ রেখে সেই রস চুষলে বমি ভাব ও মাথা ঘোরা কমে যাবে। গর্ভবতী মায়েরা সকালের বমি বমি ভাব দূর করতে লবঙ্গ চুষতে পারেন। লবঙ্গের সুগণ্ধ বমিবমি ভাব দূর করে।
৩. সর্দি-কাশি ও ঠাণ্ডা লাগা কমায়: সর্দিকাশির মহৌষধ হিসেবে লবঙ্গ বহু বছর ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লবঙ্গ চিবিয়ে রস গিলে খেলে বা লবঙ্গ মুখে রেখে চুষলে সর্দি, কফ, ঠাণ্ডা লাগা, অ্যাজমা, গলা ফুলে ওঠা, রক্তপিত্ত আর শ্বাসকষ্টে সুফল পাওয়া যায়।
৪. সাইনাস ইনফেকশনের প্রকোপ কমায়: সাইনোসাইটিস রোগে লবঙ্গ খুব উপকারি। সাইনোসাইটিসের রোগীদের চিকিৎসায় লবঙ্গ ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। লবঙ্গে বিদ্যমান ইগুয়েনাল নামে একটি উপাদান আছে, যা সাইনাসের কষ্ট কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৫. মাথা ব্যথা ও মাথা যন্ত্রণা কমায়: ধোঁয়া, রোদ এবং ঠান্ডার জন্য শ্লেষ্মা বেড়ে নানা ধরনের মাথা ব্যথা বা মাথার রোগ দেখা দিতে পারে। মাথা ব্যথা কমাতে লবঙ্গের উপকারিতা অপরিসীম।
৬. পেট ফাঁপা ও পেটের অসুখ উপসম করে: পেট ফাঁপা রোগ নিরাময়ে লবঙ্গ ব্যবহার হয়। লবঙ্গ এনজাইম বৃদ্ধি করে বদহজম, অগ্নিমান্দ্য (খিদে না হওয়া), পেটের গ্যাস ও বায়ু, পেট ব্যথা, অজীর্ণ, এমনকি কলেরা বা আন্ত্রিক রোগের উপকার করে।
৭. কামোদ্দীপক ও যৌনরোগে উপকারি: লবঙ্গ কামোদ্দীপক। এর সুবাস অবসাদ দূর করে, শরীর ও মনের ক্লান্তি ঝরিয়ে দেয়। যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে।
৮. প্রচণ্ড স্ট্রেস ও উৎকণ্ঠা কমায়: এক টুকরো লবঙ্গ মুখে ফেলে চুষে চুষে খেয়ে ফেলুন। পান করতে পারেন লবঙ্গের চাও। মেজাজ ফুরফুরে হয়ে উঠবে।
৯. ব্রণের চিকিৎসায়: লবঙ্গ ব্রণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ব্রণের দাগ দূর করতে লবঙ্গের পেস্ট ব্রণের ওপরে দিয়ে রাখুন। লবঙ্গ খেলেও ব্রণ হবে না।
১০. রক্ত পরিশোধন করে: লবঙ্গ শরীর থেকে ক্ষতিকর উপাদানগুলো সরিয়ে রক্তকে পরিশোধন করতে ভূমিকা রাখে। রক্তকে পরিস্কার করে।
১১. পিপাসা রোগে উপকারি: যারা পিপাসা রোগে প্রায়ই আক্রান্ত হন; বার বার পানি পান করতে হয়। তাদের সকালে ও বিকালে লবঙ্গ খেলে-পিপাসা চলে যাবে।
১২. খাবারে রুচি বৃদ্ধি করে: বিভিন্ন রোগ বিশেষ করে পেটের রোগে এবং জ্বরে ভোগার পরে খাবারে অরুচি দেখা দেয়। ভাত-রুটি, মাছ-মাংস, মিষ্টান্ন বা যেকোন উপাদেয় খাবরে পর্যন্ত রুচি হয় না সেক্ষেত্রে লবঙ্গ চুর্ণ সকালে খালি পেটে দুপুরে খাবারের পরে খেলে খাবারে রুচি ফিরে আসবে।
১৩. হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে: হজমে সহায়তা করে এমন এনজাইম নিঃসরণের মাধ্যমে এবং অ্যাসিড ক্ষরণের মাধ্যমে লবঙ্গ আমাদের হজম ক্ষমতা সক্রিয় করে তোলে। এরা ফ্লাটুলেন্স, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, ডিসপেপসিয়া এবং নসিয়া কমাতে সাহায্য করে। এটি শরীরের রক্ত প্রবাহেরও উন্নতি ঘটায়।
১৪. বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান বিদ্যমান: লং এর মধ্যে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিকারসিনোজেনিক, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়া, অ্যান্টিইনফ্লেমেটোরি, হেপাটো-প্রোটেক্টিভ সহ আরো অনেক বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান পাওয়া যায়। লবঙ্গ কলেরা, যকৃতের সমস্যা, ক্যান্সার, শরীরে ব্যথা ইত্যাদি থেকে শরীরকে রক্ষা করে। অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল প্রপাটিজ যে কোনও ধরনের জীবাণুকে মেরে ফেলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
১৫. ডায়াবেটিস রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখে: ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন তৈরি হতে পারে না। গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, লং এর রস শরীরের ভিতরে ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে ও কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, এবং রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রক্তে শকর্রার মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা কমে যায়। নিয়মিত লবঙ্গ খেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সহজ।
১৬. মুখের রোগ সারিয়ে তুলে ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করে: মাড়ির সমস্যা, যেমনঃ জিনজিভাইটিস ও পেরিওডনটাইটিস হলে লং ব্যবহার করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। লং এর মুকুল (মাথার অংশ) ওরাল প্যাথোজেনের বৃদ্ধি রোধ করে আপনার মুখটিকে সকল রোগের হাত থেকে রক্ষা করে। মাড়ির ক্ষয় বা দাঁতের ব্যথা রোধেও এরা সাহায্য করে। মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে লবঙ্গ তুলনাহীন। মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে প্রতিদিন রাতে ঘুমাবার সময় ২টি লবঙ্গ মুখে দিয়ে চিবিয়ে ঘুমাতে হবে। কয়েকটি মুখে রেখে চিবালেই আপনার নিঃশ্বাস হয়ে উঠবে তরতাজা।
১৭. আর্থ্রাইটিসের যন্ত্রণা কমায়: লবঙ্গে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান আর্থ্রাইটিসের প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে। প্রসঙ্গত, জয়েন্ট পেইন কমানোর পাশাপাশি পেশির ব্যথা, হাঁটুতে, পিঠে বা হাড়ের ব্যথা এবং ফোলা ভাব কমাতেও এই ঘরোয়া ঔষধিটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
১৮. জ্বরের প্রকোপ কমায়: লবঙ্গে থাকা ভিটামিন কে এবং ই, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এতটাই শক্তিশালী করে দেয় যে শরীরে উপস্থিত ভাইরাসেরা সব মারা পরে। ফলে ভাইরাল ফিবারের প্রকোপ কমতে সময় লাগে না। প্রসঙ্গত, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার হয়ে যাওয়ার পর সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়।
১৯. ত্বকের সংক্রমণ সারাতে কাজে আসে: আসলে লবঙ্গে উপস্থিত ভোলাটাইল অয়েল শরীরে উপস্থিত টক্সিক উপাদানদের বের করে দেয়। সেই সঙ্গে জীবাণুদেরও মেরে ফেলে। ফলে সংক্রমণজনিত কষ্ট কমতে একেবারেই সময় লাগে না। ঘা পচড়া হতে পারবে না।
২০. লিভারের কর্মক্ষমতা বাড়ায়: লবঙ্গে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে প্রবেশ করার পর দেহের মধ্যে উপস্থিত টক্সিক উপাদানদের বের করে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শুধু লিভার নয়, শরীরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কর্মক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রসঙ্গত, এই প্রকৃতিক উপাদানটিতে একাধিক হেপাটোপ্রটেকটিভ প্রপার্টিজও রয়েছে, যা এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
২১. শরীর ফোলা কমায়: লবঙ্গ খেলে ঠাণ্ডার জন্যে শরীরের কোনো অংশ ফুলে ওঠা কমে যায়।
২২. শ্বাস কষ্ট কমায়: লবঙ্গ চিবিয়ে রস গিলে খেলে শ্বাস কষ্ট ও হাঁপানিতে আরাম পাওয়া যায়।
২৩. হাড় শক্ত করে: লবঙ্গে উপস্থিত ফেনোলিক কম্পাউন্ড-ইউজিনল এবং ইউজিনল ডেরিভাটিভস শরীরে প্রবেশ করার পর বোন ডেনসিটির (হাড়ে ঘনত্ব) উন্নতি ঘটে। এটি হাড়ের ভেতরের নানাবিধ মিনারেলের ঘাটতিও পুরণ করে। ফলে হাড়ের সমস্যাজনিত যে কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। নারীরা এবং বয়স্ক মানুষদের নিয়মিত লবঙ্গ খেলে হাড়ের সমস্যা অনেকটা কমে যায়।
২৪. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে: লবঙ্গ ব্রেস্ট ক্যান্সার, ওভারিয়ান ক্যান্সার প্রতিরোধ করে থাকে।