এ কিউ রাসেল, গোপালপুর (টাঙ্গাইল) : টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার চরাঞ্চলে অধিকাংশ আবাদী জমি ‘বিষবৃক্ষ’ তামাকের চাষাবাদে দখল করে নিয়েছে। এ উপজেলার অধিকাংশ অংশ নদী বা চরাঞ্চল। আগে যেসব জমিতে ভু্ট্টা,বাদাম, আলুর আবাদ হতো, এখন সেসব জমিতে ‘বিষবৃক্ষ’ তামাকের চাষ হচ্ছে। চরাঞ্চলে প্রায় জমিতেই এখন তামাক চাষের দখলে।
অগ্রিম ঋণ, বিনামূল্যে বীজ, ঋণে সারসহ নানামুখী প্রলোভন দেখিয়ে দিন দিন বাড়ছে মরণ চাষ তামাকের চাষাবাদ। পাশাপাশি তামাক বিক্রয়ের নিশ্চয়তা পেয়ে তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। তামাক চাষ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফার আশায় নারীসহ পরিবারের সবাই সমানভাবে কাজ করছেন তামাকের জমিতে। এ কাজে অংশ নিচ্ছে শিশুরাও। উৎপাদিত তামাক বিক্রি নিয়ে কোনো ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না তাদের। এমন নিশ্চয়তা অন্য কোনো ফসল চাষের ক্ষেত্রে না পাওয়ায় তারা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন।
সচেতন কিছু চাষির সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকার যদি তামাক কোম্পানির মতো বিনা শর্তে ঋণসহ উৎপাদিত ফসল ক্রয়ের নিশ্চয়তা দেয়, তাহলে চাষিরা তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য ফসল চাষাবাদে আগ্রহী হবেন। এজন্য সরকারের সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তারা।
স্থানীয়রা তামাক চাষকে তাদের ভাগ্য বদলের চাবিকাঠি মনে করে, বিধায় তাদের স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিশুরা তামাকের জমিতে কাজ করতে দেখা যায়।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা তামাক শ্রমিকের কাজ করছে। তারা কেউ তামাকের আইলচা বাঁধছে, গাছ থেকে পাতা ভাঙছে, পাতা শুকাচ্ছে, গাছের গোড়ায় থেকে আগাছা পরিষ্কার করছে আবার কেউ বা শুকানো তামাকগুলো বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
কথা হয় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ক্ষুদে শিক্ষার্থী কাউসার হোসেনের সাথে। কাউসার বলেন, সকালে একটু সময় পড়ে সকাল ৯ টা পর্যন্ত তামাকের কাজ করি। তারপর স্কুলে চলে যাই। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বিকেলে আবার তামাকের কাজ করি। কিন্তু শুক্রবার হলে সারা দিনই কাজ করি। মজুরি হিসেবে ২০ থেকে ৫০ টাকা করে দেয় তামাক ক্ষেতের মালিকরা।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া স্কুলছাত্রী বিথী বলেন, সপ্তাহের শুক্রবার স্কুল বন্ধ। তাই তামাকের কাজ করছি। ৫ থেকে ৭ ফুট আইলচা বাঁধলে দেয় ৩-৫ টাকা। সারাদিন কাজ করলে ৮০ টাকা ১শ ২০ টাকা দেয় জমির মালিকরা।
স্কুল পড়ুয়া আঁখি বলেন, তামাকের কাজ যেদিন করি সেদিন আর ভাত খেতে পারি না। দু-হাত তেঁতো হয়ে যায়, ঠান্ডাজ্বর, শুকনো কাশি লেগে যায়। তবুও কাজ করি লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য।
উপজেলার গাবসারা ইউনিয়নের চরাঞ্চল রায়ের বাসালিয়া গ্রামের তামাক শ্রমিক মোছা. রজিনা বেগম (৫০) আক্ষেপ করে জানান, তামাকের কাজ করে দিনে একশ ৫০ টাকা পারিশ্রমিক দেয়। এ দিয়ে সংসার চলে না। তামাক চাষিরা তারা অনেক টাকা বিক্রি করেন। অথচ আমাদের কম মজুরি দেয়। মজুরি বাড়ানোর কথা বললে, তামাক চাষিরা কাজ করা জন্য আর নেয়না। তাই কম টাকাতেই বাধ্য হয়ে কাজ করি। তবুও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কেননা আমরা নারীরা গ্রামেগঞ্জে কাজ করতে পারি। না হলে পরিবার নিয়ে রাস্তায় নামতে হতো। স্বামী অসুস্থ। তাই তার চিকিৎসার টাকাও যোগার করতে হয় কামলা দিয়েই।
সরেজমিনে আরো দেখা যায়, যমুনা নদী চরাঞ্চলের গাবসারা ইউনিয়নের রায়ের পাড়া বাসালিয়া, গোবিন্দপুর, রুলীপাড়া, রামপুর, বামনহাটা, জংলীপুরসহ চরের শত শত হেক্টর জমি এ বিষাক্ত তামাক চাষাবাদ করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের তামাকজাত দ্রব্য বিভিন্ন কোম্পানিরা বেশি লাভের প্রলোভন দেখিয়ে স্থানীয় কৃষকদের মাধ্যমে প্রজেক্ট তৈরী করেছে তামাক চাষের।
তামাক শ্রমিক আরেক নারী বলেন, তামাক চাষে বেশির ভাগই নারীরা কাজ করে থাকি। কাজের পারিশ্রমিক খুবই কম। বর্তমানে একজন পুরুষ শ্রমিকের দিন হাজিরা ৩শ ৫০ টাকা থেকে ৪শ ৫০টাকা। আর আমরা পাচ্ছি মাত্র ১শ ৫০ টাকা। এতে করে আমরা নারী শ্রমিকরা নায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তামাক শ্রমিক হিসেবে দিন মজুরির কাজ করি। দিনের মাঝখানে দু’বার খাবার সময় পাই। বিরতি শেষে কাজে। আবার সংসারের কাজকর্মও করতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় ছেলে- মেয়েদের পড়াশোনার। মাথায় চিন্তা ঘুড়পাক খায় দু’বেলা দু-মুঠো পেট ভরে ডাল ভাত খেতে পারব কি না।
কথা হয় তামাক চাষি এজেন্টের সাথে। তিনি বলেন, ভুট্টা চাষের তুলনায় তামাক চাষে লাভবান বেশি। তাই তামাকজাত দ্রব্য বিভিন্ন কোম্পানির খরচে ও সহযোগিতায় জেগে ওঠা চরে তামাক চাষ করেছি। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, বিষাক্ত মরণব্যাধি তামাক কেন চাষ করছেন? এমন প্রশ্ন জবাবে বলেন, বেশী লাভের আশায় তামাক চাষ করছেন তারা। কথা হয় নারী শ্রমিকদের মজুরি নিয়েও। তবে নারী শ্রমিকদের কম মজুরি প্রদানের বিষয়ে কথা বলতে নারাজ।
যমুনার চরাঞ্চলে দেখা যায়, তামাক চাষের জমিগুলোতে নারী শ্রমিকের উপস্থিতি বেশি। সংসার চালানোর দায়েই তামাকের কাজ করছে এসব নারী শ্রমিকরা। এ চরাঞ্চলে শুধু তামাকের কাজ করেন, তা নয়। নারীরা বিভিন্ন ধরণের কাজ করছেন দিন মজুর হিসেবে। রজিনার মত শত শত নারী ও শিশু শিক্ষার্থীরা তামাকসহ বিভিন্ন ধরণের কাজ করছে।
চলতি বছর ভূঞাপুর উপজেলায় চাষ করছে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, ঢাকা ট্যোবাকো, আবুল খায়ের ট্যোবাকো, নাসির ট্যোবাকো, আকিজ ট্যোবাকো।
উপজেলার যমুনা চরঞ্চলে বিষাক্ত মরণব্যাধি তামাকের চাষের বিষয়ে ভূঞাপুরের উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. জিয়াউর রহমান বলেন, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে তামাক চাষ না করার জন্য চরাঞ্চলে মাঠ পর্যায়ে কৃষকের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তামাকের বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর দিক নিয়ে প্রান্তিক কৃষকের নিয়ে করা হয়েছে আলোচনা। তবুও কিছু কৃষকরা প্রলোভনে পড়ে তামাকের চাষ করছে।
তিনি আরো জানান, এক সময় ধান, ভুট্টা, আলু, বেগুন, লাউ, শিম, মূলা, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষের জন্য সুনাম ছিল এ উপজেলার। কিন্তু মাঠের পর মাঠ এখন চোখে পড়ে শুধু তামাকের জমি। যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে তামাক চাষ। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করলেও তামাক কোম্পানীদের লোভনীয় আশ্বাসে তামাক চাষের দিকেই ঝুঁকে পড়ছেন এ উপজেলার কৃষকরা।
গত বছরের তুলনায় এ বছর অনেকটা তামাকের চাষাবাদ কম হয়েছে। আগামীতে তামাক চাষ আরও কম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভুট্টা, চিনা বাদামসহ বিভিন্ন ধরণের ফসল চাষাবাদও বাড়ছে চরাঞ্চলে। কৃষি অফিস থেকে চরাঞ্চলসহ উপজেলার প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদের বিভিন্ন মৌসুমে আর্থিক সহযোগিতা, কীটনাশক, উচ্চ ফলনশীল বীজ বিনামূল্যে প্রদান করে হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের নিয়ে নিয়মিত কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা ও অসুবিধা সমাধানের জন্য উপ-সহকারি কৃষি অফিসারগণ কৃষদের দোর গোড়ায় গিয়ে পরামর্শ দিচ্ছে কৃষকদের। ব্লকে ব্লকে উপ-সহকারি কৃষি অফিসারগণ সভা সেমিনার করছে, নিরাপদ ফসল উৎপাদনে উৎসাহী করতে। তামাক চাষাবাদে নিরুৎসাহিত করতে।
উপজেলার সচেতন মহলের দাবি, এখনিই পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা না হলে, আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়ে অচিরেই উপজেলায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।