রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪

একজোড়া টার্কি থেকে বিশাল খামারের মালিক মনোয়ারা

মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর প্রতিনিধি): মনোয়ারা বেগম। স্বামী মো. লোকমান খান। ৩ ছেলের মাঝে বড় ছেলে শামীম পারভেজ ছাত্র বয়স থেকেই পশু-পাখি লালন পালনের প্রতি আগ্রহী। সে আগ্রহকেই কাজে লাগিয়ে এক জোড়া টার্কি থেকে আজ টার্কি খামারের মালিক মনোয়ারা বেগম। মেঝো ছেলে রায়হান সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হলেও খামারের খোঁজ খবর রাখেন। আর ছোট ছেলে সাফিন খান দেশে পড়াশুনার পাশাপাশি তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন।

চাঁদপুর পৌরসভার ১৩ নং ওয়ার্ডের মধ্য তরপুরচন্ডীতে ফিশারী সংলগ্ন প্রাইমারী স্কুল সড়কে সুবিশাল ‘চাঁদপুর এগ্রো’। এ ফার্মের মাধ্যমে টার্কি মুরগি পালনে ভাগ্য বদলেছে মনোয়ারা বেগমের। গৃহিণী মনোয়ারা বেগম বছর দুই আগে তার বড় ছেলে শামীমের উৎসাহে টার্কির ডিম এনে প্রাথমিকভাবে শুরু করেন। পরে কিছু ডিম থেকে বাচ্চা ফুটলেও অতদূর এগোয়নি। সর্বশেষ এক থেকে-দুই জোড়া টার্কি ধরে রাখতে সফল হন তারা। টার্কির বয়স ছয়-সাত মাস যেতে না যেতেই ডিম দেয়া শুরু করে। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই এক জোড়া টার্কি মুরগি থেকে এখন তিনি কয়েকশ’ টার্কি মুরগির মালিক।মনোয়ারা বেগম বলেন, জীবনের অনেক সময় অলস পার করেছি। আমার সন্তানরা পড়ালেখার পাশাপাশি পরিবারের অভাব-অনটন বুঝতো। সে কারণে পোল্ট্রিফার্ম ও নানা ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করলেও তেমন স্বচ্ছলতা আসেনি। কিন্তু টার্কি মুরগি পালনে ভাগ্য বদলেছে আমাদের। প্রতি মাসে ডিম ও টার্কি মুরগি বিক্রি করে আয় হয় ভালোই। এখন বাণিজ্যিকভাবে টার্কির খামার করছেন তিনি। তার ছেলে শামীম পারভেজ বলেন, এ মুরগির সাধারণ মুরগির মতো রোগ বালাই হয় না। টার্কির রোগ বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব বেশি। ছয় মাসের একটি পুরুষ টার্কির ওজন হয় পাঁচ-ছয় কেজি এবং স্ত্রী টার্কির ওজন থাকে তিন-চার কেজি। ইনকিউবেটরের মাধ্যমে ২৮ দিনেই এর ডিম ফুটোনো যায়।

মনোয়ারা বেগম আরো বলেন, দেশের অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশে পশু-পাখি পালন অন্যান্য দেশের তুলনায় সহজ। আবার কিছু প্রাণি আছে যারা দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। আর টার্কি মুরগি সে রকম একটি সহনশীল জাত, যে কোনো পরিবেশে দ্রুত এরা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। দেশের বাইরে থেকে বাচ্চা এনে টার্কি মুরগির খামার পরিপূর্ণতায় গড়ে তুলেছিলাম। আল্লাহর রহমতে এখন শত শত টার্কি মুরগি রয়েছে আমাদের খামারে। টার্কির খাবারের জন্য কোনো সমস্যা হয় না। দানাদার থেকে কলমির শাক, বাঁধাকপি বেশি পছন্দ করে। মাংস উৎপাদনের জন্য দানাদার খাবার দেয়া হয়। ওজন হয় প্রায় ১৬ কেজি। আর ডিমের জন্যে ৭/৮ কেজি ওজন হয়ে থাকে। টার্কির রোগ-বালাই খুবই কম। বছরে ১১০টির বেশি ডিম দিয়ে থাকে। ডিম থেকে বাচ্চা হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে টার্কি ডিম দিতে শুরু করে। ৬ মাসের মেয়ে টার্কির ওজন হয় ৫/৬ কেজি। আর পুরুষ টার্কিগুলোর প্রায় ৮ কেজি। তিনি বলেন, টার্কির দাম তুলনামূলক একটু বেশি। চর্বি কম হওয়ায় অন্যান্য পাখির তুলনায় মাংস খুবই সুস্বাদু।

সাফিন খান বলেন, এক মাসের বাচ্চার জোড়া বিক্রি করেন জাত ভেদে তিনশ’ পঞ্চাশ থেকে আড়াই হাজার টাকায়। প্রতিটি ডিম বিক্রি করেন একশ’ থেকে আটশ’ টাকায়। ঢাকা, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তার টার্কি মুরগি ক্রয় করতে আসেন ক্রেতারা। সম্প্রতি ফেইসবুক-এ চাঁদপুর এগ্রো ফার্ম নামে তার পেজ খোলা হয়। এর ফলে বিক্রি দ্বিগুণ বেড়েছে। টার্কির মাংসের সুখ্যাতি বিশ্বজুড়ে। এর উৎপাদন খরচ তুলনামূলক অনেক কম। তাই টার্কি পালন বেশ লাভজনক। টার্কির প্রধান খাবার ঘাস। তবে বাঁধাকপি, কচুরিপানা এবং দানাদার খাবারও খেয়ে থাকে এরা। প্রতি কেজি ৩০০ টাকা ধরা হলে ছয় কেজির একটি টার্কির দাম দাঁড়ায় ১ হাজার ৮০০ টাকা।এ সাফল্য ধরে রাখতে সরকারি আর্থিক সাপোর্ট কামনা করেন মনোয়ারা বেগম। এছাড়া বেসরকারি কোনো ব্যাংক যদি ঋণ প্রদান করেন, তাহলে এ ফার্মের পরিধি আরো বাড়াতে পারতেন। তিনি জানান, অনেকে ভারত থেকে নিম্নমানের টার্কির বাচ্চা সংগ্রহ করছে। আর এগুলো একদল প্রতারক চক্র দেশে নিয়ে আসেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের বাচ্চা মারা যাচ্ছে। নিম্নমানের বাচ্চা চেনার বিশেষ কোনো কৌশলও নেই। তাই তিনি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে বাচ্চা সংগ্রহের পরামর্শ দেন। অনেকেই আগ্রহ নিয়ে তার কাছে আসেন টার্কি মুরগি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে। অনেক খামারি টার্কি মুরগি পালনে আগ্রহী। এ বিষয়ে জ্ঞানের পরিসরও কম। তাই খামার স্থাপন করতে সাহস পাচ্ছেন না অনেকেই।

এ বছর চাঁদপুর এগ্রো ফার্মে বিদেশী টার্কি মুরগির মধ্যে ফেন্সি, স্ন্যাক ডায়মন্ড, ব্রোঞ্জ, হোয়াইট হল্যান্ড, রেড বারবান, রয়েল জাতের টার্কি রয়েছে। এছাড়া আরো আছে হোয়াইট ও স্ন্যাক বুটেট বেনথাম (ভারত), সিলবার প্রিজেল (বেলজিয়াম), পালিশ কেপ (বেলজিয়াম), আছিল পাইটার (কেরালা), পলিশ ক্যাপ, এরাকোনা, গোল্ডেল পলিস সেবরাইট, ফাইটার, চিনা মুরগী (তিথির)। কাদাকনাথ মুরগীটি কালো। এ মুরগীটির মাংস কালো রঙের এবং খুব সুস্বাদু, ডিমের রঙ সাধারণ মুরগির ডিমের রঙের মতই। ফার্মে নতুন পরিকল্পনায় রয়েছে বিদেশী মুরগীর আরো কালেকশন। এছাড়া আরো থাকবে ছাগলের খামার এবং ফলজ গাছের বাগান।

জানা গেছে, মধ্য তরপুরচন্ডী গ্রামে ২০১৫ সালের শেষের দিকে ১৬ শতক জায়গার উপর চাঁদপুর এগ্রো ফার্ম নামে টার্কি মুরগির খামার গড়ে তোলেন মনোয়ারা বেগম। বর্তমানে প্রায় তিনশ’ টার্কি মুরগি আছে এ খামারে। ১টি টার্কি মুরগি একটানা ২২টি পর্যন্ত ডিম দেয়। তারা নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করেছেন হ্যাচারি মেশিন। এ মেশিনে ডিম রাখার ২৮ দিন পর বাচ্চা ফুটে। দানাদার খাদ্য ছাড়াও কলমির শাক, বাঁধাকপি ও নরম ঘাস জাতীয় খাবার খায় টার্কি মুরগি। ৪ মাস পর থেকে খাওয়ার উপযোগী হয় টার্কি মুরগি। ৬ মাসের মুরগি প্রায় ৬/৭ কেজি পর্যন্ত হয়।

তথ্যমতে জানা যায়, ১৭শ’ সালে যুক্তরাজ্যে ক্রস ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে টার্কি মুরগির জাত উৎপাদন করা হয়। উত্তর আমেরিকা টার্কি মুরগির উৎপত্তিস্থল। ইউরোপসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই টার্কি মুরগি পালন করা হচ্ছে। অনেকটা খাসির মাংসের মতোই এ মুরগির মাংসের স্বাদ। টার্কির মাংসের দাম তুলনামূলক একটু বেশি। চর্বি কম হওয়ায় অন্যান্য পাখির তুলনায় মাংস খুবই সুস্বাদু।

চাঁদপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুল মোতালেব বলেন, টার্কি মুরগি আমাদের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নতুন একটি প্রজাতি। টার্কি মুরগি পাখি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। রোগ-বালাই ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় এটি পালন করে সহজেই লাভবান হওয়া যায়। এ কারণে খামারিরা এ টার্কি মুরগি পালনের মতো লাভজনক ব্যবসায় ঝুঁকছেন। প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে সকল টার্কি মুরগির খামারিকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং সহযোগিতা করা হয়।

 

This post has already been read 5294 times!

Check Also

ইটভাটাতে বিদেশি ফলের বাগান গড়ে আলোচিত চাঁদপুরের হেলাল উদ্দিন

মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর প্রতিনিধি) : চাঁদপুর শহরতলীর শাহতলী গ্রামে নিজেদের ৬০ বছরের লাভজনক ইটভাটা ছেড়ে …