ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা): খুলনাঞ্চলের হোয়াইট গোল্ড বলে খ্যাত বাগদা চিংড়ি। সাদা সোনার রাজ্য বলে পরিচিত খুলনা। সেই হোয়াইট গোল্ডে অপদ্রব্য পুশ, অব্যাহতভাবে ভাইরাসের আক্রমণ, পর্যাপ্ত জমির অভাব, হারীর মূল্য বেশি, চিংড়ির বাজার মূল্য কম ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে চিংড়ি চাষ এখন হুমকির মুখে। ফলে অব্যাহতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত চিংড়ি চাষিরা কাঁকড়া চাষের দিকে ঝুঁকছেন। খুলণাঞ্চলে হোয়াইট গোল্ড বলে খ্যাত বাগদা চিংড়ি রপ্তানীর সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ভুমিকা রয়েছে দেশের উপকুলীয় অঞ্চলের জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও পিরোজপুর। বাগদা চিংড়ি চাষকে কেন্দ্র করেই এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে চিংড়ি প্রসেসিং ও প্যাকেজিং শিল্প। বাগদা চিংড়িতে ভাইরাস রোগ বৃদ্ধি, এ্যামুনিয়া গ্যাস সংকট এবং অপদ্রব্য পুশে করে কিছু অসাধু চিংড়ি ডিপো ও ব্যবসায়ীদের কারণে আজ রপ্তানীমুখি এ চিংড়ি শিল্প চলছে খুরিয়ে খুরিয়ে। বিদেশের বাজারে মানসম্মত চিংড়ি রপ্তানীতে ব্যর্থ হয়ে অনেক চিংড়ি প্রসেসিং কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কারখানা বন্ধের কারণে বেকার হয়েছে হাজার হাজার নারি শ্রমিক ও এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা। একদিকে বিশ্ব বাজারের প্রতিযোগিতা অন্যদিকে চিংড়িতে ভাইরাস, অপদ্রব্য পুশ দিনকে দিন বেড়েই যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভাইরাস জনিত রোগ এবং অপদ্রব্য পুশের কারণে অনেক চিংড়ি চাষি ও প্রসেসিং প্রতিষ্ঠানের রপ্তানীকৃত চিংড়ি দেশে ফেরত এবং রপ্তানী অর্ডার বাতিল হওয়ায় প্রকৃত ব্যবসায়ীরা পড়ছেন বিপাকে। কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে, বেড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক ঋনের বোঝা। বিপুল কর্মসংস্থানের এই চিংড়ি শিল্পের ধ্বংসে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ, ভাইরাস জনিত রোগকেই দায়ি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই চিংড়ি রপ্তানি হ্রাস এবং দাম কমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের চিংড়ি চাষিরা কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন।
সূত্র মতে ৮০’র দশকে দেশে উপকূলীয় জেলাগুলোতে শুরু হয় লবণ পানির বাগদা চিংড়ি চাষ। শুরুর দিকে চিংড়ি চাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চিংড়ি চাষ ব্যবস্থা। এক সময়ের কৃষি অধ্যুষিত এলাকা পরিণত হয় চিংড়ি অধ্যুষিত এলাকায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় শুরুর দিকে চিংড়িতে তেমন কোনো রোগ বালাই দেখা না দিলেও ৯০’র দশকের পর হতে চিংড়িতে দেখা দেয় ভাইরাস সহ বিভিন্ন রোগ বালাই। যা গত কয়েক বছরে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এক সময় দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মূদ্রা আসতো দক্ষিণের চিংড়ি খাত থেকে, কিন্তু সে হিসেবটা যেন পাল্টে গেছে। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত চিংড়ি চাষি ও এ শিল্পের সাথে জড়িতরা। নিজেদের এবং পরিবারকে সচ্ছল রাখতে বাগদা চিংড়ি চাঁষিরা কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। কাঁকরা চাষে খরচ ও ঝুকি কম এবং লাভ বেশি হওয়াই জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তাছাড়া চিংড়িতে অব্যাহতভাবে ভাইরাসের আক্রমণ বেশির ভাগ চাষীকে হতাশ করে দিয়েছে। যেসব দেশে চিংড়ি রপ্তানি হতো সে সব দেশে দিন দিন বাড়ছে কাঁকড়ার কদর।
কোটি কোটি টাকা চিংড়ি চাষে বিনিয়োগ করে আসল টাকার ফেরৎ না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তারা। বড় বড় ঘের মালিকরা এখন বাগদার পাশাপাশি কাঁকড়া চাষের প্রক্রিয়া শুরু করছেন। ১০০ বিঘা জমিতে ২০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে যেখানে ৫ লক্ষ টাকা লাভ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার, সেখানে ৫ বিঘা জমিতে দেড় লক্ষ টাকা বিনিয়োগে ৫ লক্ষ টাকা অর্জন সম্ভব হচ্ছে। খুলনার পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, বাগেরহাটের রামপাল ও মংলা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খামারে তিন পদ্ধতিতে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। একটি পদ্ধতিতে ছোট ছোট পুকুরে রেখে মোটাতাজা করা হচ্ছে কাঁকড়া। আরেক পদ্ধতিতে বড় বড় ঘেরে চিংড়ির সঙ্গে কাঁকড়ার পোনা ছেড়ে বড় করা হচ্ছে, আবার উন্মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় আটকে রেখেও চাষ করা হচ্ছে কাঁকড়া।
কাঁকড়ার খামার বিভিন্ন মাপের হতে পারে। পাঁচ কাঠা থেকে এক বিঘা পর্যন্ত জমিতে কাঁকড়ার পুকুর করা যায়। এসব পুকুর মাছের পুকুরের মতো হলেও নিরাপত্তা বেষ্টনী রাখতে হবে। অন্যথায় কাঁকড়া হেঁটে অন্যত্র চলে যেতে পারে। মোটাতাজাকরণ পদ্ধতিতে পুকুরে প্রতি বিঘায় ৯০০ কেজি থেকে এক হাজার কেজি (৫০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার) কাঁকড়া চাষ করা যায়। নদীতে বা মুক্ত জলাশয়ে ৬০ খোপবিশিষ্ট ২১ ঘনফুট আয়তনের বাঁশের খাঁচায় কাঁকড়া চাষ বেশি লাভজনক। খামারে খাবার হিসেবে কাঁকড়াকে ছোট মাছ, কুঁচে, শামুকের মাংস দেওয়া হয়। এসব খাবার চাষিরা ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে কেনেন। কপিলমুনি কাঁকড়া ব্যবসায়ী মিলন দাশ জানান, প্রায় সারা বছরই কাঁকড়া চাষ হয়। রপ্তানি উপযোগী প্রতিটি কাঁকড়ার গড় ওজন হয় ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম। এসব কাঁকড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। মাঝে মধ্যে এমন সময়ও আসে, যখন প্রতি কেজি কাঁকড়ার দাম ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাগদা ও গলদার দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে আসা, পোনার দাম বৃদ্ধি, শ্রমিকের মুজরী বৃদ্ধি ও জমির হারী বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশির ভাগ ঘের মালিকরা আর্থিকভাবে দারুন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। অব্যাহত অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত চিংড়ি চাষীরা উন্নত প্রযুক্তিতে কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন।
কাঁকড়া চাষী আমিন উদ্দিন বলেন, বাগদা ও গলদা চাষের চেয়ে কাঁকড়া চাষে স্বল্প সময়ে বেশি লাভ করা যায়। কাঁকড়ায় ন্যায্য মূল্যও পাওয়া যায়, তাছাড়া এ ব্যবসা ভাইরাসের ঝুঁকিমুক্ত, তাই চিংড়ি চাষ ছেড়ে এখন কাঁকড়ার চাষ করছি। কাঁকড়া চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন এখানকার অনেক চাষী। কাঁকড়া চাষ, শিকার ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে কয়েক হাজার মানুষ। বাংলাদেশের জাতীয় রপ্তানি আয়ে উপাদানগুলোর মধ্যে কাঁকড়ার অবদান এখন গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে সাতক্ষীরায় চাষ হওয়া এসব কাঁকড়া আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বিদেশিদের খাবার টেবিলের মেন্যুতে যেসব খাবার এখন স্থান পাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম সুস্বাদু বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এ শিলা প্রজাতির কাঁকড়া। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে নির্দিষ্ট আকারের অনেক কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চিংড়ি ও জাতীয় মাছ ইলিশের পরই এখন কাঁকড়া একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে কাঁকড়া রপ্তানি করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোপাল চন্দ্র বলেন, সাতক্ষীরা থেকে প্রতি বছর রপ্তানিজাত কাঁকড়া উৎপাদন হয় প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার মেট্রিক টন। আর এসব কাঁকড়া আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। কাঁকড়া চাষের উপর স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাহলে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্ভাবনাময় কাঁকড়া চাষের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সরকারী ভাবে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা দিলে এ খাত থেকে প্রতি বছর মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন হবে। আমাদের দেশের বিভিন্ন সামুদ্রিক জলসীমা ও মোহনায় যে পরিমাণে কাঁকড়া জন্ম নিচ্ছে তা থেকে বছরে ৫০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। প্রতিবছর দেশের মৎস্য ঘের, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়সহ প্রভৃতি স্থানে প্রচুর পরিমাণে কাঁকড়া পাওয়া যায়।
সূত্র মতে, দেশে ১২ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। এদের মধ্যে মাইলা ও শীলা উন্নত মানের। হংকং, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, বার্মা, শ্রীলংকা, কোরিয়া ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কাঁকড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।