মঙ্গলবার , ডিসেম্বর ৩ ২০২৪

সম্রাট মির্জার গরুর রাজ্যে একদিন!

মো. খোরশেদ আলম জুয়েল: এইতো মাত্র এক দেড় যুগ আগেও দেশে গরু পালন ছিল অপেক্ষাকৃত গরীব এবং গ্রামাঞ্চলের লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পারিবারিব দুধের চাহিদা এবং কোরবানির ঈদে এক মুঠো কিছু টাকা ইনকাম –গরু পালন বলতে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ধারনা এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি গরু পালন করার কারণে ছেলে/মেয়ে বিয়ে দেয়া যাবেনা এমন ঘটনাও বহু দেখেছি।

যাইহোক, মানুষের সে ধারনা পাল্টাচ্ছে। ধারনা পাল্টানোর কাজটি সম্ভব হয়েছে কারণ- এ দেশের শিক্ষিত মানুষ এবং শহুরে তরুনেরা গরু শিল্পে বিনিয়োগ ও আত্মনিয়োগ করছেন; নেশা থেকে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন এবং নিজেকে গরুর খামারি পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। এমনই এক তরুনের গল্প বলছি আজ……।

নাম তার সম্রাট মির্জা। ঢাকার খিলগাঁও –এ বাড়ী। পিতা আবদুল মালেক ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেলের মালিক তারা। মূলত এটি তাদের পারিবারিক ব্যবসা। ছোটবেলা থেকেই গরু ও অন্যান্য পশু-পাখির প্রতি তার এক ধরনের ভালোবাসা কাজ করতো।

সম্রাটের শখ ছিল বাবার সাথে প্রতিবছর কোরবানির হাটে যাওয়া এবং গরু দেখা। শখের বসেই ছোট্ট সম্রাট বাবাকে একদিন আবদার করেন গরু কিনে দিতে। পিতা আবদুল মালেক সন্তানের শখ পূরণ করতে একটি গরু কিনে দেন এবং নিজেদের বাসার নিচে সম্রাট সেটি লালন পালন করতে থাকেন। সম্রাটের বয়স বাড়তে থাকে এবং সেই শখ এক সময় নেশায় পরিনত হয়। বন্ধু বান্ধব ও পরিচিতজন এবং ফেসবুকের মাধ্যমে কোন গরুর ফার্মের খোঁজ পেলেই চলে যেতেন সেখানে।

এক সময় সিদ্ধান্ত নেন এবার তিনি গরুর ফার্ম করবেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০১৬ সনে খিলগাঁওয়ের পূর্ব নন্দীপাড়ায় পিতার রেখে যাওয়া ১ বিঘা জমিতে পিতার নামেই ছোট পরিসরে গড়ে তোলেন ‘আব্দুল মালেক এগ্রো’ নামে ডেইরি ফার্ম। মূলত সে বছর এপ্রিল মাসে মাত্র ৮টি গরু দিয়ে ফার্মের যাত্রা শুরু করেন সম্রাট। একই বছর কোরবানির ঈদের আগে সেটির পরিমান দাঁড়ায় ২০টিতে। শুরুর প্রথম বছরেই সম্রাটের সংগ্রহ করা প্রায় ৯০ ভাগ গরু কোরবানির হাটে প্রায় বিক্রি হয়ে যায় এবং সেখান থেকে আয় হয় মোটামুটি পাঁচ লাখ টাকা।

সম্রাটের আগ্রহ আরো বেড়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত নেন ফার্মটিকে আরো বড় করবেন। ফলে ২০১৭ সনে এসে গরুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০টিতে এবং ওই বছর কোরবানির হাটে ৮৫ ভাগ গরু বিক্রয় হয়ে যায়। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সনে সম্রাট মির্জা সিদ্ধান্ত নেন গরু মোটাতাজাকরণের পাশাপাশি দুধ উৎপাদন বা ডেইরিতে বিনিয়োগ করবেন। প্রথমে একটি জার্সি জাতের গাই গরু দিয়ে শুরু করেন এবং উৎপাদিত দুধ নিজেদের পারিবারিক চাহিদার যোগান দিত। ১টি গরু দিয়ে শুরু করার উদ্দেশ্য ছিল,মূলত ডেইরি সম্পর্কে প্র্যাকটিকাল ধারনা এবং শিক্ষা নেয়া। বর্তমানে তার খামারে মোট ১০টি দুধের গরু রয়েছে যার অধিকাংশ গাভীন। বর্তমানে যদিও সেখান থেকে দৈনিক ৩০-৪০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়, তবে শীঘ্রই সেটি এবং ১০০ লিটার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি।

শুধু ঢাকাতেই নয়, সম্রাট মির্জা। গরুর ফার্ম করেছেন কুষ্টিয়াতেও। সেখানে রয়েছে ২৫টি বড় সাইজের ষাঁড় গরু। বর্তমানে তার ঢাকার পূর্ব নন্দীপাড়ার খামারে ছোট-বড় মিলে ৪০টি ষাঁড় গরু রয়েছে। এর মধ্যে অস্টাল জাতের কালো একটি ষাঁড় গরু যার ওজন প্রায় সাড়ে ১১শ’ কেজি। সম্রাট আশা করছেন, কোরবানির আগেই এটির ওজন প্রায় ১২শ’ কেজি হবে। গরুকে মোটাতাজা করতে কোন কোন ধরনের খাবার খাওয়ানো হয় জানতে চাইলে সম্রাট জানান, মূলত কাঁচা ঘাস কুঁড়া, ভূসি ও দানাদার জাতীয় খাদ্য খাওয়ানো হয়। মোটাতাজা করতে ওষুধ বা হরমোনে বিশ্বাসী নন তিনি।

সম্রাট বলেন, গরুকে যদি ঠিকমতো ক্ষুরা রোগের ভ্যাকসিন,সময়মতো কৃমির ওষুধ খাওয়ানো এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয় তাহলেই যথেষ্ট। প্রাকৃতিক ও দানাদার খাবারের মাধ্যমেই গরুকে মোটাতাজা করে লাভজনক করা সম্ভব। সৎ উপায়ে যেখানে লাভ করা সম্ভব সেখানে অসততার আশ্রয় নেয়া চরম বোকামি। তবে খাদ্যের অতিরিক্ত দামের কারণেও কিছুটা হতাশা প্রকাশ করলেন সম্রাট।

তিনি বলেন, খাদ্যের দাম দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। খামারিদের কথা চিন্তা করে সরকারের বিষয়টিতে নজর দেয়া দরকার। সম্রাটের ‘আব্দুল মালেক এগ্রো’ ফার্মে যে শুধু গরু পালন করা হয়, তা নয়। এখন সেখানে রয়েছে ৪০টি গাড়ল এবং উন্নত জাতের ১০টি ছাগল। এ এগুলোকেও সম্প্রসারিত করার ইচ্ছে আছে তার। এ বছর কোরবানির আগে আরো গরু উঠানোর ইচ্ছে আছে তার এবং কোরবানিতে ১২০টি ষাঁড় গরু বিক্রয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগুচ্ছেন তিনি।

তবে সম্রাটের শুরুর পথটা এতটা মসৃন ছিলনা। পরিবার থেকে মৃদু আপত্তি ছিল গরুর ব্যবসায় আসার ব্যাপারে। বন্ধু-বান্ধবের অনেকেই টিপ্পনি কাটতো ‘গরুওয়ালা’ বলে। কিন্তু সম্রাট সেগুলো এখন কাটিয়ে উঠেছেন প্রায়।

সম্রাটের মা এখন প্রায়ই চলে যান ছেলের গড়া গরুর ফার্ম পরিদর্শনে। স্ত্রীও উৎসাহ দেন, বন্ধুবান্ধবরাও দেখতে আসেন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল সম্রাটের ইচ্ছে, ঢাকায় আরো কয়েকটি গরুর ফার্ম করার।

সম্রাটের মূল উদ্দেশ্য ‘শুধু ব্যবসায়িক মুনাফা নয়; যাতে দেশের মানুষ নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত মাংস ও দুধ খেতে পারেন।

This post has already been read 6375 times!

Check Also

ইটভাটাতে বিদেশি ফলের বাগান গড়ে আলোচিত চাঁদপুরের হেলাল উদ্দিন

মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর প্রতিনিধি) : চাঁদপুর শহরতলীর শাহতলী গ্রামে নিজেদের ৬০ বছরের লাভজনক ইটভাটা ছেড়ে …