মো. খোরশেদ আলম (জুয়েল): বাংলাদেশের ডেইরি তথা ক্যাটল শিল্প বড় হচ্ছে। কিন্তু এর চেয়েও বড় বিষয়, এদেশের শিক্ষিত তরুনদের স্বপ্ন ও সাহস তারচেয়েও বেশি বড় হচ্ছে। পড়াশোনা শেষে শিক্ষিত হয়ে চাকুরিই করতে হবে -এমন ধারনা থেকে বের হয়ে আসছে আমাদের তরুনেরা। বাংলাদেশের ডেইরি/ ক্যাটল শিল্পে এমন বিষয়টি এখন ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। অন্যদিকে ছাদে শুধু ফল সবজির বাগান করা যাবে এমন ধারনারও পরিবর্তন হচ্ছে। শুধু শখ কিংবা ব্যাক্তিগত চাহিদা পূরণ নয়, ছাদের বাণিজ্যিক ব্যবহারের দিকে মনোযোগী হচ্ছেন অনেকেই।
আজকে এমনই এক স্বপ্নবান তরুনের গল্প শোনাবো আপনাদের যিনি খুব ছোট দিয়ে শুরু করলেও স্বপ্ন ও পরিকল্পনা অনেক বড়। কাজী মশিউর রহমান (মারুফ)। পিতা মরহুম কাজী মফিজুর রহমান, মাতা মাজেদা বেগম। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট মারুফের বেড়ে উঠা পৈতৃক বাড়ি ঢাকার খিলগাঁতে। মার্চেন্ডাইজিং –এ অনার্স এবং মার্কেটিং এমবিএ করার পর, আর দশটা ছেলের মতো কোন বায়িং হাউজ, গার্মেন্টস/ফ্যাশন হাউজ কিংবা অন্যকোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করার কথা ছিল মারুফের। কিন্তু সেগুলো তিনি করলেন না, করলেন ছাদের এক কোনায় গরুর খামার। বন্ধুবান্ধবদের কেউ কেউ প্রথমদিকে অবশ্য তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো, কেউ কেউ আবার গরুওয়ালা বলে ডাকতো। পাত্তা দিতোনা মারুফ ওসবের, ভালো কিছু করতে গেলে এমন হাসি ঠাট্টা আসবেই জানতেন তিনি। তবে বন্ধুদের অনেকে উৎসাহও দেয় তাকে, এখনতো কাউ লাভারদের বিরাট এক গ্রুপও হয়ে গেছে তার।
গরু পালনের প্রতি আগ্রহী হতে জানতে চাইলে মারুফ বলেন, ছোট থেকে গরুর প্রতি ভালবাসা আমার অনেক বেশি। ছোটবেলায় আমি কুরবানী ঈদের অপেক্ষায় থাকতাম কবে আসবে কুরবানী ঈদ, কখন গরু দেখতে হাটে যাবো । ঈদ আসলেই বাবাকে কুরবানি গরু কিনে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে জেতাম। কিন্তু ঢাকা শহরে গরু রাখার সমস্যা তাই ঈদের একদিনে আগেই গরু পেতাম। সেই থেকে বাবার কাছে থেকে আর কি গরুর প্রতি ভালবাসার শিক্ষা পাওয়া। ২০০৬ সালে বাবাকে হারাই, এরপর থেকে ইচ্ছা গরু নিয়ে কিছু করবো। আস্তে আস্তে ২০১১ থেকে ফেসবুক ভিত্তিক গরুর ভালবাসার গ্রুপ গুলোর সাথে জড়িত হই। আমি ২০১৭ সালে নিজে একটা গ্রুপ করি যেখানে সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের গরু প্রেমিকরা যুক্ত হতে থাকেন। সুযোগ পেলেই বিভিন্ন এগ্রো ফার্ম ও গরু হাট ঘুরে আসি এবং অভিজ্ঞতা গ্রহণ করি। নিজের একটি ফার্ম হোক সে স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু পালবো যে, জায়গা কোথায়? বিষয়টি নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা করতাম। ফেসবুক গ্রুপে হঠাৎ আরমান ও ইমতিয়াজ নামে দুজনের সাথে পরিচয় হয় যারা ছাদে গরু পালন করেন। সময় করে চলে গেলাম দুজনের ফার্ম দেখতে, মূলত ছাদে গরু পালনের আইডিয়াটা সেখান থেকেই আসে। যেহেতু বাড়িটি আমাদের নিজস্ব তাই অন্য কোন বাধা কাজ করেনি।
জানতে চাইলাম, গরু কেনা ও ফার্ম করার পুঁজি পেলেন কোথা থেকে? মারুফ বলতে থাকলেন, যেহেতু গরুর প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা ও আগ্রহ আছে আমার সেজন্য এ সেক্টরের অনেকের সাথেই ইতিমধ্যে পরিচয় হয়ে গেছে। মোটামুটি সবাই আমাকে ভালোবাসেন। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাহবুব মোরশেদ নামে এক বড় ভাই যিনি নিজেও একজন স্বনামধন্য খামারি এবং ওয়েল্টেক এগ্রো’র মালিক, তিনি আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করলেন এবং তাঁর খামার থেকে দুটি গরু আমার কাছে পাঠিয়ে দেন কোনরুপ অগ্রিম টাকা ছাড়াই। আমি আমাদের বাড়ির ছাদের এক কোনায় ছোট্ট একটি ঘর করি এবং সেখানে গরু দুটি লালন পালন করতে থাকি। দুই মাসের মাথায় এক বড়ভাই আমার ১টা গরু কুরবানি জন্য অগ্রিম বুকিং করে ফেলেন। ফলে আমার উৎসাহ বেড়ে যায় এবং ঘরটা আরেকটু বড় করি এবং ৪ টায় গরু পালন শুরু করি। আস্তে আস্তে গরুর সংখ্যা আরো বাড়াই এবং এক সময় সংখ্যা দাঁড়ায় ১২টিতে।
মজার ব্যাপার হলো গত বছর ঈদের প্রায় ১ মাস আগেই আমার সব গরু জন্য অগ্রিম বুকিং হয়ে যায়। বেশিরভাগ খামারিরা যেখানে কোরবানির হাটে গরু বিক্রির জন্য অপেক্ষা করে এবং অনেক সময় গরু অবিক্রিত থেকে যায় সেখানে মারুফের পালন করা গরু অগ্রিম বিক্রি হয়ে যাওয়ার কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি চাই মানুষ যেন স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ গরু কোরবানি দিতে পারেন এবং সে অনুযায়ী লালন পালন থেকে শুরু করে খাবার সরবরাহ করি। কোন রকম ক্ষতিকর কোন কিছু আমি গরুকে খাওয়াইনা, এমনকি গরু যতবার পায়খানা করবে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্কার করার জন্য লোক রাখা আছে। ফলে আমার ফার্মের গরুগুলো দেখতেও চমৎকার হয়।
তাছাড়া প্রতিবেশিদেরও যাতে দুর্গন্ধজনিত কোন সমস্যা না হয় সেদিকে আমি সর্বদা সচেষ্ট। ফলে পরিচিতদের মাধ্যমেই আমাদের ফার্মের গরু অগ্রিম বিক্রি হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা মানুষের আস্থা অর্জন করা এবং সেই আস্থার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। ফার্মের কাজে সহযোগিতা কে করেন জানতে চাইলে মারুফ বলেন, আমার ফার্মে আমার সাথে সার্বিক সহযোগীতা করে আমার এক ছোটবেলার গরুপাগল বন্ধু মো. মুহিবুল্লাহ এবং পার্টটাইম ফার্ম দেখাশুনা করে লাল ভাই। এছাড়াও মেঘডুবি এগ্রো’র কর্ণধার আলী শাহীন সামি ভাই এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফারমারস্ এসোসিয়েশন’র সভাপতি ও সাদেক এগ্রো’র কর্ণধার ইমরান ভাই আমাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা, উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দেন।
বলা হয়নি, মারুফের খামারের নাম রাখা হয়েছে ইভোক এগ্রো। গত বছর ঈদের পর থেকে ১১টা গরু সংগ্রহ করে মারুফ, এরমধ্যে ৬টি গরু বিক্রি হয়ে গেছে এবং বাকী ৫টি আছে যেগুলো ঈদের জন্য অগ্রিম বুকিং হয়ে আছে। তবে এ বছর ঈদে মারুফের টার্গেট আরো ৩০/৩৫টি নতুন করে সংগ্রহ করে বিক্রি করা। মারুফ বলেন, আমাদের ইচ্ছা আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য সুস্থ সবল ২ দাঁত বিশিষ্ট গরু দিবো ইন্নশাল্লাহ। আমাদের বিক্রয় মূল্য হবে ৪৫-৮০ হাজারের মধ্য। ছোট-মাঝারি গরুর ক্ষেত্রে ক্রেতারা প্রচুর ভোগান্তির শিকার হয়। হাট্ প্রাপ্ত বয়স্ক গরু বলে অনেক অসাধু বেপারি অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক গরু ধরিয়ে দেয় । আমার চাই সঠিক দামে সঠিক এবং সুস্থ সবল প্রাপ্ত বয়স্ক একটি করবানীর পশু দিতে। আমাদের পরিকল্পনাটা সেরকমই।
পড়াশোনা শেষে চাকুরি না করে ব্যবসাতে আসলেন কেন –এমন প্রশ্ন করলে বিনয়ী মারুফ বলেন, সবাই যদি চাকরি করি, তাহলে উদ্যোক্তা হবে কে এবং পরবর্তীতে যুব সমাজকে চাকরিটা দিবে কে? আমি মনের করি আরো বেশি উদ্যোক্তা হওয়া প্রয়োজন এদেশে। সরকারকে এ বিষয়ে ক্ষেত্র ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দরকার। গরু পালনের ব্যাপারে পরিবার থেকে কোন বাঁধা আসেনি জানতে চাইলে মারুফ বলেন,না আমার পরিবার আমাকে কখনো বাঁধা দেয়নি। কিছু বন্ধু, আত্মীয় এবং আরো অনেকে এটাকে ছোট চোখে দেখে মজা ও তুচ্ছ করে। কারণ তাদের ধারনা নেই এই সেক্টরটা কত বড়! যেহেতু তাদের ধারনা নেই, তাই আমি ওসবে কিছু মনে করিনা। আমি বিশ্বাস করি, কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে সফলতা আসবেই ইনশাল্লাহ। সেদিন সবাই এমনি বাহ বাহ করবে এটাই আমাদের দুনিয়ার নিয়ম।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চালে তিনি বলেন, আমি এখন ছোট আকারে ফার্ম শুরু করেছি আমাদের বাসার ৫ তালার ছাদে। ইনশাল্লাহ সামনের দিকে জায়গা নির্ধারণ করে আরো বড় আকারে করা ইচ্ছা আছে। ছাদে হওয়ার কারণে গরুর উঠা-নামাতে একটু বেগ পেতে হয়। ভবিষ্যতে আমাদের বড় আকারে করার ইচ্ছা আছে। আমাদের কাছে অনেকেই গরু চায় কিন্তু আমরা দিতে পারছিনা আপাতত। ইনশাল্লাহ অতি শীঘ্রই পারবো।