রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪

উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট

ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা): দুর্যোগ ও ঝড়ের মৌসুম শুরু হলেই হিড়িক পড়ে যায় সিডর-আইলা বিধ্বস্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণ মানুষের প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে জীবন চলার। একদিকে নদী ভাঙ্গন সুপের পানির তীব্র সংকট ও নদীর স্রোতে বাঁধভাঙ্গায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ৪০/৫০ লাখ মানুষ। খাবার পানির উৎস অধিকাংশ পুকুরের পানি এ সময়ে শুকিয়ে যায়। ফলে একটু খানি সুপেয় খাবার পানির সন্ধানে এলাকাবাসীকে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়। গ্রামের অধিকাংশ নলকূপে পানি উঠছে না এবং অনেক নলকূপ অকেজ হয়ে পড়েছে। গ্রামের পুকুর গুলি শুকিয়ে যাওয়ায় সরকারী বেসরকারী ভাবে নির্মিত ফিল্টার গুলিও এখন আর কোনো কাজে আসছে না। তাই বিভিন্ন গ্রামের লোকজন মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে কলসীতে করে পানি নিতে আসছে। আবার কেউ কেউ ভ্যান, ট্রলার ও নৌকা যোগে নদী পথে পানি সংগ্রহের অভিযানে নেমে পড়েছে। এভাবে কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে মধ্যে রাত পর্যন্ত চলে সুপেয় খাবার পানি সংগ্রহের অভিযান। সুপেয় পানির অভাবে কিছু কিছু গ্রামাঞ্চলের অসহায় মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে নদীর লবণাক্ত পানিতে ফিটকেরী মিশিয়ে খাওয়া ও রান্না বান্নার কাজেও ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া কিছু কিছু পুকুরের যত সামান্য পানিতে শ্যাওলার দুর্গন্ধ হলেও ওই সব পুকুরের পানি কিছু কিছু লোকজন বাধ্য হয়ে পান করায় অনেকে পানি বাহিত রোগ পেটের পীড়াসহ, ডায়রিয়া ও আমাশায় আক্রান্ত হচ্ছে।

সূত্রমতে, এ অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া, পুকুর-খাল ও নদী, উন্মুক্ত জলাশয়সহ পানির প্রধান উৎস স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখল ও ভরাটের কারণে দিন দিন বাড়ছে খাবার পানির তীব্র সংকট। সরকারিভাবে পানি সংকট সমাধানের উদ্যোগের কথা বলা হলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রতিবছরই উপকূল জুড়ে নদী ভাঙ্গন আর সুপের পানির সংকটে এক ধরণের নিরব আতংক চলে আসছে। যেটা চোখে দেখা যায় না। তবে আতংকগ্রস্ত মানুষের ছুটাছুটি দেখে বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাড়া খেয়ে যুগযুগে গড়ে ওঠা পুরানো বাড়িগুলো সরিয়ে নিতে হয় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। ঝড়-ঝাপটা বিপন্ন-বিধ্বস্ত বহু মানুষ। তবুও নি:স্ব মানুষেরা আবার স্বপ্ন দেখে বাঁচার, ঘর বাঁধার। এখন এমনই এক আতংকের সময়ের মধ্যে রয়েছে উপকূলবাসী।

সরকারী বর্ষপঞ্জির হিসেবে, ১৫ মার্চ থেকে ঝড়ের মৌসুম শুরু হয়ে শেষ হয় ১৫ অক্টোবর। এই সাত মাস বিভিন্ন ধরণের দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয় উপকূলের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট সহ ১৭ টি উপকূলীয় জেলার মানুষের। এমনিতেই এ অঞ্চলের মানুষ এই সময়ে বহু দ্বীপ-চর পানিতে ডুবে থাকে। তার উপর রয়েছে ঝড়, জলোচ্ছাসে ভাসিয়ে নেয় বাড়িঘর। বহু মানুষ হয় গৃহহারা।

গত রবিবার (২৮ এপ্রিল) খুলনায় এক সেমিনারে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, নদী ভাঙ্গনে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা চেয়ে টেকসই নদী ব্যবস্থাপনার উপর সরকার জোর দিচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষে যাতে ঝড় ও জলোচ্ছাসের ভয়াবহতায় টিকে থাকতে পারে তার প্রয়োজনীয় উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে । আইলা, সিডরে স্থানান্তরিত প্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধ পরিকর ।

সূত্রমতে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট সহ ১৭টি উপকূলীয় জেলার প্রায় ৫০ লাখ মানুষের বসবাস। দীর্ঘ সময়ে এ অঞ্চলে বসবাস করলেও আজো চলছে তাদের সুপেয় পানির তীব্র জনস্বাস্থ প্রকৌশল, কৃষি বিভাগ ও পাউবো সুত্রে পাওয়া তথ্যে, উপকূলের ১৭ জেলা বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ অন্যান্য স্থানে সুপেয় পানি সংকট দীর্ঘ দিনের। প্রায় ৪০/ ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ বছরের অধিকাংশ সময়ই ভুগছেন, সুপেয় পানির তীব্র সংকটে। সিডর ও আইলা বিধ্বস্ত উপকূলীয় এলাকায় পানির উৎস্যগুলো নষ্ট হওয়ার পর, এখনো পুরোপুরি পুনর্গঠন হয়নি। এছাড়া সরকারি জলাশয় বাণিজ্যিকভাবে লিজ ও ভরাট করার প্রতিযোগিতা চলছে। এক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না নিষেধাজ্ঞা। এসব কারণেও বাড়ছে খাবার পানি সংকট।

উপকূলীয় অঞ্চলের সুপেয় পানি সমস্যার জন্য সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ও শহরমুখী পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক আন্দোলনের নেতারা। তবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য সুপেয় ও নিরাপদ পানির সংকট নিরসনে,  সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা। পানির উৎসের লিজ বন্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি, গ্রামাঞ্চল ভিত্তিক সমন্বিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি উপকূলবাসীর।

পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম উপকূলীয় ১৭টি জেলার ছয়টির সুপেয় পানির সংকট সব থেকে তীব্র। এগুলো হলো খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও বরগুনা। সংশ্লিষ্ঠরা এ সম্পর্কে জানান, এই এলাকাটি ব-দ্বীপের নিম্নভাগে হওয়ায় ভূগর্ভে জলাধারের জন্য উপযুক্ত মোটা দানার বালু বা পলিমাটির পরিবর্তে নদীবাহিত অতি সূক্ষ্ম দানার বালু ও পলি বেশি দেখা যায়। যে কারণে এসব অঞ্চলে ভূগর্ভেও পানযোগ্য পানি পাওয়া যায় না। কোনো কোনো অঞ্চলে ৯০০ থেকে এক হাজার ফুট গভীরে কখনো কখনো সুপেয় পানি পাওয়া যায়।

খুলনার পাইকগাছা, কয়রা ও দাকোপ, সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও দেবহাটা, বাগেরহাটের মংলা ও শরণখোলা, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, বরগুনার পাথরঘাটা এবং পটুয়াখালীর গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলায় গভীর নলকূপ বসিয়েও মিষ্টি পানি পাওয়া যায় না। গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হলেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূল জুড়েই পানি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। এই অঞ্চলে এখনো অনেক নদী নালা খাল বিল থাকা সত্ত্বেও তার সঠিক তদারকী না হওয়ায় সেগুলো মরা ও দূষনে আক্রান্ত । সংগত কারণেই নদীর পানি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পান ও ব্যবহারের অযোগ্য।

মৃত্তিকা গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) গবেষণা জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাগরবাহিত নদীগুলোর নোনার মাত্রা আগে থেকে অনেক বেড়েছে এবং বেশি সময় দীর্ঘ স্থায়ী হচ্ছে। বছর দশেক আগেও এই অঞ্চলের নদীগুলোয় নোনার মাত্রা বাড়তো এপ্রিল থেকে মে-জুন মাসে। এখন কপোতাক্ষ, শিবসা, পশুর, ভৈরব, রূপসা, বলেশ্বর, কচা, পায়রা, বিষখালী প্রভৃতি নদীতে নোনা আসে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস থেকে। আর ভারি বৃষ্টি না হলে সেই নোনার মাত্রা কমে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৃষ্টি আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে বেশি হওয়ায় নদীর নোনা কমে সহনশীল পর্যায়ে আসতে ওই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলে পানি সংকটের অবস্থা আমরা শহরবাসী গরম কালে টের পাই। এ বছর এখনই খুলনা মহানগরীর অনেক গভীর নলকূপে পানি উঠছে না। এর কারণ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া।’ তিনি আরো বলেন, ‘ভূগর্ভের পানির ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে পুনর্ভরণের (রি-চার্জ) সমস্যা। যে পরিমাণ ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে, আনুপাতিক হারে সেই পরিমাণ পানি আবার ভূগর্ভে যাচ্ছে না। সুপেয় পানির সংকট সমাধানে, ভরাট হওয়া সরকারি পুকুর ও খাল-নদী সংস্কার এবং পানির উৎসের লিজ বন্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চল ভিত্তিক সমন্বিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি উপকুলবাসীর।

This post has already been read 3937 times!

Check Also

পরিবেশ সুরক্ষা ও পানি সাশ্রয়ে এডব্লিউডি সেচ পদ্ধতি

ড. এম আব্দুল মোমিন: ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। আউশ, আমন  বোরো মৌসুমে আমাদের দেশে ধান …