শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

পাউবো’র অবহেলায় কয়রার ২১ কিলোমিটার বাঁধ মারাত্মক ঝুঁকিতে  

ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা): খুলনার কয়রা উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ কেটে পাইপ বসিয়ে নদী থেকে পানি তোলা ও নামানো হচ্ছে। এতে পানির চাপে গর্ত সৃষ্টি হয়ে ধস নামছে বাঁধের দু’পাশে। কোনো কোনো সময় ওই ধস ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে এলাকা। ঘটছে ফসলহানি, মানুষ হারাচ্ছে বসতভিটা। এমন অবস্থা দীর্ঘদিনের। বাঁধ কেটে ঘেরে পানি তোলা ও নামানোর কারণে বর্তমানে প্রায় ২১ কিলোমিটার বাঁধ গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে ওই সব স্থান ভেঙে প্লাবিত হতে পারে বিস্তীর্ণ এলাকা। তবে যাদের জন্য এমন অবস্থা, তাদের বিরুদ্ধে পাউবো কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা বললেও তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

সূত্র অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে বাঁধে বসানো অবৈধ পাইপ অপসারণের কাজে নেমেছিল পাউবো। এ জন্য সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল চিংড়ি চাষিদের। তাতে সাড়া না দেওয়ায় সর্বশেষ তালিকা তৈরি করে অবৈধ পাইপ অপসারণের জন্য নোটিশ জারি করা হয় ঘের মালিকদের নামে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পাউবোর মহাপরিচালকের দাপ্তরিক আদেশ মোতাবেক সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-২ -এর নির্বাহী প্রকৌশলী স্বাক্ষরিত এ নোটিশ দেওয়া হলেও কেউ সে নির্দেশ অনুসরণ করেনি। বরং পাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এমন নির্দেশ উপেক্ষা করে ঘের মালিকরা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ চালিয়ে আসছেন। ফলে প্রতি বছর বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে পাউবোর কিছু কর্মকর্তা লাভবান হলেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

দেখা গেছে, কয়রায় পাউবোর ১৩/১৪-১ ও ১৩/১৪-২ নম্বর পোল্ডারের পবনা ক্লোজার, লোকা, মঠবাড়ি, দশালিয়া, শিকারিবাড়ি ক্লোজার, নয়ানি স্লুইস গেট সংলগ্ন এলাকা, কাটকাটা, গাজীপাড়া, গোবরা, ঘাটাখালি, হরিণখোলা, মদিনবাদ লঞ্চঘাট, জোড়শিং, আংটিহারা, গোলখালি এলাকার ঘের মালিকরা বহাল তবিয়তে বাঁধ কেটে অথবা ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে এখনও নদীর পানি উত্তোলন করে চলেছেন। সূত্র অনুযায়ী, উপজেলায় পাউবোর বাঁধ কেটে অথবা ছিদ্র করে ৪০১টি স্থানে পাইপ বসিয়ে নদীর পানি তোলা এবং নামানো হচ্ছে। এতে এসব এলাকার প্রায় ২১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, এসব এলাকায় দায়িত্বরত পাউবোর কর্মকর্তারা পাইপ অপসারণের ভয় দেখিয়ে ঘের মালিকদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে থাকেন। তালিকা অনুযায়ী ঘের মালিকদের কাছ থেকে বার্ষিক টাকা আদায় করেন খলিল নামে এক ব্যক্তি। খলিল স্থানীয় মানুষের কাছে শ্রমিক সরদার হিসেবে পরিচিত। পাউবো অনেক কর্মকর্তাদের কাছে খলিল পাউবোর ঠিকাদারী প্রতিস্থান সোনালী এন্টার প্রাইজের মালিক। ১৩/১৪-২ নম্বর পোল্ডারের দায়িত্বরত কর্মকর্তা প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন জানান, খলিল শুধুমাত্র লেবার সরদার।

পাউবোর মোটর সাইকেলটি খলিলকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। তিনি পাউবোর স্টিকার লাগানো মোটর সাইকেলে চড়ে ঘের মালিকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আর মোটা অংকের এই অর্থের ভাগ সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বরত কর্মকর্তা মশিউল আবেদীন, সেলিম মিয়া, এসডি নাহিদুল ইসলা, বড়বাবু মো. শাহিনূর রহমান, রাজস্ব সার্ভেয়ার বিমল কৃষ্ণ গায়েন,            মানবেন্দ্র বিশ্বাস, বিশ্বজিৎ ঘোয, মোহাম্মদ আলীসহ পাউবোর সাতক্ষীরা-২ বিভাগের অনেক কর্মকর্তা এ অবৈধ অর্থের ভাগ পান । শুধু ঘের মালিকদের টাকাই নয় পাউবোর সাতক্ষীরা-২ বিভাগের যতো মেরামত ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করা ঠিকাদারদের কাজ থেকেও ১০/২০ কমিশন আদায় করা হয়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পাউবো কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে সেখান থেকে প্রতি বছর আর্থিক সুবিধা নিচ্ছে। যে কারণে তাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরে। এসব অভিযোগের বিষয়ে পাউবোর কর্তব্যরত উপ-সহকারী প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন ভুক্তভোগিদের অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থকারীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তারা। এখানে কোনো অর্থ আদায় করা হয়না । তিনি জানান খলিল স্থানীয় লেবার মাত্র তার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গাজী শামসুর রহমান জানান, গত শুক্রবার তার এলাকার জোড়শিং এলাকার একটি ঘেরের পানি সরবরাহের জায়গায় বাঁধ ধসে যায়। তাৎক্ষণিক পাউবোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মোবাইলে ফোন করলে তিনি খলিল নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তিনি অভিযোগ করেন, কয়রা উপজেলায় দায়িত্বরত কর্মকর্তারা কেউ কর্মস্থলে থাকেন না। তাদের হয়ে খলিল নামের এক শ্রমিক সরদার সব দায়িত্ব পালন করেন। মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের তেঁতুলতলারচর এলাকার ঘের মালিক ইউনুস আলী বলেন, ‘ঘেরে পানি নিতে হলে বাঁধ কেটে পাইপ বসাতেই হবে। এ জন্য আমরা পাউবোর নিয়োজিত লোককে টাকা দিয়ে থাকি। দশালিয়া এলাকার ঘের মালিক আব্দুল গাজী জানান, প্রতিটি মৌজার ঘের মালিকরা বছরের শুরুতে পাউবো কর্মকর্তাদের জন্য টাকা জমা করে রাখেন। এ জন্য বছরে বিঘা প্রতি একশ’ টাকা হারে আদায় করা হয়। তিনি বলেন, কেবল দশালিয়া মৌজার ঘের মালিকরা প্রতি বছর প্রায় এক লাখ টাকা পাইপ খরচ বাবদ দিয়ে থাকেন। পুরো উপজেলায় এর পরিমাণ কোটি টাকার মতো।

মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা বিজয় কুমার সরদার বলেন, ‘পরিকল্পিত পন্থায় চিংড়ি চাষের জন্য স্থানীয় মৎস্য অফিস ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। তবে সেদিকে স্থানীয় ঘের মালিকদের আগ্রহ কম। তারা কম খরচে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মাছ চাষে আগ্রহী। এ কারণে প্রতি বছর বাঁধ কেটে পাইপ বসানোর জন্য তারা পাউবো কর্মকর্তাদের খুশি রাখার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, বাঁধ সংস্কারের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। অথচ সরকারের সে টাকা পাউবোর সাতক্ষীরা-২ বিভাগের কর্তা ব্যক্তিরা ঠিকাদারের সাথে ভাগ করে খাচ্ছে। সংস্কারের নামে একদিকে চলছে ঠিকাদার ও পাউবো কর্মকর্তাদের ভাগাভাগি, অন্যদিকে সংস্কার করা স্থানে পুনরায় ক্ষতিগ্রস্থ করতে টাকার বিনিময়ে সেখানে পাইপ বসানোর অলিখিত অনুমতি দিচ্ছেন পাউবোর সাতক্ষীরা-২ বিভাগের কর্তা ব্যক্তিরা। স্থানীয়দের দাবী দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তারা পাউবোর সাতক্ষীরা-২ বিভাগে এবং পাউবোর খুলনার ২টি ডিভিশনে সাড়াশী অভিযান পরিচালনা করলেই বেড়িয়ে যাবে পাউবো খুলনা ও সাতক্ষীরার দুর্নীতির চিত্র কতোটা ভয়াবহ।

তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পাউবোর সাতক্ষীরা-২ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান। তিনি বলেন, এর আগে কী হয়েছে জানা নেই। আমি যোগদানের পর বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছি। এরই মধ্যে ঘের মালিকদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাপ্তরিক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

This post has already been read 2666 times!

Check Also

ভেটেরিনারি ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ভ্যাব) এর বিক্ষোভ সমাবেশ

ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামলীগের বিদায়ের তিন মাস অতিক্রান্ত হলেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে …