ডা. মো. নূরুল আমীন : মায়েরা যখন সিজারিয়ান সেকশন করে হাসপাতালে সন্তান জন্ম দেন, তখন কি হাসপাতালে পানি পড়া দেওয়া হয় এবং ওই শিশু কি পানি পান করে না কি দুধ পান করে!? যদি দুধ পান করে থাকে তাহলে ওই শিশুর জীবনটা শুরু হল বড় বড় এন্টিবায়োটিকের রেসিডিউ দিয়ে!! না কি ভুল বললাম?
সেটা নিয়ে আগে গবেষণা হওয়া উচিত নয় কি? আগে তো শিশুর অস্তিত্ব তারপর না শিশুদের বাবা-মা! এগুলো নিয়ে ভাববার আরো পরে দুধ নিয়ে ভাবা যেতে পারে।
এন্টিবায়োটিক ছাড়া কখনো গবাদিপশুর চিকিৎসা হবে না। প্রতিটা এন্টিবায়োটিকের একটা উইথড্রল পিরিয়ডও আছে এবং রেসিডুয়াল ইফেক্টও আছে। পৃথিবীর কোন দেশ তা অস্বীকার করতে পারবে না। আমাদের দেশে সম্পূর্ণরূপে বি
জ্ঞানভিত্তিক ডেইরি ফার্ম এখন পর্যন্ত (গুটিকয়েক উদাহরণ ছাড়া) গড়ে উঠেছে কি? যে সমস্যাটি এখন চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে সেই সমস্যাটি নতুন কিছু নয় ইহা শত বছরের পুরাতন!
এন্টিবায়োটিক যেখানে সেখানে যথেচ্ছাচারভাবে কেন পাওয়া যায়? এটা দেখার দায়িত্ব কি খামারিদের? গ্রামেগঞ্জে সর্বত্রই চিকিৎসা কর্মটি সম্পাদিত হয় খামারীর নিজের চেষ্টায় অথবা গ্রাম্য ডাক্তারগণের দ্বারা। অধিক উৎপাদনশীল দুধের গাভী আমাদের দেশে আগে ছিল না। গাভী পালন পদ্ধতিও আবহমানকাল ধরে একই পদ্ধতিতে এখনো পর্যন্ত চলছে! একই সাথে চলছে রোগব্যাধিরও মহড়া!
দেশে অনেক খামারি সচেতন হলেও বহু খামারি এখনো অসচেতন অবস্থায় খামার পরিচালনা করছেন! বাজারের ফলমূলের বিষ এর ন্যায় এন্টিবায়োটিকও অবশ্যই খুবই মারাত্মক। অতএব, এর গবেষণাও সুনির্দিষ্টভাবে হওয়া উচিত এবং ব্যাপারে সরকারেরই পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। মানুষকে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের, উৎপাদক সেখানে সহযোগিতা করতে পারে মাত্র। এককভাবে সারা বাংলাদেশের মধ্যে একজন ব্যক্তি কয়েকটি দুধের নমুনা পরীক্ষা করে তিনি দেখলেন তার মধ্যে এন্টিবায়োটিক আছে (তাও আবার পশু চিকিৎসার ক্ষেত্রে তা ব্যবহৃত হয় না!) সেই এন্টিবায়োটিক এর পরিমাণ দুধে কতটুকু ছিল? মানব স্বাস্থ্যের জন্য তা কতটুকু ক্ষতিকর ছিল? যে এন্টিবায়োটিকের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, তা আদৌ গবাদিপশুতে ব্যবহৃত হয় কিনা এ বিষয়গুলো নিয়ে একটা সায়েন্টিফিক সেশন বা ওয়ার্কশপ করার দরকার ছিল বিজ্ঞানী সাহেবের।
তিনি কি সেগুলো করেছেন? না তিনি তা করেননি বরং অকস্মাৎ তিনি একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে দেশের লাখ লাখ গরিব জনসাধারণ এবং খামারিদের বিপক্ষে উনি একক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছেন! সরকারের দুটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আছে, যার একটি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং অপরটি প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাদের সাথেও উনি কোন আলাপ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি! কেন করেননি? উনি একাই একশ হয়ে গেলেন এবং এতগুলো মানুষকে প্রতিবাদী বানালেন। এটা কি ঠিক হলো?
বিষ কেন মানুষ খাবে এবং খামারিরা তা খাওয়াবেন? এই মৌলিক সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব কিন্তু সরকারের? না কি দুধ উৎপাদনকারির? আমি বেশি কিছু বুঝি না। এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধ করা যেমন সরকারের দায়িত্ব তেমনি নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চিত ও সরবরাহ করার দায়িত্বও সরকারের।
একজন খামারিকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার দায়িত্বও কিন্তু খামারির একার নয়। এখানে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি। কারণ দুধ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। আমি কি আমার লেখায় সেটা অস্বীকার করেছি? করি নাই। যেকোন উপায়ে এন্টিবায়োটিকে ঝাটিয়ে বিদায় করতে হবে সবার আগে এবং সেটা তখনই সম্ভব হবে খামারিরা যখন শতভাগ সচেতন হবেন এবং সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খামার পরিচালনা করায় অভ্যস্ত হবেন। তারপরও কিছু না কিছু রোগ ব্যাধি হবে, এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারও চলবে সুনির্দিষ্টভাবে।
কিন্তু সেই কাজটি কে করবেন? একজন রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি ডক্টর? নাকি একজন খামারি? নাকি গ্রামের পল্লী চিকিৎসকগণ? যে সমস্যাটিকে গবেষণার মাধ্যমে উনি চিহ্নিত করেছেন সেই তথ্যটি উনি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন কি না? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, জনস্বাস্থ্য বিভাগ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে পারতেন কি না? তিনি করেন নাই! যে কারণে তার গবেষণা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে! এনরোফ্লক্সাসিন, লিভোফ্লক্সাসিন জীবনেও গবাদিপশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় না! তিনি তা দুধের মধ্যে কেমনে পেলেন?
সারা বাংলাদেশের দুধ সরেজমিনে সব স্রে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হোক! জনগণ দুধের মাধ্যমে বিষ খাক, এন্টিবায়োটিক খাক একজন শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ হিসেবে এটা আমি কখনোই সমর্থন করবো না। কিন্তু এলোমেলো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সারা বাংলাদেশেটা গরম করে ফেলবেন এটাও তো মেনে নেওয়া যায় না! কথাই বলে,”কাজ করলো বেহুদ্দা, মার খাওয়ালো গুষ্টি শুদ্ধা!” উনার গবেষণাটা হয়েছে এমন! খামার পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু না কিছু কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি এখনো আছে। সারা দুনিয়াতেও সেটা আছে এবং থাকবে। কিন্তু এসব কিছুর মনিটরিং করার দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিংবা পরিদপ্তরের। সমস্যাটা তো সার্বজনীন নয়, ক্ষেত্র বিশেষের। কিন্তু উনি বিষয়টা সার্বজনীন করে ফেলেছেন।
আমরা চাই এটা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হোক এবং আরও সমৃদ্ধ তথ্য বেরিয়ে আসুক। দেশের মানুষ নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা পাক, সেখানে কোন কম্প্রোমাইজ করতে কাউকে আমরা পরামর্শ দিতে পারি না বা কাউকে এ ব্যাপারে সমর্থনও দিব না। কিন্তু ভূঁই ফোড়ের মত হঠাৎ কিছু একটা করাও উচিত হবে না।
যে এন্টিবায়োটিকের কথা উনি উল্লেখ করেছেন, ঐ ধরনের কোন এন্টিবায়োটিক গবাদিপশুর ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য আমাদের দেশে কেউ এখনো বাজারজাত করেননি বা তৈরি করেনি। কিন্তু উনি সেটা পেয়েছেন!!? ব্যাখ্যা করলে এখানে লম্বা একটি আর্টিকেল লেখা যাবে। আমি কোন একপেশে সমর্থন দেইনি।
আমার ক্লিয়ার কাট বক্তব্য হলো- দুধকে অবশ্যই নিরাপদ করতে হবে। সে নিরাপদটা করা ও দেখার দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন গবেষকের নয়। তবে কেউ যদি গবেষণা করতে চান, সে ফলাফল তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে শেয়ার করবেন, আগেই বাজারে যেয়ে তিনি ঢাকঢোল পেটাবেন না। এটাই শেষ কথা।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় উপ-পরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
বর্তমানে ন্যাশনাল লাইভস্টক কনসালটেন্ট, এসিআই এনিম্যাল হেলথ ডিজিজ ডায়াগনস্টিক ল্যাব, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।