বেঁচে থাকার জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের কোন বিকল্প নেই। শর্করা জাতীয় খাদ্যের পাশাপাশি আমিষ জাতীয় খাদ্যও গ্রহণ করতে হবে। খাদ্য হতে হবে মানসম্পন্ন ও নিরাপদ। বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যত এবং লাগসই উন্নয়নের একটি অন্যতম পূর্বশর্ত এটি। শনিবার (৩ জুলাই) সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘প্রোটিন ফর অল’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা। সেমিনারটি যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও ইউ.এস. সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (ইউএসএসইসি)।
সেমিনারের প্রধান অতিথি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আবু সায়ীদ বলেন, সবাইকে পুষ্টিকর খাদ্য খেতে হবে। সুস্থ্য ও স্বাস্থ্যবান থাকতে হবে। বেশি খাওয়া যাবেনা আবার কম খাওয়াও ঠিক হবেনা।
তিনি বলেন, বর্তমান প্রজন্ম ফাস্টফুডের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর ফলে অনেকেই স্থূলতা সমস্যায় ভুগছেন, স্বাস্থ্য জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে শরীর চর্চার পরামর্শও দেন তিনি।
বিপিআইসিসি’র সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু আবাদী জমির পরিমান প্রতিদিনই কমছে। তাই সবার জন্য নিরাপদ আমিষ নিশ্চিত করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে।
তিনি বলেন, যে সকল অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যে ভেজালের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবেনা। এ বিষয়ে প্রত্যেককে সোচ্চার হতে হবে, সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।
তিনি বলেন, বাজারে পোল্ট্রির মাংস ও ডিমের দাম এখনও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তবে পোল্ট্রি’র ডিম ও ব্রয়লার মুরগির মাংস নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এ ধরনের অপপ্রচারের কারণে অনেক মানুষ সাময়িকভাবে ডিম ও মুরগির মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন। এতে তাঁর নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্যহানীর কারণ ঘটছে। তাই এ ধরনের অপপ্রচার বন্ধ হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ট্যানারির বর্জ্যরে দায় ট্যানারি শিল্পকেই নিতে হবে। ট্যানারি শিল্প সংলগ্ন এলাকায় নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করার পরামর্শ দেন তিনি।
ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার সভাপতি ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী মানবদেহের শক্তির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আসা উচিত আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে। আর এই আমিষের ২০ শতাংশ আসতে হবে প্রাণিজ আমিষ থেকে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই এই আমিষের ৫০ শতাংশই আসে প্রাণিজ উৎস থেকে। তিনি বলেন, এক পরিসংখ্যান মতে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু প্রোটিন কনজাম্পশনের পরিমান ৮৩ গ্রাম যার ৬৭ শতাংশই প্রাণিজ আমিষ।
ইউএসএসইসি’র কনসালট্যান্ট মি. পাওয়ান কুমার বলেন, কী খাচ্ছি, কেন খাচ্ছি, তার খাদ্যগুণ কী এ বিষয়ে প্রত্যেক সচেতন মানুষেরই পরিস্কার ধারনা থাকা উচিত। কতটুকু বডি ওয়েটের জন্য কী পরিমান প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে এ বিষয়ক জ্ঞানের অভাব কিংবা অসচেতনতার কারনেই কেউ কেউ অপুষ্টিতে ভুগছেন আবার কেউ ভুগছেন অবেসিটিতে (স্থূলতায়)।
তিনি বলেন, অধিক আয়ু ও জীবনীশক্তি পেতে হলে, শারিরিকভাবে লম্বা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারি হতে হলে, মেধাবি হতে হলে পরিমানমত আমিষ জাতীয় খাদ্য অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। চীনা শ্রমিকদের কর্মজীবন ৪০ থেকে ৪৫ বছর। সেখানে আমাদের মত দেশের শ্রমিকদের কর্মজীবন মাত্র ২৫ বছর। কারন তাঁরা পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ করে থাকে।
মি. পাওয়ান আরো বলেন, বিশ্বের প্রায় ২৬ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় অপুষ্টিজনিত কারনে। দক্ষিণ এশিয়ার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। প্রোটিন বিষয়ে সচেতনা বাড়াতে হবে, গণমাধ্যমকে আরও ইনডেপথ্ কাজ করতে হবে।
বারডেমের পুষ্টি বিভাগের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, পুষ্টি স্বল্পতার কারণে আমাদের দেশের প্রচুর মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুরা নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে ব্যক্তি ও পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেই সাথে স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রের ব্যয়ও বাড়ছে।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লেও যেহেতু ডিম, দুধ, মাছ, মাংস প্রভৃতি খাদ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে তাই নিম্ন আয়ের মানুষেরা খুব বেশি সুবিধা পাচ্ছেন না। সে কারণেই মাথাপিছু আয় আরও বাড়াতে হবে সেই সাথে পুষ্টিকর ও আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পরিমানও বাড়াতে হবে।
বিশিষ্ট রন্ধন শিল্পী কল্পনা রহমান ও রহিমা সুলতানা রীতা বলেন, অধিক তাপে দীর্ঘসময় এবং অতিরিক্ত তেল-মসলা দিয়ে রান্না করলে খাদ্যগুণ নষ্ট হয়। এতে উদরপূর্তি হয় ঠিকই তবে পুষ্টি চাহিদা অপূর্ণ রয়ে যায়।
তাঁরা বলেন, ডিম একটি আদর্শ খাবার। তাই সবারই নিয়মিত ডিম খাওয়া উচিত। বাচ্চারা ডিম খেতে না চাইলে ডিম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করে খাওয়ানো যেতে পারে। তাঁরা বলেন- অনেকেই মনে করেন ব্রয়লার মুরগি মানেই কষানো মাংস, এ ধারনা ঠিক নয়। ব্রয়লার মুরগি দিয়ে অসংখ্য উপাদেয় খাবার তৈরি করা যায় খুব সহজেই।
প্রোটিন ফর অল সেমিনারটি শুরুর আগে একটি রন্ধন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ব্রয়লার মুরগির মাংস ও ডিম দিয়ে নানান পদের সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার তৈরি করেন প্রতিযোগিরা। প্রতিযোগিতায় সেরা রাঁধুনি হিসেবে প্রথম পুরস্কার পান বনশ্রীর সোনিয়া হক, দ্বিতীয় হন উত্তরার সুমাইয়া আক্তার এবং তৃতীয় হন বনশ্রী’র জুবায়েদ করিম। প্রথম পুরস্কার বিজয়ী ৫০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় বিজয়ী ৩০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় বিজয়ী ২০ হাজার টাকার প্রাইজমানি পান। এছাড়াও প্রত্যেক প্রতিযোগিকে ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।