শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

সোহাগ: পাকুন্দিয়ার কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় এক নাম

হামিমুল হক সোহাগ

সাখাওয়াত হোসেন হৃদয়, পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ): হামিমুল হক সোহাগ। কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা। উপজেলার এগারসিন্দুর ইউনিয়নের দাওরাইট, আদিত্যপাশা, আঙ্গিয়াদী, বারাবর, চামরাইদ ও খামা গ্রাম নিয়ে গঠিত আঙ্গিয়াদী ব্লকের দায়িত্বে রয়েছেন। ২০০৬সালে এ উপজেলায় যোগদানের পর নিজের শ্রম, মেধা, কৃষকদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ও পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। কৃষি বিষয়ক যে কোন প্রয়োজনে, পরামর্শে ও সহায়তায় তাকে সবসময় পাশে পাচ্ছেন কৃষকেরা। হতদরিদ্র অনেককে কৃষি প্রযুক্তিতে সম্পৃক্ত করে পরিবারে স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছেন। রাত কিংবা দিন সর্বক্ষণ কৃষি ও কৃষকদের নিয়েই ভাবেন এ কর্মকর্তা। তাইতো তিনি অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা, ব্যতিক্রম। নিজের কাজের মাধ্যমে গ্রামের সাধারণ কৃষকের প্রিয় মানুষে পরিণত হয়েছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতীক, বন্ধু বা তাদের প্রিয় মানুষ হতে পারেন তার বাস্তব উদাহরণ এ কর্মকর্তা।

২০০৪ সালে তিনি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। প্রথম কর্মস্থল ছিল নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায়। ২০০৬ সালে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় বদলী হন। তার বাড়িও একই উপজেলায়। নিজ এলাকায় চাকরি করার পরও পরিবারের চেয়ে সাধারণ কৃষকদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তিনি। যেখানে অনেক ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ ছিলো সেখানে কর্তব্য ও দায়িত্বের প্রতি অবিচল থেকে কৃষকদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। এজন্যই তিনি অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম। কৃষকদের সাথে সার্বক্ষণিক সম্পর্ক স্থাপন ও কৃষি প্রযুক্তিতে কৃষকদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে কৃষি বিপ্লব ঘটিয়েছেন। কৃষকদের করেছেন আধুনিকায়ন। বাড়তি আয়-রোজগারের পাশাপাশি অনেককে করেছেন স্বাবলম্বী।

ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) ব্যবহার ও উৎপাদন, বিষমুক্ত কলা উৎপাদনে ব্যাগিং পদ্ধতি, ইয়েলো কালার ট্র্যাপ, ফেরোমন ট্র্যাপ, ডাম সিডার দিয়ে বপন পদ্ধতিতে ধান আবাদ, ছাদ বাগান, ড্রাগন চাষ, উচ্চ ফলনশীল ভিয়েতনামী নারিকেল, পাকচং ঘাষ চাষ, বারো মাসি সজিনা ও মচির চাষ এবং খামারজাত সার সংরক্ষণ (গোবর সংরক্ষণ) প্রভৃতি কর্মকান্ড বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রামের কৃষকদের আধুনিকায়ন করেছেন।

ফেসবুকে ‘কৃষি কর্মকর্তা ব্লক আঙ্গিয়াদী’ আইডির মাধ্যমে জনসাধারণকে কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে আসছেন। দিনের বেলায় কাজে ব্যস্ত থাকা চাষীদের কৃষি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য খুলেছেন রাত্রীকালিন পরামর্শ কেন্দ্র। সপ্তাহের সাতদিনই সন্ধ্যা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বিনামূল্যে কৃষকদের পরামর্শ প্রদান করছেন। এক গ্রামের কৃষকদের সাথে অন্য গ্রামের কৃষকদের সংযোগ স্থাপন করে দিচ্ছেন। কৃষি বিষয়ক নিত্য নতুন প্রযুক্তি, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে পরামর্শ প্রদান করে আসছেন।

খামা গ্রামের কৃষকদের কেঁচো সার উৎপাদন ও ব্যবহারে সম্পৃক্ত করে ভার্মি গ্রামের স্বীকৃতি এনে দিয়েছেন। কেঁচো সারের গ্রাম হিসেবে এ গ্রামের নাম এখন দেশজুড়ে। কেঁচো সার উৎপাদন করে এ গ্রামের এক কৃষক বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক লাভ করেছেন। হতদরিদ্র এক নারী ভার্মি কম্পোস্ট করে সংসারে স্বচ্ছলতার আনার পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়া এ গ্রামের শতশত  কৃষাণ-কৃষাণি তাঁর পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে এখন স্বাবলম্বী।

সম্প্রতি আংগিয়াদী গ্রামে নূরুল ইসলাম নামে এক কৃষককে পরামর্শ দিয়ে অফ সিজনের তরমুজ চাষ করিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। অফ সিজনে তরমুজ চাষ করে ব্যাপক সাফল্য ও আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন ওই চাষী। খামা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বয়সী কৃষক মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘২০১৭সালে আমি সোহাগের পরামর্শে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করি। জমিতে কেঁচো সার ব্যবহারে ব্যাপক সাফল্য পাই। পরে বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো সার উৎপাদন করতে থাকি। এভাবে আমি পর্যায়ক্রমে লাভবান হতে থাকি। ২০১৮সালে আমি বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক পাই। আমার জীবনে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। এ পদক আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে এর সকল কৃতিত্ব সোহাগের। তার জন্যই আমার এত পরিচিতি ও অর্জন। আমি তার দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনা করি।’

একই গ্রামের কৃষক খুর্শিদ উদ্দিন বলেন, ‘সোহাগ ভাইয়ের পরামর্শে ১৭শতাংশ জমিতে ড্রাগন চাষ শুরু করি। এ উপজেলায় আমিই প্রথম ড্রাগন ফল চাষী। শুরুতে আমাকে নিয়ে অনেকেই হাসি তামাশা করতো। এখন আর কেউ তা করে না। ড্রাগনের ফল ও গাছের কাটিং বিক্রি করে আমার সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে।’

এছাড়াও আঙ্গিয়াদী ব্লকের নাছিমা, আলেয়া, রহিমা, রাবেয়া, খাদিজা, নূরুল ইসলাম, জালাল উদ্দিন ও আলাউদ্দিনসহ অনেক কৃষাণ-কৃষাণিকে কৃষি প্রযুক্তিতে সম্পৃক্ত করে বাড়তি আয় রোজগারের মাধ্যমে তাদের সংসারে স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছেন এ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, হামিমুল হক সোহাগ একজন দক্ষ সংগঠকও। তার নেতৃত্বে আঙ্গিয়াদী ব্লকের তিনটি কৃষক সমিতি এনএটিপি-২ প্রকল্প থেকে আট লাখ টাকার কৃষি যন্ত্রাংশ অনুদান পায়। এসব কৃষি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে কৃষকেরা আরও বেশি লাভবান হবে এবং কৃষি ক্ষেত্রে আরও উন্নয়ন হবে। এভাবে তিনি নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যে এ এলাকার কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত রেখে চলেছেন।

This post has already been read 5264 times!

Check Also

ডিম ও মুরগির বাজার স্থিতিশীলতায় দরকার  “জাতীয় পোল্ট্রি বোর্ড” গঠন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : পোল্ট্রি শিল্পের সাথে আন্ত:মন্ত্রনালয়, আন্ত:অধিদপ্তর  এবং উৎপাদন ও বিপননে ডজনের উপরে …